১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্মৃতিতে অম্লান : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি

আবদুল মান্নান সৈয়দ
-

১৯৪৩ সালের ৩ আগস্ট পশ্চিম বাংলায় জন্মগ্রহণ করেন আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক, নজরুল গবেষক, ঔপন্যাসিক, কথাশিল্পী, নন্দিত গদ্যশিল্পী আবদুল মান্নান সৈয়দ।
২৪ বছর বয়সে তাঁর এক অসাধারণ এবং অনতিক্রম্য কাব্যগ্রন্থ ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ (১৯৬৭) প্রকাশিত হয়। যদিও তিনি কিশোর বেলা থেকেই কবিতা লিখতেন।
তাঁর সাথে আমার দীর্ঘ ২৫ বছরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এ সম্পর্ক সাহিত্যের কারণে, কবিতার কারণে।
১৯৮৫ সাল থেকে ২০১০ এই কালখণ্ডে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল নিবিড়। সাহিত্যের আড্ডা, চায়ের আড্ডা থেকে গ্রিনরোডে তাঁর বাসায় আমার একান্ত যাতায়াত ছিল।
সপ্তাহে একদিন দেখা না হলে তিনিই আমাকে ফোন করতেন, মোবাইলে কথা বলতেন। বাসায় যেতে বলতেন। তিনি সাধারণত সবার সাথে মিশতে পছন্দ করতেন না। তাঁর বাসায়ও সবাই যাওয়ার সুযোগ পেত না। তিনি যেমন ছিলেন রাশভারী, তেমন দিলখোলা। চায়ের আড্ডায় কিংবা বাসায় কোনো আলাপ আলোচনা প্রসঙ্গে হো হো করে হাসতেন। তাঁর হাসির মধ্যে একটি চন্দ্র জোছনার মাধুর্য ছিল, নান্দনিকতা ছিল। আমি তাঁর ছাত্রতুল্য। তার সরাসরি ছাত্র- জগন্নাথ কলেজের বাংলার ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক, নাসির হেলাল আমার কাব্যসতীর্থ সে হিসেবে তাকে আমি স্যার সম্বোধন করতাম। আমার কবিতা তিনি খুব পছন্দ করতেন।
তিনি স্যুররিয়ালিস্টিক কবি, নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষাপ্রবণ কবি। আমি প্রথম থেকে একটু আলাদা প্রকৃতির কবিতা লিখতাম। বিজ্ঞান, পরাবাস্তবতা, মোজেজাবিষয়ক কবিতা লিখতে আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম। স্যার এ কারণে আমার কবিতা পড়তেন। বিভিন্ন সাহিত্য সভায় আমি স্যারের সাথে যুক্ত হতাম আলোচক হিসেবে।
স্যার আমার আলোচনাও পছন্দ করতেন। তিনি আমার কবিতা প্রসঙ্গে কথা বলতেন। আমার ওপর প্রবন্ধও তিনি লিখেছেন।
জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ ঢাকার বিভিন্ন সাহিত্য সভায়, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে আমি তাঁর সাথে বিভিন্নভাবে যুক্ত হতাম। কখনো আলোচক, কখনো পাঠক হিসেবে কয়েক শ’ অনুষ্ঠানে তাঁর সাথে আমি যুক্ত হয়েছি।
সত্তর দশকের প্রখ্যাত ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক সাজজাদ হোসাইন খানের সাথে স্যার অনেক অনানুষ্ঠানিক আড্ডায়, সাহিত্য সভায় মিলিত হয়েছেন।
‘হাসান আলীমের কবিতা’ শিরোনামে তিনি আমার ওপর একটি অসাধারণ প্রবন্ধ লেখেন। এটি একটি জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য পাতায় ৩ জুলাই ১৯৯২ ছাপা হয়।
আমার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘সবুজ গম্বুজের ঘ্রাণ’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে। এর প্রকাশনা উৎসবে আবদুল মান্নান সৈয়দ ছিলেন প্রধান অতিথি। তিনি ওই অনুষ্ঠানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমার ওপর এই প্রবন্ধটি পাঠ করেন। এটি ছিল আমার জীবনের একটি বড় পাওয়া।
তিনি অনুষ্ঠানে প্রথমে বলেছিলেন, আমি তরুণ কবিদের সম্পর্কে লিখি না। আমাকে কেউ কারো সম্পর্কে লেখাতে পারে না। আমার একটি পছন্দ থাকে কার সম্পর্কে লিখব। হাসান আলীমের কবিতা আমাকে আকর্ষণ করে, আমার ভালো লাগে। সেই থেকে এ লেখা। এরপর তিনি প্রধান অতিথির বক্তব্যের পরিবর্তে এই প্রবন্ধ পড়েন।
এর কয়েক মাস পর তিনি আমার ওপর লেখা এই প্রবন্ধটি ঢাকা বেতারের একটি সাহিত্য ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে পাঠ করেছিলেন। এটিও প্রচারের এক-দুদিন আগে তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন।
১৯৯৩ সালে তাঁর বিখ্যাত সনেট গ্রন্থে সকল প্রশংসা তাঁর প্রকাশ পায়। আল্লাহ, রাসূল সা: ও অধ্যাত্মবিষয়ক এই সনেট কাব্য। এ গ্রন্থটির প্রথম সংস্করণ আমাদের কয়েক তরুণ কবিকে উৎসর্গ করেছিলেন। এঁরা হলেন মতিউর রহমান মল্লিক, হাসান আলীম, বুলবুল সরওয়ার ও অপর একজন। এটি আরো কয়েক সংস্করণ বের হয়েছে।
উল্লেখ্য, এর আগে তাঁর পরীক্ষামূলক সনেট গ্রন্থ ‘আমার সনেট’ (১৯৯০) বের হয়েছে।

২.
অনেক সাহিত্যসভা ও সাহিত্যবিষয়ক আড্ডা হয়েছে তাঁকে ঘিরে। এ সব সাহিত্য আড্ডার কোনো কোনোটিতে কবি আল মাহমুদ, কবি আবদুস সাত্তার, নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ, আফজাল চৌধুরী এবং সানাউল্লাহ নূরী ভাই প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতেন।
কবি আল মাহমুদ ও কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের মধ্যে কাব্য বিষয়ে একটি ঠাণ্ডা লড়াই ছিল। কোনো কোনো সময়ে তিনি আল মাহমুদ উপস্থিত থাকলে যেতে চাইতেন না। আবার কখনো কখনো যেতেন।
আমি কখনো কখনো সাহিত্যসভার আগে বা অন্য কোনো সময়ে স্যারের বাসায় যেতাম। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে স্যারের গ্রিনরোডের বাসা ছিল সবুজ বাগান, ফল-ফলাদি বৃক্ষ আচ্ছাদিত চার-পাঁচ তলা অট্টালিকাময়। এখন সেটি বহুতল ভবন। এটি স্যারের পৈতৃক বাড়ি।
কলকাতা থেকে তাঁর বাবা সৈয়দ বদরুদ্দোজা সাহেব পাকিস্তান সৃষ্টিলগ্নে ঢাকায় স্থায়ীভাবে চলে আসেন।
স্যারের বাসায় যেদিন যেতাম সেদিন তিন-চার ঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে যেত।
আমি বাসায় ঢুকলেই স্যার খুশিতে ভাবীকে ডেকে বলতেন- এই রানু, হাসান আলীম এসেছে,
ও আজ খেয়ে যাবে। ভাবী এসে কুশলাদি বিনিময় করে ভেতরে চলে যেতেন এবং খাবার তৈরির আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে যেতেন।
উল্লেখ্য, ভাবী সাধারণত অনাত্মীয় কারো সামনে যেতেন না। স্যারও সম্ভবত তা চাইতেন না কিন্তু স্যার আমাকে তার ছোট ভাইয়ের আসনে বসিয়েছিলেন তাই এমন আত্মার সম্পর্ক!
কোনো কোনো দিন আগেই ভাবীকে বলে রাখতেন আমার আপ্যায়নের কথা। শেষ দিকে তিনি আমাকে কেমন যেন ভক্তি মিশ্রিত স্নেহে আদৃত করতেন। আমি এতে কিছুটা সঙ্কোচ বোধ করতাম।
তিনি ছিলেন পিতামাতা ভক্ত প্রাণ।
সৈয়দ বংশের গাম্ভীর্য ও কৌলিন্য ছিল তাঁর রক্তে কিন্তু কোনো অহঙ্কার ছিল না।
তিনি ধর্মভীরু ছিলেন কিন্তু কোনো গোঁড়ামি তাঁর মধ্যে দেখিনি।
রাজনীতি তিনি পছন্দ করতেন না। এ সম্পর্কে কোনো মতামতও তিনি দিতেন না।
তাঁর লেখায় বিশেষত কবিতায় পরাবাস্তবতা, বিমূর্ত ভাব, সাম্যবাদ ও ইসলামপ্রিয়তা ছিল।
তিনি কবিতায় ও গদ্য রচনায় একটি আলাদা বাক্যগঠন প্রকরণ নির্মাণ করেছিলেন। তার ভাষাবয়ন রীতিকে অনেকে মান্নানীয় স্টাইল বলেছেন।
আবদুল মান্নান সৈয়দ বাংলা সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক। তিনি প্রায় দুই শতাধিক গ্রন্থের জনক। তিনি একাধারে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, জীবনী, স্মৃতিকথা, কাব্য নাটক, গ্রন্থ সম্পাদনা ও পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন।
তিনিই বাংলা সাহিত্যে এককভাবে পরাবাস্তব কবিতা গ্রন্থ রচনা করেছেন প্রথম। জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ (১৯৬৭), পরাবাস্তব কবিতা (১৯৮২), মাছ সিরিজ (১৯৮৪) তার সম্পূর্ণ পরাবাস্তববাদী কবিতা গ্রন্থ।
তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক ছোটগল্পও রচনা করেছেন। এর মধ্যে- সত্যের মতো বদমাশ (১৯৬৮) উল্লেখযোগ্য।
তিনি আমাদের বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রমী কবিতা ও ছোটগল্প রচনা করে অমর হয়ে আছেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement
জাতিসঙ্ঘে ফিলিস্তিনি সদস্যপদ লাভের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে ডায়রিয়া হিটস্ট্রোক মাছ-ডাল-ভাতের অভাব নেই, মানুষের চাহিদা এখন মাংস : প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতেই আলু নিয়ে হুলস্থূল মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এত শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি বুঝতে পারেনি ইসরাইল রাখাইনে তুমুল যুদ্ধ : মর্টার শেলে প্রকম্পিত সীমান্ত বিএনপির কৌশল বুঝতে চায় ব্রিটেন ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট আজ নিষেধাজ্ঞার কারণে মিয়ানমারের সাথে সম্পৃক্ততায় ঝুঁকি রয়েছে : সেনাপ্রধান নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে বিএনপি : কাদের

সকল