২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মাহবুব তালুকদার : তার সাহিত্যকীর্তি

মাহবুব তালুকদার। জন্ম : ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪২, মৃত্যু : ২৪ আগস্ট ২০২২ -

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন একনিষ্ঠ সাধক মাহবুব তালুকদার। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত কবি ও শিশুসাহিত্যিক, সংগঠক। তার প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ৪৮টি। অনেক বই-ই এখন আর বাজারে নেই। এসব বইয়ের মধ্যে কবিতা, গল্প উপন্যাস, শিশুসাহিত্য গ্রন্থ, স্মৃতিচারণমূলক বই ও ভ্রমণকাহিনী রয়েছে। শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। সাবেক নির্বাচন কমিশনার কিংবা আমলা নামের মধ্যে কি লেখক-কবি মাহবুব তালুকদার হারিয়ে গেছেন বলে মনে হয়? কারণ গত ২৪ আগস্ট তার মৃত্যুর পর এ পরিচয়টিই বড় করে এসেছে। মনে হয় তার সাহিত্যিক ব্যাকগ্রাউন্ডটিও আলোচনায় আসা উচিত। বেশির ভাগ গণমাধ্যম সাবেক নির্বাচন কমিশনার হিসেবে তার পরিচয় দিয়েছে। অথচ মাহবুব তালুকদারের লেখালেখির বয়স ছয় দশকের বেশি। ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় মাহবুব তালুকদার লেখালেখি শুরু করেন। ৪৮টি বই প্রকাশ সে কথাই জানান দিচ্ছে।
মাহবুব তালুকদার ১৯৪২ সালের তেরো ফেব্রুয়ারি তৎকালীন নেত্রকোনা মহকুমার পূর্বধলা থানার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। (বর্তমানে নেত্রকোনা জেলা আর পূর্বধলা উপজেলা)। এই জন্ম তারিখ তার বইয়ে উল্লেøখ রয়েছে। তিনি ঢাকার ঐতিহ্যবাহী নবাবপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনের প্রারম্ভে দৈনিক ইত্তেফাকে সাংবাদিকতা ও শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং মুজিবনগর সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ে চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর সহকারী প্রেসসচিবের দায়িত্ব পান তিনি। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং মুজিবনগর সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ে চাকরিতে যোগ দেন। পরবর্তীকালে তিনি সরকারি চাকরির ধারাবাহিকতায় বঙ্গবভনে পাঁচ বছর অবস্থানকালে বিভিন্ন পদে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। তিনি দেশের পাঁচজন প্রেসিডেন্টের সাথে কাজ করেন আর এই অভিজ্ঞতার কথা বর্ণিত হয়েছে ইউপিএল থেকে প্রকাশিত ‘বঙ্গভবনে পাঁচ বছর’ নামক তার স্মৃতিকথামূলক বইয়ে। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বিশেষ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদউল্লøাহর জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় তিনি তার সহকারী প্রেসসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ সালে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। আর ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে মাহবুব তালুকদার নির্বাচন কমিশনের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান।

১৯৬৮ সালে মাহবুব তালুদদারের উপন্যাস ‘ক্রীড়নক’ প্রকাশিত হয়। প্রথম কবিতার বই ‘জন্মের দক্ষিণা’ বের হয় ১৯৭৩ সালে। এরপর তিনি নিয়মিত লিখেছেন গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, কবিতা, রসরচনা, স্মৃতিকথা। পত্রিকায় কলামও লিখতেন। স্বাধীনতার পর মাহবুব তালুকদার আর শিক্ষকতায় ফিরে যাননি, সরকারি চাকরিতেই স্থায়ী হয়ে যান। কেউ কেউ লিখেছেন, ‘তিন দশক আমলাতন্ত্রের ভেতর থাকলেও তিনি পুরোপুরি ‘আমলা’ হতে পারেননি। বহিরাগতই থেকে গেছেন, যার অম্লমধুর বিবরণ আছে তার লেখা আমলার আমলনামা বইয়ে। কথাগুলো মিথ্যে নয়, যার প্রমাণ তার ৪৮টি বই। যার বেশির ভাগই পিওর লিটারেচার। কোনো গবেষক হয়তো তাকে সেভাবেই মূল্যায়ন করবেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে রাষ্ট্রপতি পদ ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী হন। নতুন রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। তার আগ্রহেই মাহবুব তালুকদার বঙ্গভবনে স্পেশাল অফিসার হিসেবে পদায়িত হন। সেই থেকে পাঁচ বছর তিনি বঙ্গভবনে ছিলেন। কখনো রাষ্ট্রপতির জনসংযোগ কর্মকর্তা, কখনো স্পেশাল অফিসার, কখনো উপপ্রেসসচিব, আবার কখনো ওএসডি হিসেবে। মাহবুব তালুকদার বঙ্গভবনে তার কাজের অভিজ্ঞতা বয়ান করেছেন ‘বঙ্গভবনে পাঁচ বছর’ বইয়ে। এটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। এটি একটি অসাধারণ স্মৃতিচারণামূলক বই। এতে ক্ষমতার অন্দরমহলের অনেক অজানা ঘটনার পাশাপাশি সেই সময়ের ক্ষমতালিপ্সু ও সুবিধাবাদী রাজনীতিক, সামরিক -বেসামরিক আমলাদের চরিত্রও উন্মোচিত হয়েছে। লেখক হিসেবে মাহবুব তালুকদার কারো সম্পর্কে কোনো কঠোর ভাষা ব্যবহার না করেও কঠিন কথাগুলো বলে দিয়েছেন। এই বই থেকেই জানা যায়, বঙ্গভবনে পাঁচজন রাষ্ট্রপতির অধীনে তিনি কাজ করেছিলেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, মোহাম্মদউল্লøাহ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় পেয়েছিলেন আবু সাঈদ চৌধুরীকে। বঙ্গভবনে পাঁচ বছর বইয়ে মাহবুব তালুকদার নিজের কথা বেশি না বলে সেই সময়ের চরিত্রগুলোর চিত্র তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে ১৫ আগস্টের আগে ও পরে তাদের কে কী ভূমিকা রেখেছেন, তার বর্ণনা আছে বইয়ে।
নির্বাচন কমিশনের অভিজ্ঞতা নিয়ে এক হাজার ২০০ পৃষ্ঠার বই লিখেছেন বলে জানা যায়। নাম ‘নির্বাচননামা’। তার জীবদ্দশায় বইটি প্রকাশ করা নিয়ে তিনি দোটানায় ছিলেন। এটি প্রকাশিত হলে অনেক বিষয় উন্মোচিত হবে বলে ধারণা। মাহবুব তালুকদার বাংলাদেশে সত্যিকার গণতন্ত্র দেখতে চেয়েছিলেন। এই আকুতি এই সময়ের জন্য কম কথা নয়।
তার অসাধারণ স্মৃতিকথা ‘বঙ্গভবনে পাঁচ বছর’ এর কথা আগেই উল্লেখ করেছি। বনেদি প্রকাশনা সংস্থা ইউপিএল থেকে এটি প্রকাশিত। এ ছাড়াও ‘আমলার আমলনামা’ নামেও আরেকটি স্মৃতিকথা ২০২১ সালে মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত হয়।

তিনি অনেকগুলো উপন্যাস লিখেছেন। উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হচ্ছে- পলাশ ও শিমুলের গল্প, জন্মের দক্ষিণা (১৯৭৩), ক্রীড়নক (১৯৬৮), সব পাখি ঘরে আেেস, আরেকজন আমি, অপলাপ, বন্ধ করোনা পাখা (প্রতিবন্ধী কিশোর নিয়ে উপন্যাস)। তার উপন্যাসে উঠে এসেছে বাংলাদেশের জনজীবন, মানুষের জীবনের প্রত্যাশা ও অচরিতার্থতার বেদনাবোধ, নারী-পুরুষের সম্পকের্র নানা অন্ধিসন্ধি। মানবিক মূল্যবোধকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও উপন্যাস লিখেছেন। এর একটি হচ্ছে ‘একটি বকুল ফুলের মালা’ (২০১৬) ও অপরটি ‘চার রাজাকার’ (প্রকাশক : বাঙালি)। ইতিহাসের সত্যের সাথে কল্পনার মিশেল এগুলোতে আছে। এর সাহিত্যমান নির্ণয়ের ভার পাঠকের। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মহৎ সাহিত্য রচিত হয়নি বলে অনেকের অভিযোগ। মহৎ সাহিত্য লেখার জন্য যে মেধা যে অনুধ্যানের প্রয়োজন সেটি অনেকের মধ্যেই নেই বলেও বলা হয়ে থাকে। তার বইতে মাহবুব তালুকদার কতখানি আনতে পেরেছেন সাহিত্যের গবেষক সমালোচকরা অবশ্যই তার মূল্যায়ন করবেন।
তিনি জাতীয় শিশুসংগঠন কচিকাঁচার মেলার সাথে যুক্ত ছিলেন। শিশুসাহিত্যেও তার অবদান অনেক। তার কিশোর গল্পগ্রন্থ হেডস্যার (প্রথমা) ও স্বনাকধন্য (১৯৭৭) পাঠকপ্রিয় হয়েছে। তিনি সমাজসচেতন ছড়াকারও ছিলেন। লিখেছেন কিশোর কবিতা। এসব বইয়ের মধ্যে আছে- ‘সোনার ছেলে’ (১৯৭৭), পরীর নাম রূপশরী (১৯৭৭), ছড়াপড়া (২০০৮) এবং ‘ছড়াসমগ্র’। ছড়ায় সমাজচেতনা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উচ্চকিত হয়েছে।

বেশ কিছু গল্পগ্রন্থ রয়েছে তার। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- মূর্ত ও বিমূর্ত, প্রকাশ্য-গোপন, স্বপ্ন জড়ানো মানুষ, ইতির ইতিকথা, অরূপ তোমার বাণী, গল্পসমগ্র-১, আমি কখনো সত্য কথা বলি না (এডর্ন) ও চমক রহম। তার গল্পে সত্যকথন রয়েছে, রয়েছে চরিত্রানুগ বিবরণ। যৌনতাকেও তিনি বাদ দেননি, চরিত্রের মধ্যে তা থাকলে লেখক তা এড়াবেন কী করে?
কবি হিসেবে তেমন খ্যাতি হয়তো মাহবুব তালুকদার পাননি। তবে বেশ কিছু কবিতার বইও রয়েছে তার। এগুলোর মধ্যে আছে- আত্মসমর্পণ, প্রেমের চতুর্দশপদী, (জার্নিম্যান বুকস) , মৃত্যুশয্যায় আমি একা, কবিতাসমগ্র (অনন্যা)। এগুলোতে সময়কে ধারণ করেছেন, প্রেমকে উপজীব্য করেছেন, একান্তভাবে নিজের জীবনার্থও তুলে ধরেছেন। তার আরো বইয়ের মধ্যে রয়েছে- সুবর্ণজয়ন্তী, বধ্যভূমি, অবয়ব, জীবনী- খোকার নাম শেখ মুজিব (২০১৩), রম্যরচনা- চাচার পাচালি ও ভ্রমণকাহিনী- সুপ্রভাত আমেরিকা। শেষ বইটি ভ্রমণকাহিনী হলেও লেখার গুণে হয়ে উঠেছে অসাধারণ একটি গ্রন্থ, যা পাঠে আমেরিকার ইতিহাস ভুগোলও জানা যায়।
মাহবুব তালুকদার সময়কে ধারণ করে লেখা তার বক্তব্য এত সব বইয়ের মাঝে তুলে ধরে গেছেন। তিনি যা রেখে গেছেন সময়ের একজন উজ্জ্বল ভাষ্যকার, সাহিত্যিক ও গবেষক হিসেবে তা টিকে থাকবে বলে মনে করেন অনেক সাহিত্যবোদ্ধা। এসব লেখা আধুনিক, এগুলো কালোত্তীর্ণ হওয়ার ক্ষমতা রাখে।


আরো সংবাদ



premium cement