২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
মোশাররফ হোসেন খানের কবিতা

প্রলম্বিত দৃষ্টিসীমার স্মারক

-

বাংলা কাব্যপ্রতিভার রূপকার মোশাররফ হোসেন খান। জন্মগ্রহণ করেছেন যশোর জেলায়। সাহিত্য রচনায় পারঙ্গম এই লেখক জগৎসংসারকে করেছেন সাহিত্যের উপজীব্য। বিশ্বাসী মানুষের চেতনায় তিনি দেখেছেন পার্থিব জীবনকে। আর সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে বর্ণনা করেছে কাব্যের চরণে। বৈশ্বিক বিষয়ে মোশাররফ হোসেন খানকে খুঁজতে গিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন কবি হেলাল আনোয়ার। নাম দিয়েছেন ‘মোশাররফ হোসেন খান কবিতার কালপুরুষ’। এ গ্রন্থে হেলাল আনোয়ার বলেন- ‘তাঁর দৃষ্টিসীমা এতই প্রলম্ব যে অনেকেই তাঁকে শুধু স্বাপ্নিক বলে ভাবতে পারেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ স্বাপ্নিক নন। বরং বাস্তবতার নির্মল পাটাতনে তাঁর স্বপ্নযাত্রা অতি উজ্জ্বল অতি দীপ্তিময়। তিনি প্রেম বলতে বোঝেন- যে প্রেমবঞ্চিত মানুষের মাঝে হাসি ফোটাতে পারে। নির্যাতিত মানুষকে বাঁচার পথ দেখায়। যে প্রেমের কারণে বাস্তবতার সব রূঢ়তাকে দূরে ঠেলে স্বপ্ন দেখাতে শেখায়। এ জন্য কবি খান তাঁর কবিতায় মানবিক শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ঘোষণা দিয়েছেন। পৃথিবীকে সব রুদ্রতার গ্লানি থেকে মুক্ত করে, সব হিংস্রতা আর নৈরাজ্য থেকে মুক্ত করে একটি শান্তির শামিয়ানা টানতে চান।’ কবি হেলাল আনোয়ারের এ মূল্যায়নের যথার্থতা অনুভব করা যায় কবি মোশাররফ হোসেন খানের কবিতা পাঠে। তিনি লিখেন-
‘হে বৃষ্টি!/ তুমি শস্যদানার মতো/ মানুষের হৃদয়ে বপন করে যাও / তোমার মানবিক বীজ / যেন তোমার প্রতিটি বিনম্র বীজ / তার আচ্ছাদন ভেদ করে / নির্মাণ করতে পারে / বৃষ্টিস্নাত সুশীতল / বাসযোগ্য একটি / মানবিক পৃথিবী!’
(বৃষ্টি ও বিনম্রতা, কবিতাসমগ্র-২)।
কবি মোশাররফ হোসেন খানের কাব্যচর্চার উদ্দেশ্য মানব জাতির জন্য স্বস্তি প্রতিষ্ঠা। সে লক্ষ্যে কবি তাঁর কবিতায় ভাবের দ্যোতনায় দৃষ্টি দিয়েছেন গভীরভাবে। আপন ভঙ্গিমায় কবিতার আঙ্গিককে করেছেন স্বতন্ত্র। ভিন্ন এক মাত্রার পার্থিব ভাবের ব্যঞ্জনাকে নিয়ে গেছেন কাব্যপ্রেমীদের দোরগোড়ায়। তাঁর এ চেতনা ধরা পড়েছে এভাবে-
‘পৃথিবীরও ছিল এক হরিৎ হৃদয়।
দিনে দিনে ভেঙে গেছে সেই অন্তরার পাড়।
দুঃখী রমণীর মতো
এখন তো কেবলই কাঁদে বিপন্না পৃথিবী।
ক্রন্দনরত ঐ পৃথিবীকে দেখেনি তো কেউ কোনো দিন।’
(হৃদয় দিয়ে আগুন, কবিতাসমগ্র-১)
পৃথিবীর বিপন্নতা, বিষণœ পৃথিবীর নিভৃত কান্না, পৃথিবীর হৃদয়ক্ষরণ দু-একজন ছাড়া সবাই দেখতে পান না। যারা দেখতে পান সেই দু-একজনের একজন কবি মোশাররফ হোসেন খান। তিনি জীবন ও জগৎ সম্পর্কিত দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আনন্দ-বেদনায় মিশে গিয়ে বাংলা কবিতার স্তবক সাজিয়েছেন নিয়ত অবিরত। পুঁজিতন্ত্রের অস্থির বাজারব্যবস্থা যখন সমাজকে সমাজের মানুষকে কাহিল করে তুলেছে সেই সময়ে দাঁড়িয়ে মোশাররফ হোসেন খান কবিতায় রচনা করলেন শাশ্বত সত্যের প্রেরণা। আহ্বান করলেন পুঁজিবাদের ঐন্দ্রজাল ভেদ করে বেরিয়ে আসতে। তিনি লিখলেন-
‘আর তাই ঝড় আসুক/ বারবার / ঝড় আসুক / পৃথিবীর আগামী বংশধরদের জন্যও / কল্যাণময়ী এই ঝড়’ (ঝড়, কবিতাসমগ্র-১)।
পৃথিবীকে অনেকেই রহস্যময় বলে থাকে। গভীরভাবে ভাবলে বোঝা যাবে আসলে পৃথিবীতে রহস্যের কিছু নেই। পৃথিবীর সব কিছুকে আল্লাহ পরিষ্কার করে পরিবেশন করেছেন মানুষের জন্য। আল্লাহর কৌশলকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়ে পৃথিবীকে রহস্যময় বলা হয়। আল্লাহ ঘোষণা করেছেন- জীবজন্তু, বৃক্ষলতা, পাহাড়পর্বত সাগরনদীর শীর্ষে রয়েছে মানুষ। মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্টি করা হয়েছে আসমান জমিন গ্রহ নক্ষত্র চন্দ্রসূর্য। মানুষকে সম্মানিত করবার জন্য পৃথিবীর সব সৃষ্টিকে করা হয়েছে মানুষের অনুগামী এবং মানুষের প্রতি অবনত। বুদ্ধির বিবেচনায় পৃথিবীর প্রধান ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জীবাত্মাও মানুষ। সুতরাং পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র সম্মান পাওয়ার যোগ্য। মানুষকেও বলা হয়েছে মানুষকে সম্মান করতে। মানুষের অমর্যাদা মানে সৃষ্টিকর্তার অমর্যাদা। এটি ধর্মেরও মূল বাণী। ইতিহাস সাক্ষ্য, পৃথিবীর বহু সমৃদ্ধ মানবগোষ্ঠীকে আল্লাহ ধ্বংস করেছে শুধু মানুষকে অসম্মান করার কারণে। কাজেই মানুষের জন্য মানুষই সব কিছু। অন্তর্দৃষ্টি ও উপলব্ধির সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা পৃথিবীকে রহস্যময় বলি। কিন্তু মোশাররফ হোসেন খান পৃথিবীর তথাকথিত রহস্য ভেদ করেছেন। তিনিও উপলব্ধি করেছেন পৃথিবীর একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ সোপান মানুষ। তাই তিনি তার ‘সাক্ষাৎকার’ কবিতায় বললেন-
আপনার প্রিয় বিষয় কী?
মানুষ, মানুষ এবং মানুষ।
মানুষ অর্থ আমি। আমি অর্থ তাবত বিশ্ব।
আপনার ঘৃণার বিষয়?
মানুষ, মানুষ এবং মানুষ।
(আরাধ্য অরণ্যে, কবিতাসমগ্র-১)।
অন্য দশটা মানুষ পৃথিবীকে যেভাবে দেখেন, যেভাবে বোঝেন, কবি মোশাররফ হোসেন খান দেখেন তা থেকে আলাদাভাবে। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে পৃথিবীতে এখন বিষবাষ্প ভেসে বেড়াচ্ছে। সেই বিষবাষ্প কিছু মানুষের নিঃশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসছে। পরিমাণে খুব অল্প মানুষ নিজেকে শ্বাপদে, শকুনে, হিংস্রতায় মোড়িয়ে হয়ে উঠেছে নৃশংস। এই নৃশংস মানুষদের তাণ্ডবে শোকবেদনায় পৃথিবী হয়ে যায় মুহ্যমান। মানুষের আর্তনাদে বাতাস ভারী হয়ে আসে। পৃথিবীতে বহমান সেসব কদর্যকে কবি তার কবিতাতে ধারণ করেছেন এভাবে-
‘পৃথিবী উপচে পড়ে বিষণœতা, শকুনের ডাক
চোখের ওপর মেঘ, মাথার উপর কালো কাক
দূর থেকে ভেসে আসে ভয়ঙ্কর মৃত্যুর সঙ্গীত
জনপদ লোকালয়ে ছেয়ে যায় শোকের ইঙ্গিত।’ (কবিতাসমগ্র-১)
এত অল্প সময়ে মোশাররফ হোসেন খানের কাব্যপ্রতিভার মূল্যায়ন খুব কষ্টকর। সময়ের ব্যবধানে এ কৃতিমান কবি মানুষের মনে স্থান করে নিবে আপন যোগ্যতায় ॥

 


আরো সংবাদ



premium cement