২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অপেক্ষা

অপেক্ষা -

কলেজ থেকে ফিরে মধ্যবয়সী নাজমা পারভিন খাঁচায় দুটো পায়রা দেখতে পান। দেরি না করে উড়িয়ে দেন মুক্ত আকাশে। আহা এখন ওরা স্বাধীন। স্বস্তির নিঃশ্বাস নেন নাজমা।
- অ খালাম্মা শক কইরা কবুতর দুইডা আনলাম তা উড়াইয়া দিলেন। অভিযোগের সুর রেবেকার কণ্ঠে। মুচকি হেসে নাজমা বলেন- স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে চলার সবার অধিকার আছে।
অ খালাম্মা আমার একখান আবদার আছে।
-বল, কী আবদার।
- পোলার বাপের শক, পোলাডারে নিয়া শিশুপার্কে যাইব। তাই আমারে বিকালে যাইতে কইছে।
- যেতে বলেছে যাবি। ছেলেকে পার্কে নিয়ে যাবে সে তো খুব সুন্দর কথা।
- খালাম্মা, আপনে এত ভালো।
- ভালো মন্দের কিছু নেই। আমি নিজের জন্য যেমন স্বাধীনতা পছন্দ করি। অন্যকেও তেমনি স্বাধীনভাবে চলতে সাহায্য করি। স্বাধীনভাবে চলার অধিকার সবারই আছে। যাকগে, যেতে চাইছিস যা। যা কাজ করার আছে। আমি করে নেবো।

রেবেকার সাথে কথা বলতে বলতে চোখের সামনে ভেসে উঠল ফেলে আসা স্মৃতিগুলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের ছাত্রী ছিলেন নাজমা পারভিন। সানিদ আব্দুল্লাহ ছিলেন, তার এক বছর আগের ব্যাচের। পড়াশোনার ব্যাপারেই এক সময় দেখা হয় দু’জনের। আলাপ পরিচয় হয়।
কিছু দিন পর দু’জন দু’জনকে পছন্দ করেন। দু’জনই ছিলেন মার্জিত রুচির মানুষ। সানিদ নাজমার শালীন। চলাফেরা পছন্দ করতেন। আর নাজমা পছন্দ করতেন সানিদ আবদুল্লার ব্যক্তিত্ববোধকে। গভীরভাবে ভালোবাসেন দু’জন দু’জনকে। তাদের ভালোবাসা ছিল সুন্দর পবিত্র।
সানিদের পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হলো নাজমার মা-বাবার কাছে। মাসখানেক পরেই বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়। ইতোমধ্যে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। সানিদ যুদ্ধে চলে যায়। পার হয়ে যায় বিয়ের তারিখ। দিনের পর দিন কেটে যায় সানিদ আসে না। দেশে শুরু হয় যুদ্ধের ভয়ঙ্কর তুফান। চারদিকে বিপদ। মানুষের আহাজারি।

নাজমাদের বাড়ির সামনে ছিল বেশ বড় একটি কামিনী ফুল গাছ। প্রতিদিন সময় পেলেই কামিনী ফুলগাছটির নিচে গিয়ে দাঁড়াতেন নাজমা। কতটা ভীতি আর কষ্ট মনের মধ্যে চেপে রেখে দিন পার করছেন তা বুঝানো সম্ভব নয়। এমনি সময়ে একদিন রাতে হঠাৎ সানিদ আসেন। সে সময় দেশের পরিস্থিতি খুব খারাপ। যা হোক সানিদ এসেছেন তাই নাজমা তার মা-বাবাকে ওই অবস্থার মধ্যেই বিয়ের কথা বলেন। গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেবকে ডেকে বিয়ে পড়ানো হলো। নাজমা তার আগে থেকেই কিনে রাখা লাল সবুজ শাড়িটা পরলেন। সানিদ খুশি হয়ে বললেন- আহা আমার দেশের লাল-সবুজ পতাকা। তুমি এমন শাড়ি কোথায় পেলে?

নাজমা মুচকি হেসে বললেন- আমি আগে থেকেই কিনে রেখেছিলাম। সে রাতে সানিদ নাজমাকে বলেছিলেন, মন খারাপ করো না। কিছুক্ষণ পরেই আমার চলে যেতে হবে। যাওয়ার আগে দুটো কথা বলে যাই, মনে রেখো।
নাজমা সজল চোখে তাকান স্বামীর মুখপানে। মনভরে প্রাণভরে আর দু’চোখ ভরে দেখেন তার হৃদয়ের মানুষটিকে।
সানিদ আবার বলেন- কি হলো, চুপ করে আছ কেন?
নাজমা চোখ মুছে বলেন- কী বলব বলো।
-হ্যাঁ, বলছি। আমরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছি। একদিন দেশ স্বাধীন করে ফিরে আসব। আমি ফিরি বা না ফিরি স্বাধীনতা আসবে। যেখানে থাকো, সবার সাথে এমন ব্যবহার করো যাতে কখনো কারো স্বাধীনতা ক্ষুণœ না হয়। সব সময় স্বাধীনতা শব্দটিকে সম্মানের চোখে দেখো।
আর সময় নেই। এবার যেতে হবে।
-জানি চলে যাবে। আমার একটি সাধ ছিল।
-বল, যদি পূরণ করতে পারি।
-ছোট্ট একটি মুহূর্ত হবে আমার জন্য।
-হ্যাঁ, বলো।
নাজমা প্রবল উচ্ছ্বাসে স্বামীর দিকে এগিয়ে যান।

আবেগের ভারে তার মাথা নুয়ে পরে স্বামীর বুকের ওপর। ছোট্ট মুহূর্ত পার হতে বেশি দেরি হয়নি। সানিদ সদ্যবিবাহিত স্ত্রীকে ধরে খাটে বসিয়ে দেন। বলেন,
-আর যে সময় নেই প্রিয়া।
দরজায় এগিয়ে যায় দু’জন। একবার ঘুরে তাকান সানিদ। নাজমার চোখের জল মুছে দেয়ার প্রবল ইচ্ছাকে দমন করে বলেন- ভালো থেকো। আসসালামু আলাইকুম।
দ্রুত হেঁটে যান। নাজমার বলা ওয়ালাইকুম আসসালাম, বাক্যটি হয়তো তিনি শুনতেও পান না। খুব তাড়াতাড়ি চোখের আড়াল হয়ে যান। কেটে গেল কয়েকটি মাস। স্বাধীনতা এলো। ফিরে এলেন না সানিদ আবদুল্লাহ। তারপর কেটে গেল কতটা সময়। এখন সেই বাড়িও নেই। সেই কামিনী ফুলগাছটিও নেই। আছে ছোট্ট একটি ফ্ল্যাট আর একটি নির্জন বেলকনি। বেলকনির নির্জন পরিবেশে সাদামাটা চেয়ারটিতে বসে নাজমা পারভিন আজও পথ চেয়ে তার প্রিয় মানুষটির অপেক্ষায়।


আরো সংবাদ



premium cement