২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

আমার প্রথমকালের কবিতা

আমার প্রথমকালের কবিতা -

আমার প্রথম কবিতা কোনটি তা ভুলে গেছি। প্রথম বই তন্দ্রার কোলে হরিণে প্রথম দিকের অনেক কবিতাই বাদ দিয়েছিলাম। সেগুলোর জন্য আমার মমতা আছে, প্রেম নেই। সেই কাঁচা বয়সের লেখা সাধারণত কেউ সঙ্কলনভুক্ত করে না। কবি মরে গেলে, তার জীবনীকার বা যারা তার রচনাসমগ্র প্রকাশ করতে উৎসাহী হন এবং একজন সম্পাদককে নিযুক্ত করেন, তিনি ও তারাই তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করেন কবির প্রথম জীবনের লেখা ও অত্যন্ত দরদ দিয়ে তা মুদ্রণের জন্য পাণ্ডুলিপিতে যুক্ত করেন। আমি মরে গেলে আমার প্রিয়জনরাও এ পথেই এগোবেন বলে আমার ধারণা।
কাঁচা জীবনের লেখা কেন সন্নিবেশিত হয়, তার ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে। কেউ তো আর জন্মেই পাকা লেখক বা কবি হয়ে জন্মান না। তারা তার পরিবেশ-প্রতিবেশের সাথে বেড়ে ওঠেন এবং অভিজ্ঞ হয়ে পাকা কবিতা লিখতে থাকেন। আবার পাকা কবিতা রচনার পর থেকেই সেই কবির চেতনায় ঠুুকরোতে থাকে কাল-মহাকাল। তাদের দাবি আরো বেশি, আরো ঘূর্ণিময় জীবনচক্রের নিপাট বর্ণনা করে কবি যেন হয়ে উঠেন মহাকালের সম্পদ।
মহাকালের সম্পদ হতে কে না চায়?
বিন্দু বিন্দু চাওয়া থেকেই সিন্ধুর মতো গহিন, গভীর অন্তঃস্রোতকবলিত ধারা সৃষ্টি হয়। আমিও কি সে পথেই যেতে চাই না। সবাই চায়। মরে যাওয়ার পর, সেই প্রত্যাশার ইতি, শেষ নিঃশ্বাসের আগ পর্যন্ত কবি চায় একটি নিপাট-নিষ্ঠুর চিত্রকল্প রচনা করে যেতে। তার চোখের তারায় জ্বলতে থাকে অনন্য সব চিত্র সেগুলোকে কল্পনার অস্পর্শযোগ্য সিমিলিতে রূপান্তর করেন। এভাবেই কবি তার সৃষ্টির নমুনাগুলো রেখে যেতে চান।
২.
তাহলে আমার প্রথম কবিতা কোনটি? আমার প্রথম বইয়ের প্রথম কবিতাটি কি জীবনের প্রথম কবিতা? আমার মন বলে না, তা হতেই পারে না।
না, এই নঞর্থক শব্দে আমি
তোমার হৃদয় কাঁপাতে পারি, কিন্তু আমি তা করব না।
আমি তো চোখের কৃষ্ণচূড়া লাল
আর ভোরবেলাকার বাসি হাসি দেখে পচে গেছি।
আমি দেখতে চাই একটি সুন্দর শান্ত কিশোরীর চোখ তোমার চোখে,
শিশুর ঘুমের মতো স্বাস্থ্যকর আলো, আর
জ্যোৎস্না রাতে আমাদের উঠোনে ছেলেমেয়েদের লুকোচুরি খেলা
আমি দেখতে চাই।
( না/ তন্দ্রার কোলে হরিণ/ কবিতা সমগ্র)
অসম্ভব, এমন ম্যাচিউরড কবিতার পঙ্ক্তি সত্তরে আমি লিখিনি। এ কবিতা আরো ক’বছর পরে লেখা। তন্দ্রার কোলে হরিণ যখন প্রকাশের জন্য তৈরি করি, আবিদ আজাদ বলল- আমাকে দাও বের করব। সেটি ’৮২-’৮৩ সাল। কম্পোজ হলো, আমি প্রুফ দেখলাম। কিন্তু ’৮৩-র ফেব্রুয়ারিতে বইটি বেরুলো না। আবিদ বলল, আগামী বছর বের করব। আমি বিশ্বাস করিনি যে, সে বের করবে। তার ওপর চালাকির স্বভাব ছিল। ষাটীয় কবিদের বেশির ভাগের মতোই আবিদের চেতনায় ওই স্বভাব জড়ো হয়েছিল। গোটা সত্তরের দশকে মুক্তধারার রমরমা চলছে। আবিদও তার ঘাসের ঘটনা মুক্তধারায় দিয়ে বের করল, কিন্তু একবারও আমাকে বলল না যে, পাণ্ডুলিপি তৈরি করো। আমি নিজেও খুবই নির্মোহ ছিলাম প্রকাশনার ব্যাপারে। ভেবেছিলাম, আরো সংহত হোক আমার চেতনার ভাব-কল্পনার দড়িদড়া। সত্তরের এক ঝাঁক কবির মধ্যে আমার কবিতার বই সবার পরে বেরিয়েছে।
যাই হোক, সেই অচিহ্নিত কবিতার খোঁজ না করে প্রথম বইয়ের প্রথম কবিতাকেই যদি আমার জীবনের প্রথম কবিতা ধরে নিই, তাতে এমনই ক্ষতি? আসলে কোনো ক্ষতি নেই। ওই সময় ও প্রতিবেশ বিশ্ব আমি নির্মাণ করেছি। কবি সচেতনভাবেই তা সৃষ্টি করেন। আবার অসচেতনভাবেও অনেক সময় কবিতায় সেই সমসাময়িককালের উপাদান এসে হামলে পড়ে।
না, এই কুৎসিত শব্দের ভেতর থেকেই আমার সব
ভালোবাসা পাতাকুড়োনির মতো আমি খুঁটে নিতে চাই,
আমার চাওয়া ফুটপাথের ওই ন্যাংটো শিশুটির চাওয়ার মতোই
সামান্য কিন্তু স্বপ্নিল।
এই পঙ্ক্তিগুলোতে আমি চেয়েছিলাম শব্দের আদি উচ্চারণ ব্যবহার করব। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কারণে আমরা ভাবতাম/আসলে আমি ভাবতাম সেটিই যথার্থ। আমি দেখেছি আমাদের বেশির ভাগ কবিই ফুটপাথ শব্দটিকে লিখেন ফুটপাত। এটি ঠিক নয়। এই বাঙালিকরণ শব্দ রূপকে পাল্টে দেয়। পাথকে পাত লিখতে আমি চাই না, লিখিওনি। আবার আমি পাতাকুড়ানিকে লিখেছি পাতাকুড়োনি। এটি নগরায়িত বোধের কারণে ঘটেছে। নগর আমাদের লোকশব্দের বানান ও ব্যঞ্জনা থেকে সরিয়ে নাগরিক বোধে সজ্জিত ও আলোকিত করতে উৎসাহী। নগরের কবিতার অধিপতিদের প্রভাবও এখানে আছে। আছে তাদের পরামর্শ। তারা মনে করেন বা করতেন নগরচেতনায় যতটা সম্ভব লোকজ শব্দের ব্যবহার কমিয়ে যেন কবি আধুনিক হয়ে ওঠে। আধুনিকতা একটি বোধ ও ধারণা, একটি চৈতন্যশাসিত ও নির্মিত বৈশিষ্ট্য। তবে, কংক্রিট নয়। আধুনিকতার সাথে সমকালীনতাকে এক করে ফেলা বা এ-দুইয়ের মধ্যেকার পার্থক্য নিয়ে তুমুল বিতর্কের যে তর্কাতর্কি তা যেন এক মহা কাজ। আজো এ নিয়ে তর্ক জারি আছে। আবার এই তর্কের সাথে উত্তর আধুনিকতার তর্কও যুক্ত হয়েছে। কিছু চিহ্ন দেখিয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে এটি উত্তর আধুনিকতা। আমরা সত্তরের প্রধান ধারার প্রথম অংশের কবিরা এই তর্কে নিমজ্জিত না হয়ে ভেবেছি কবিতাকে নগ্ন-নির্মম নগর থেকে বের করে নিয়ে যাব লোকবাংলায়। অন্যদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে নয়, নিরেট নিজের বুদ্ধির জোরে এটি আমি ভেবেছি। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে দেখলাম প্রকৃত নগরের ক্ষত ও ক্ষুধার সাম্রাজ্য। ওই সাম্রাজ্যে কবিতার রূপ ও লাবণ্য বৃহত্তর গণজীবনের ছবি আমাদের চেতনায় শুশ্রুষা সৃজন করুক।
আমার শৈশব আর কৈশোর ছিল সেই বালকের
যে বালক গঙ্গা ফড়িংকে এ্যারোপ্লেন এ্যারোপ্লেন বলে পাড়া মাত করত,
সাঁই সাঁই পিছু ধাওয়া করত সারা সন্ধ্যাবেলা
(শৈশব-কৈশোরের গল্প)
এই কবিতায় লোক জীবনের যে ছবি আছে তা যেকোনো পাঠককে উদ্দীপিত করবেই। আবার রোদ্দুর নামের কবিতা ঠিক তার উল্টো বর্ণনা ও চিত্রভাষ্য আছে যা সমকালীন জীবনের ক্ষত থেকে উঠে এসেছে। তবে সেখানে যে প্রতিবেশ বিশ্ব নির্মিত হয়েছে, তাকে কেউ এড়াতে বা অস্বীকার করতে পারবেন না।
চতর্দিকে খা খা করছে রোদ, চতুর গোয়েন্দা সেজে
পরিচ্ছন্ন বৈতালিক বায়ুর সংরাগে যাবে
অতর্কিতে হানাবাড়ি থেকে উঠে আসে তাই,
মুহূর্তে দখল করে আইল্যান্ড, টেলিফোন বুথ,
জেব্রাক্রসিং ও রাস্তার মোড়ে মোড়ে
গোখরোর মতো ফণা তুলে ফুঁসতে থাকে সুন্দরীর চোখে।
এগুলোই আমার প্রথম জীবনের কবিতার খণ্ডাংশ। এখান থেকে খুঁটে নেয়া যাবে আমার সামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চৈতন্যের ডালপালা, যা কখনো সরাসরি কখনো প্রতীকী ব্যঞ্জনায় নির্মিতি পেয়েছে। কবিতা বুঝতে হলে কালিক জীবনের ইতিহাসও তার অনুপুঙ্খ জানা ও বিচার করার কল্পনাশক্তি থাকতে হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement