২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

জীবনের টুকরো স্মৃতি

জীবনের টুকরো স্মৃতি -

বর্ষাকালে যখন বাড়ির সামনেএকটু একটু পানি আসতো আমরা তখন আনন্দে মেতে উঠতাম। প্রতিদিন সকালে উঠে দেখতাম পানি কতটা বেড়েছে। পানি বেশি হলে আমার আব্বা কাঠের বড় চওড়া টুকরো দিয়ে ঘাট বেঁধে দিতেন। কী মজাই না হতো। আমার আব্বা দারুণ সাঁতার কাটতে পারতেন। অফিসে যাওয়ার আগে বর্ষার সে পানিতে আব্বা সাঁতার কাটতেন। আমরা দেখে খুব মজা পেতাম। বর্ষার পানিতে আমরা ভাইবোনেরা খুব মজা করে গোসল করতাম। পানির মধ্যে খেলতাম কিন্তু বেশিক্ষণ পানিতে থাকার উপায় ছিল না। আম্মার বকুনির ভয়ে তাড়াতাড়িই উঠতে হতো। বর্ষার সময় রাস্তাঘাটে পানি জমে থাকতো। তখন আব্বা স্কুলে যেতে দিতে চাইতেন না।
রাতে পড়তে বসলে চোখে ঘুম এসে যেতো। তখন আব্বা বলতেন- যাও শুয়ে পড়। আজ আর পড়ার দরকার নেই। কাল পড়ো।
আম্মা বলতেন- না, এখনো পড়া শেষ হয়নি। যাও মুখ ধুয়ে এসো। মুখ ধুয়ে পড়তে বসতাম আবার ঘুম আসতো। তখন আম্মা আবার বলতেন- সাবান দিয়ে ভালো করে মুখ ধুয়ে নাও। পড়া শেষ না হলে শোয়া যাবে না।
শরৎকালের প্রকৃতি আর নীল আকাশ আমার স্মৃতিপটে আঁকা হয়ে আছে। এই ধুলোবালির শহরে আজ আর শরৎ ওভাবে দেখা দেয় না। শরতের নীল আকাশের ধবধবে মেঘগুলো তুলার মতো ভাসতো। আমরা ভাইবোনেরা মিলে দেখতাম সেই সাদা মেঘের কারুকাজ।
সেই ভালোবাসার বাড়িটাতে একটি শিউলি ফুলগাছও ছিল।

 

আমরা সকালে যে সবার আগে উঠতে পারতাম সে দিন শিউলি ফুল কুড়াতাম। আমার আব্বা আমাকে খুব সুন্দর গোলাপি রঙের একটি ঝুড়ি কিনে দিয়েছিলেন। তখন সচরাচর ওরকম প্লাস্টিকের ঝুড়ি দেখা যেত না। সেই ঝুড়ি নিয়ে শিউলি আর বকুল ফুল কুড়াতে যেতাম। ঝুড়ি ভরে ফুল নিয়ে বারান্দায় বসে মালা গাঁথতাম।
কত কথা মনে পড়ে
তারই সাথে ব্যথা ঝরে অন্তরে।
মনে পড়ে শুধু সে দিনের সুখ
দুঃখটাকে গেছি ভুলে।
ফিরে পেতে চাই সে হারানো দিন
জল ভরে আঁখি কূলে।
জানি না আমার মতো সব মানুষের মনে এমন ব্যাকুলতা আছে কি না। ফেলে আসা শৈশব, মায়ের অনুরাগ ভরা যতœ, বকুনি, বাবার সাথে আহলাদিপনা সে যেন মধুতে মাখা।
সে দিনের হেমন্তকাল আজ যেন হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন। মাঠ ভরা পাকা ধান। আমাদের পাড়ার কৃষক কাকারা আর কৃষাণী কাকীরা সেই সময়ে খুব ব্যস্ত থাকতেন। এত ব্যস্ততার মধ্যেও তাদের চোখে মুখে হাসির ঝিলিক লেগে থাকতো। হেমন্তের সোনালি ফসল, আর ফসল ঘরে তোলার আনন্দঘন ব্যস্ততা সত্যিই সুন্দর, মনোমুগ্ধকর।
আমাদের পাড়ায় একজন হাসেনা ফুফু ছিলেন। তিনি আমাকে সব সময় মা বলে ডাকতেন। আদরের সুরে কথা বলতেন। যদিও তিনি আর পৃথিবীতে নেই। আমাদের পাড়ার লোকগুলো তখন খুব অশিক্ষিত ছিল। কেউ অসুস্থ হলে ঠিক-ঠাক চিকিৎসা হতো না। তাই অনেকেই অল্পবয়সেই বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। একজনের কথা খুব বেশি মনে পড়ে। সে আমাদের বয়সী ছিল। রেজিয়া ছিল তার নাম। ওকে খুব ছোট বয়সেই বিয়ে দেয়া হয়। তখন আমি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। বিয়ের পরেই রেজিয়ার পায়ে একটি ছোট ঘা সবাই লক্ষ্য করল। সঠিক চিকিৎসার অভাবে সেই ঘা বছর খানিকের মধ্যে ক্যান্সারে পরিণত হলো। মৃত্যুর অপেক্ষায় কিছুদিন কেটে গেল। এরই মধ্যে ওর চোখের সামনে ওর স্বামী আবার বিয়ে করল। তার কয়েক দিন পরেই জীবনের সব লীলা শেষ করে সবাইকে মুক্তি দিয়ে চলে গেল। তার জন্য আমার খুব কষ্ট হয়। এমন অনেক মানুষ আমার ছোটবেলার স্মৃতিতে আছে। তাদের কথাও লিখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমার এই বিরাট স্মৃতিক্ষেত্রে বিচরণ করতে গিয়ে পাঠকগণ এতক্ষণে হয়তো বিরক্ত হয়ে উঠেছেন।
একটি সুন্দর সুখকর স্মৃতির কথা মনে পড়ে গেল। একদিন সকালবেলা আমি আর আমার বোন ঘুম থেকে উঠে দেখি, আমাদের ঘরেই আমার দাদাভাই বসে আছেন। তার কোলে একটি ফুটফুটে ছোট্ট সুন্দর ভাই। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমার বোন বুঝেনি। ও বলেছিল, দাদাভাই ঢাকা থেকে ভাই কিনে এনেছে। আমরা দু’জন খুশিতে কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমার বোন খুব লাফালাফি করল কিছুক্ষণ। একটি বিস্কুট নিয়ে ভাইয়ের মুখে দিতে গিয়েছিল। সেই ভাই আস্তে আস্তে বড় হলো। একদিন দেখলাম ভাই দাঁড়াতে পারে। আমি খুশিতে চিৎকার করে সারা বাড়ির মানুষকে জড়ো করেছিলাম, ভাই দাঁড়াতে পেরেছে বলে। ভাই আধো আধো বোলে কথা বলতে শিখল। আব্বা ওর জন্য খুব সুন্দর সুন্দর জামা জুতো কিনে আনতো । ভাইয়ের গায়ের রং ছিল হলদে ফর্সা। ওই সময় ওরকম সুন্দর বাচ্চা চোখে পড়তো না। পড়াশোনা বাদ দিয়ে ভাইকে নিয়ে খেলা করতেই আমার ভালো লাগতো। ছোটবেলায় একটু ডানপিটে ছিল। বিকেলে ওর পিছনে পিছনে দৌড়ে ওকে ধরে এনে হাত মুখ ধুয়ে পরিষ্কার জামা-কাপড় পরিয়ে দিতাম।

 

আমার ছোট দুই বোন ছিল আমার খুব বাধ্য। সবার ছোটটা বেশি বাধ্য ছিল। দুষ্টও ছিল বেশি। ওকে যতটা আদর করেছি, অনেক মেরেছিও। আমিও তো ছোট ছিলাম তাই না বুঝে শাসন করতে গিয়ে ওদের তিনজনকে অনেক মেরেছি। সে কথা মনে করে আজ আমার কাঁদতে হয়। বাড়িতে সবার মধ্যে একজন ছিলেন। আমার দাদাবুজি। খুব সহজ সরল এবং ধার্মিক মানুষ ছিলেন তিনি। সারা দিন সংসারের নানা কাজে ব্যস্ত থাকতেন। উপন্যাস পড়তে পছন্দ করতেন। কায়কোবাদের কবিতার কিছু চরণ তার মুখে মাঝে মাঝে শোনা যেত।
একজন বিশেষ মানুষ ছিলেন আমার জীবনে। আমার নানাবুজি। তিনি আজ নেই। আমার মনে আমার আম্মা আব্বার পরেই তার স্থান তার ভালোবাসা। তার মতো করে আমার কোনো স্বজন এত ভালোবাসেনি। ছোটবেলা থেকেই আমাদের লালন পালন করেছেন অফুরন্ত ভালোবাসা আর আদর দিয়ে। আমার স্মৃতির মাঝারে আমার নানাবুজির মূল্য অনেক বেশি। তার জন্য প্রতিদিন দোয়া না করলে আমার চলে না।
আমার ছোট ফুফু ছিলেন কখনো আমার ফুফু কখনো বন্ধু। তার সাথেই প্রথম স্কুলে গিয়েছি। তিনি পড়াশোনার ব্যাপারে অনেক সহযোগিতা করেছেন আমাকে।
যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম তখন আম্মা পড়াতেন। আমি আম্মাকে খুব ভয় পেতাম। আম্মা যখন পড়তে বলতেন আমি ভয়ে ভুল করে ফেলতাম। আর তখনই আম্মার বকুনি অথবা মাইর জুটতো কপালে। সেদিন কষ্ট হলেও আজ সে স্মৃতি আমার কাছে বড় মধুর। আমার আম্মা একজন আদর্শ মা। তিনি কোনো দিন আমাদের কোনো অন্যায় কাজে প্রশ্রয় দেননি। আদরের পাশাপাশি শক্ত হাতে শাসন করেছেন। আমার আম্মা একজন অসাধারণ মা। ছোটবেলা থেকেই অন্যদের থেকে তার পার্থক্যটা আমি বুঝতে পেরেছি।
আম্মা খুব সুন্দরী ছিলেন। ফর্সা হালকা-পাতলা গড়ন। খাড়া নাক, ডাগর চোখ, কালো সুন্দর ভ্রু-যোগল। কখনো গোলাপি, কখনো হলুদ, কখনো বাসন্তী কিংবা আকাশি রঙের শাড়ি পরতেন আম্মা। শাড়িগুলো তার গায়ে জড়ালে যেন আরো বেশি সুন্দর হয়ে যেত। তিনি মাঝে মাঝে চোখে কাজল পরতেন। ঢিলে করে হাতখোঁপা করতেন। তার সেদিনের সেই মুখটি আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে।
ছোটবেলায় আম্মাকে প্রচুর বই পড়তে দেখেছি। নানা রকমের সেলাই করতেন তিনি। আম্মাই আমার হাতে প্রথম শিশুসাহিত্য তুলে দিয়েছিলেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement