২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

টানাটানির সংসার

টানাটানির সংসার -

আনোয়ার সাহেব তার মাথার ওপরে ভারি বস্তুর মতো যে জিনিসটি বহন করে চলেছে তা হলো ‘টানাটানির সংসার’।
এ অদৃশ্য বস্তুটি তাকে অভাব নামক যন্ত্রণার সাগরে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে প্রতিনিয়ত।
মাথার ওপরের সেই অদৃশ্য বোঝার সাথে, তার হাতে এখন আরেক বোঝা। ব্যাগভর্তি বাজার-সদাই। ব্যাগ হাতে নিয়ে সে দাঁড়াল আমের দোকানের সামনে। আমের ঝুড়ি থেকে একটা আম তুলে নিয়ে সে দোকানদারকে বলল,
এটা কত টাকা কেজি পড়বে ভাই?
দোকানদার বলল,
পঁয়ত্রিশ টাকা কেজি, পাঁচ-ছয় কেজি নিলে কিছু ছাড় আছে। এটা রতœা আম ভাই। গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি মিষ্টি হবে। পোকা নাই। একটা আমেও পোকা পাবেন না ভাই।
এভাবে কয়েক প্রকারের আম দর-দাম করে সে দেখল রতœা আমটা কেনাই তার জন্য সাশ্রয়। তাই সে পাঁচ কেজি আম কিনল। দোকানদারকে আমের দাম মিটিয়ে দেয়ার পরে সে খেয়াল করল তার পকেটে পঞ্চাশ টাকা অবশিষ্ট।
সে মনে মনে ভাবতে লাগল, আসার সময় ‘নিলু’ দুইশত টাকা দিয়ে বলেছিল এক দিস্তা পেজ নিয়ে বাসায় যেতে। নিলুর দেয়া দুইশত টাকাও যে বাজারের টাকার মধ্যে খরচ হয়ে গেছে। এখন এই টাকা দিয়ে পেজ তো আর কেনা যাবে না। বাসায় যাওয়ার ভাড়া দিলেই তো ফুরিয়ে যাবে। না না,! পাঁচ কেজি আম কেনা ঠিক হয়নি। অন্য একদিন আম কিনলেই হতো। এখন তো আম ফেরতও দেয়া যাবে না। আচ্ছা মুশকিলে পড়লাম তো!
সে মনোস্থির করল পেইজ না নিয়েই বাসায় ফিরবে। জানে মেয়েটা রাগ করতে পারে। তবুও ভাবল বুঝিয়ে বলবে।
রিকশায় উঠল, মাঝ রাস্তায় বাদাম ওয়ালা দেখে দশ টাকার বাদাম কিনল।
দরজা খুলল নিলু। বাজারের ব্যাগ হাতে নেয়ার আগে আনোয়ার সাহেব নিলুর হাতে কাগজে মোড়া বাদামের প্যাকেটটা দিলো। নিলু বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। আনোয়ার সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ার টেনে বসল । তারপর নিলু কে বলল,
নিলু মা, বিকেলে তোমার দিস্তা পেজ এনে দিলে হবে?
হ্যাঁ বাবা। বিকেলে এনে দিও।
নিলু চলে যাওয়ার পরে আনোয়ার সাহেব তার স্ত্রী নার্গিসকে বললেন, বাজারের টাকার মধ্যে নিলুর দিস্তা পেজ কিনতে দেয়ার টাকাটা সে খরচ করে ফেলেছে।
কথাটা শুনে নার্গিস তার পকেটে পাঁচ শত টাকার একটি নোট গুঁজে দিয়ে বলল,
পাশের ফ্ল্যাটের ভাবী জামা-কাপড় সেলাই করার আজুরা দিয়ে গেছে। তুমি এটা রাখো। খরচ কইরো।
শাড়ির দোকানের ম্যানেজার হয়েও মাস মাইনে বারো হাজার টাকা বেতন পায় আনোয়ার সাহেব। সাথে নিজেও সময় পেলে ফুটপাথে বসে টুকটাক শাড়ি বিক্রি করে। সৎ মানুষ। কথাও বলেন কম। তার সংসারে সর্ব সাকুল্যে লোক সংখ্যা ছয়জন।
বউ ‘নার্গিস’ টুকটাক দর্জির কাজ করে। বেশ ভালো জামাকাপড় সেলাই করে সে। বিভিন্ন ফ্ল্যাটের মহিলারা আসে তার কাছে জামা কাপড় সেলাই করতে।
তাদের তিন মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ে ‘নিসা’ এবার অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছে। সাথে ছোট একটা চকরিও করে। এক হাসপাতালের রিসেপশনিস্ট! মেজো মেয়ে ‘নিপা নার্সিং প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে। পড়াশোনার অর্ধেক খরচ তার মামা বহন করে। ছোট মেয়ে নিলু এ বছর অ্যাডমিশন দিবে। পড়াশোনার পাশাপাশি সে একটা টিউশনিও করে। ছোট ছেলে আনাস। পড়ে ক্লাস সেভেনে। এই তো সেদিন, তার স্কুলের বেতন পরিশোধ করতে হলো চার হাজার টাকা। যার কারণে বাজারের টাকাও আজ টানাটানি।
আর এদের সবার মুরুব্বি হলো আনোয়ার সাহেবের 'মা'। বৃদ্ধা মানুষ। একা গ্রামের বাড়ি থাকতে দিবে না বলেই আনোয়ার সাহেব তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। একসময় তার মায়ের সব রকম আবদারও সে পূরণ করতে পেরেছে। এখন আর তেমন পারে না। এই যে বাজার থেকে আম কিনে আনা। সেও তার মায়ের জন্য। অনেক দিন হলো সে বলে,
আনাররে, বাজারে পাকা আম উঠে নাই?
গেরামে ফোন লাগা। তোর চাচারে বল আম পাঠাইতে। শহরের বাড়ি আম কিনা খাওন লাগে আর গেরামের বাড়িতে আম পইচা যাইতাছে। আমার নাতি-নাতনী গো মুখে এখনো পাকা আম পড়ল না।
রাত প্রায় নয়টা বাজতে চলেছে। নার্গিস দেখল আনোয়ার সাহেব গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। নার্গিস জানে মানুষটা কত কষ্ট করে। কত মেহনত করে। তবুও ভাগ্য আগায় না।
নার্গিস তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়ে জিজ্ঞাসা করল,
কী নিয়ে এত চিন্তা করো তুমি?
আনোয়ার সাহেব আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
এই জীবনে টানাটানির সংসার ছাড়া তোমারে কিছুই দিতে পারলাম না নার্গিস।
নার্গিসের বুকটা ধক করে ওঠে। নার্গিস বেশ জোর দিয়ে বলে।
অভাব কি আজীবন থাকবে? আমাদের তিন মেয়ে, এক ছেলে। তাদের এত কষ্ট করে বড় করতেছি তারা কি আমাদের দেখবে না? আর সুখ কী! সুখ কোনো কিছুতেই পাওয়া যায় না। সুখ তো থাকে শান্তির মধ্যে। জানো! আমার সুখ কী? আমার শান্তি কী?
কী?
তুমি,আম্মা, আমার ছেলেমেয়েগুলা ।
হঠাৎ দরজায় দাঁড়িয়ে তাদের বড় মেয়ে নিসা বলল,
আম্মা ভেতরে আসব?
নার্গিস বেগম ভেতরে আসতে বললেন। নিসা দেখল তার বাবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সে তার বাবার কাছে গেল। এরপর বাবার হাত ধরে নিয়ে এসে বিছানায় বসিয়ে বলল।
আমি একটা খুশির খবর আনছি আব্বা।
বলো শুনি, কী খুশির খবর?
আমি ওয়ালটন কোম্পানিতে জব পেয়েছি। প্রতি মাসে বেতন পঁচিশ হাজার টাকা। তোমার সাথে এখন সংসার খরচে আমিও হাল ধরতে পারব। তুমি খুশি হও নাই আব্বা?
আলহামদুলিল্লাহ খুশি হয়েছি। কিন্তু মা নিসা! তুমি তো আমার সংসারের হাল অনেক আগেই ধরেছ। ছোট-ভাই বোনদের খরচ তো তুমি ভালোই দাও। ভুলে গেছ?
না আব্বা আমি কিছু ভুলি নাই। তুমি এত চিন্তাই কইরো না আব্বা। এই বেতন দিয়ে আল্লাহর রহমতে সব হবে।
জয়েন দিবা কবে থেকে?
আগামী মাসের এক তারিখ থেকে।
নিসা চলে গেলে। আনোয়ার সাহেব আবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। তার আকাশ দেখতে ভালো লাগে। আকাশের এক একটা তারা তার কাছে এক একটা চিন্তার উৎস বলে মনে হয়। তার মাথায় হাজার চিন্তা ভর করে । পরিবারের একেকটা মানুষের হাজার রকম অভাব। কেউ মুখে ফুটে বলে। কেউ বলে না। তবুও সে বুঝতে পারে। কখনো কি পূরণ হবে এত অভাব ! তার বাবা বলতেন, মধ্যবিত্ত মানুষের অভাব আজীবনের। আজ এ পরিস্থিতিতে এসে তার এটাই মনে হচ্ছে বারবার। আসলেই, মধ্যবিত্তদের অভাব আজীবনের। এমন টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে চলতে চলতেই জীবন শেষ সীমানায় গিয়ে দাঁড়ায়।


আরো সংবাদ



premium cement
আওয়ামী লীগকে ‘ভারতীয় পণ্য’ বললেন গয়েশ্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে দাগনভুঞার যুবক নিহত কাশ্মিরে ট্যাক্সি খাদে পড়ে নিহত ১০ অবশেষে অধিনায়কের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছল পাকিস্তান জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থাকে আবার অর্থায়ন শুরু করবে জাপান শেখ হাসিনার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি বিএনপিকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে : ওবায়দুল কাদের রাশিয়া সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টে ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে সিরিয়ায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৩৬ সেনা সদস্য দৌলতদিয়া ঘাটে পন্টুন থেকে নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু অ্যানেসথেসিয়ার পুরনো ওষুধ বাতিল করে কেন নতুনের জন্য বিজ্ঞপ্তি! বাইডেনের মেয়াদে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতির কোনো আশা নেই : রুশ রাষ্ট্রদূত

সকল