২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘আত্মস্বার্থ বিচ্ছিন্ন করছে আমাদের’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জন্ম : ৭ মে ১২৬৮, মৃত্যু : ৭ আগস্ট ১৯৪১ -

শিল্প-সাহিত্য-সমাজ, কৃষি-রাজনীতি-জীবনাচার, আনন্দ-বিষাদ, পূর্ণতা-অপ্রাপ্তি, সমস্যা ও সম্ভাবনা- সর্বত্রই যেন তার চিন্তার সরল বিচরণ। সমকালে যেমন উত্তরকালেও তাই তিনি সমান প্রাসঙ্গিক। মানুষের জন্য, সুন্দরভাবে জীবনযাপনের শিল্পকলা আয়ত্ত ও চর্চা করার জন্য তার অনুভূতি এবং ব্যবস্থাপনা আমাদের জন্য বিরাট প্রেরণার উৎসভূমি। বিশ্বমানবতা এবং শান্তির প্রতি রবিবাবুর অমিত ইচ্ছা ও সাধনার পরিচয় বহন করছে অনুকরণীয় বিশ্ববিদ্যালয় ‘শান্তি নিকেতন’। এই প্রতিষ্ঠানটি কেবল শিক্ষার ক্ষেত্রে নয়, সারা পৃথিবীর সব দেশের সব ভাষা-সংস্কৃতির মানুষের সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের তীর্থভূমি। জ্ঞানের সাথে ভালোবাসার, সাধনার সাথে সম্মানের সংযোগ না থাকলে যে মানবিক বৃত্তির বিকাশ কিংবা প্রকাশ কোনোটাই সম্ভব নয়, তা রবীন্দ্রনাথের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। আর চিন্তার বড়ত্বের কারণেই তিনি দুনিয়াজোড়া খ্যাতি অর্জন করতে পেরেছেন। বাঙালিকে তিনি বিশ্ব দরবারে সম্মানের জায়গায় নিয়ে দাঁড় করাতে পেরেছিলেন তার বিশ্বমনস্ক মানবিকতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার বাসনার কারণে। শিক্ষা-শান্তি ও মানবতা প্রতিষ্ঠায় তিনি যেমন হাত পেতেছেন সবার কাছে, তেমনি সবাই তার দিকে হাত প্রসারিতও করেছেন। সভ্যতার সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য তার যে আকাক্সক্ষার কথা আমরা জানি, তা তার বিশেষ অভিজ্ঞানেরই বহির্প্রকাশ মাত্র। রাজনীতিতে বাম-ডান পেরিয়ে জ্ঞানপন্থায় আস্থা অর্জনের যে নীতিতে বিশ্বাস করেন সাম্প্রতিক সময়ের পেরুর তথা বিশ্বের সেরা সাহিত্যিক মারিও ভার্গাস য়োসা, সেই আলোয় অনেককাল আগেই স্নাত হয়েছেন ‘আমাদেরই লোক’ রবীন্দ্রনাথ।

নোবেল বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ‘এক জাতির সাথে অন্য জাতির, এক ব্যক্তির সাথে অন্য ব্যক্তির সঙ্ঘাত হওয়ার মধ্যে নয়, মানুষের কর্তব্য হচ্ছে একের সাথে সৌভ্রাত্র আর শান্তির সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য কাজ করে যাওয়া, বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার বন্ধন পুনরুদ্ধার করা। আমরা তো হিংস্র পশু নই। এখন আত্মস্বার্থ আমাদের জীবনকে অধিকতর প্রভাবিত করছে, এই আত্মস্বার্থই আমাদের বিচ্ছিন্ন করছে, দুঃখ দিচ্ছে, হিংসা ও ঘৃণাবোধের জন্ম দিচ্ছে, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলছে।’ আজকের বিশ্বে সিরিয়া-ইরাক-মিসরে যে অশান্তি, আফগানিস্তানে মানবতার যে বিপর্যয়, ফিলিস্তিনের সাথে ইসরাইলের যে বিরাট-ব্যাপক সমস্যা, তার ভেতরে প্রবেশ করতে গেলে রবীন্দ্রনাথের ওই বক্তৃতা যেন আবার নতুন করে আমাদের মনে করতে হচ্ছে। ফিলিস্তিনে আজ ‘প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন শেষ নিঃশ্বাস’! বিশ্বরাজনীতির এই বাণিজ্যিকীকরণের ফলে আজকে আমরা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি? আমাদের ভেতরে কী সব অসম্ভব পশুত্ব আশ্রয় গেড়ে বসেছে ভাবলে শরীর শিউরে ওঠে। অসহায় নারী, বৃদ্ধ ও শিশুরা জানেও না তারা কেন মারা যাচ্ছে, কী তাদের অপরাধ। বিশ্ব নেতারা শান্তির জন্য সম্মেলন করেন সারা দুনিয়া ঘুরে ঘুরে। বার্তা ও দূত পাঠান দেশে দেশে ও দ্বারে দ্বারে। কিন্তু তারা কি এই অমানবিকতা ও অশান্তির স্থায়ী কোনো সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে পেরেছেন? শিশুর জন্য কি নিরাপদে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা তৈরি করতে পেরেছেন? বিশ্বজুড়ে গড়ে উঠেছে সেবা ও সমাজকল্যাণমূলক বহু প্রতিষ্ঠান। তারা দুর্গত মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আমরা কি চাই? সাহায্য? নাকি শান্তি? শান্তি প্রতিষ্ঠা হলে সাহায্যের কী প্রয়োজন? তাই, শান্তির প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথের মতো ‘মানবশিশুর জন্য মুক্তি আর আনন্দের দ্বার খুলে দেয়ার’ প্রত্যয় নিয়ে আমাদেরকে সমবেতভাবে কাজ করতে হবে।

১৮৯৪ সালের ১৬ জুন রবীন্দ্রনাথ স্নেহভাজন প্রমথ চৌধুরীকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন : ‘ইংরাজগুলো যে রকম অসহ্য অহঙ্কারী এবং উদ্ধত হয়ে উঠছে তাতে একটা কিছু হওয়া নিতান্ত উচিত- চুপচাপ করে পায়ের তলায় পড়ে পড়ে মার খাওয়াটা নিতান্ত অন্যায়।’ আমরা যাকে বলি অসহায়তা, রবীন্দ্রনাথ তাকে বলেছেন অন্যায়। কাজেই অসহায়তার দোহাই দিয়ে হয়তো সান্ত্বনা পাওয়া যায়, শান্তি তো মেলে না। জীবনের অন্তিমপর্বে ‘সভ্যতার সঙ্কট’ নামক নিবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বৈশ্বিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে যে গভীর, সংহত, নিরাসক্ত বিবেচনাবোধের পরিচয় রেখেছেন, তা আজো আমাদের জন্য বিরাট অনুপ্রেরণা ও শিক্ষার জায়গা হয়ে আছে। এই নিবন্ধটি একটি লিখিত ভাষণের প্রকাশিত রূপ। ১৯৪১ সালের ১৪ এপ্রিল তার লেখা এই সর্বশেষ ভাষণটি অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতিতে পাঠ করে শোনান ক্ষিতিমোহন সেন। প্রবন্ধের শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের জানাচ্ছেন, ‘আজ আমার বয়স আশি বৎসর পূর্ণ হলো, আমার জীবনক্ষেত্রের বিস্তীর্ণতা আজ আমার সম্মুখে প্রসারিত। পূর্বতম দিগন্তে যে জীবন আরম্ভ হয়েছিল তার দৃশ্য অপর প্রান্ত থেকে নিঃসক্ত দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি এবং অনুভব করতে পারছি যে, আমার জীবনের এবং সমস্ত দেশের মনোবৃত্তির পরিণতি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে।’ এখানে রবীন্দ্রনাথ যে দ্বিখণ্ডের কথা বললেন, জ্যাক দেরিদার মতো মনীষী পরবর্তীকালে একেই ‘দ্বিবৈপরীত্য’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। একদিকে অনুরাগ, অন্যদিকে বিবেচক অভিজ্ঞান- এই দুইয়ের সঙ্ঘাত ও সংশ্লেষের ভেতর দিয়েই দ্বিধাগ্রস্ত মানুষের চলাচল।
তাই মানুষকে বিপন্নতা থেকে উদ্ধার করার জন্য তিনি এক মহামানবের আগমনের অপেক্ষা করেছিলেন। কবি রবি বলেছিলেন, ‘ওই মহামানব আসে’।
বিশ্বমানবতার এই ভয়াবহ বিপন্নতার কালে রবীন্দ্রনাথ কল্পিত ও কথিত ওই মহামানবের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের সামনে আর যেন কোনো বিকল্পই নেই। ওই অভিভাষণের শেষপ্রান্তে তিনি বলেছেন : ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এ পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।’ শান্তি-সম্প্রীতি আর সহাবস্থানের জন্য বড় বেশি প্রয়োজন পারস্পরিক বিশ্বাসের।

যেখানে বিশ্বাসের অভাব, সেখানে রাজনীতিই বলি আর সমাজনীতিই বলি কোনোটাই কাজে আসবে না।
মানুষের প্রয়োজনেই যদি এত সব কিছুর আয়োজন, তাহলে এসবের বিনিময়ে কিংবা বিপরীতে মানুষকে কেন প্রাণ দিতে হবে? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই প্রবল প্রবাহের মধ্যে তাহলে কি আমাদের সমূহ আবেগ মরে গেছে? নবজীবনের আশ্বাস আমরা কবে শুনতে পাব।
আজ থেকে ১০০ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ তার নোবেল ভাষণের প্রায় শেষ প্রান্তে মানবজাতির শান্তির জন্য বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন : ‘আমাদের আরো গভীরে যেতে হবে। আমাদের আবিষ্কার করতে হবে ঐক্যের কোনো গভীরতম ভিত্তি, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যা আত্মিক ঐক্য গড়ে দেবে। মানুষের চেতনার গভীর আমাদের অনুসন্ধান করতে হবে, খুঁজে বের করতে হবে মানবজাতির সমস্ত ধরনের জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে মহান ঐক্যের কোন ধরনের বন্ধন কার্যকর। আর এই কর্তব্য সম্পাদনের যথার্থ যোগ্যতা আমাদের রয়েছে। আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের অবিনশ্বর কৃতির উত্তরাধিকারী, সেসব মহান ঋষি যাঁরা ঐক্য আর সংবেদনের ধর্ম প্রচার করে ঘোষণা করেছিলেন : যে সর্বভূৎকে আত্মবৎ মনে করে, যে সর্বজীবকে আত্মবৎ উপলব্ধি করে, সেই যথার্থ সত্যদ্রষ্টা।’ তার ভাবনা এবং প্রত্যক্ষ কর্মসূচি বিশ্বমানবতার জন্য বিশেষ বারতা হয়ে থাকবে আরো বহুদিন।

 


আরো সংবাদ



premium cement