১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘অগ্নিবীণা’র একশ বছর

অগ্নিবীণা লেখার সময়ে নজরুল -

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্য আকাশে সূর্যোজ্জ্বল প্রতিভানক্ষত্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর আশা-নিরাশা বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে বাংলা সাহিত্যে তাঁর দৃষ্টিকাড়া আবির্ভাব। সাহিত্যের সাথে সাথে তিনি রাজনীতি ও সাংবাদিকতার সাথেও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হন। উদ্দেশ্য ছিল ব্যাপক গণজাগরণ, যে জাগরণের মধ্য দিয়ে উপনিবেশ ও সামন্ত শাসন-শোষণ থেকে দেশের ও দেশের মানুষের মুক্তি। এ মুক্তি আকাক্সক্ষার পটভূমিতে রচিত হয়েছে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’র কবিতা সমষ্টি। এটি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ হলেও বিষয় ভাবনা ও শিল্পের নৈপুণ্যে এবং স্বাতন্ত্র্যেও মৌলিকত্বে সর্বশ্রেষ্ঠ, শুধু নজরুল সাহিত্যেই নয়, সমগ্র বাংলা সাহিত্যেও। এতে উৎকীর্ণ হয়েছে তাঁর কাল ও কালোত্তীর্ণ কাব্যপ্রতিভার গাঢ় রঙ স্বাক্ষর। ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে। সে হিসাবে এ বছর ‘অগ্নিবীণা’র শত বছর পূর্ণ হতে চলেছে। ‘অগ্নিবীণা’ কলকাতার ৭ নম্বর প্রতাপ চাটুজ্য লেনের ‘আয্য পাবলিশিং হাউজ থেকে প্রকাশিত। এর মূল্য এক টাকা রাখা হয়। প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মুজাফফর আহমদ জানান, আয্য পাবলিশিং হাউজ প্রকাশক হলেও, প্রকাশক হিসেবে নিজের নাম ছাপেননি, মামলা-মোকদ্দমা হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে। তাই বাহ্যত নজরুল নিজেই ছিলেন তার প্রকাশক। প্রথমবার দুই হাজার ২০০ কপি ছাপা হয়, তা এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। কাজেই বছর না যেতেই এর দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয়। এ সংস্করণেও সমপরিমাণ কপি ছাপা হয়। এ থেকে বোঝা যায়, ‘অগ্নিবীণা’ কী দারুণ সাড়া ফেলেছিল বাঙালি পাঠক সমাজে। পরবর্তীকালে নজরুল ডি এম লাইব্রেরির কাছে অগ্নিবীণার স্বত্ব বিক্রি করে দেন। ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশের পরপরই ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় প্রথম প্রচ্ছদে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়, ‘ধূমকেতু’ সারথি ‘বিদ্রোহী’র সৈনিক কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার বই ‘অগ্নিবীণা’ বের হলো। তাতে বইটির পরিচিতি দেয়া হয় ও উল্লেখ করা হয়, কাজীর সুদৃশ্য ফটোসহ বাঁধাই দাম এক টাকা।
নজরুল তার প্রতিটি গ্রন্থই কাউকে না কাউকে উৎসর্গ করেন। এ উৎসর্গ পত্রেও নজরুলের বিপ্লবী চেতনা সক্রিয়। ‘অগ্নিবীণা’ তিনি উৎসর্গ করেন শ্রী বারীন্দ্র কুমার ঘোষকে। উৎসর্গপত্রে নজরুল লেখেন, ‘ভাঙা-বাংলার রাঙা-যুগের আদি পুরোহিত, সাগ্রিক বীর/ শ্রী বারীন্দ্র কুমার ঘোষ/ শ্রী শ্রীচরণ্যর বিন্দেষু...’। বারীন্দ্র কুমার ঘোষ ছিলেন স্বদেশী যুগের বিপ্লবী (সন্ত্রাসবাদী ব্রিটিশদের ভাষায়)। তাঁকে আন্দামানে নির্বাসন দণ্ড দেয়া হয়েছিল। পরে তিনি সে পন্থা ছেড়ে বৈষ্ণব ধর্ম তথা আধ্যাত্মিকতা অবলম্বন করেন। তা সত্ত্বে¡ও নজরুল তাঁর প্রতি শ্রদ্ধান্বিত ছিলেন। ওই উৎসর্গপত্রে তাঁকে নিয়ে লেখা ‘অগ্নিবীণা’ গীতি কবিতাটি সংযুক্ত করে দেয়া হয়, যা ১৯২০ সালে রচিত ও ‘উপাসনা’ পত্রিকার শ্রাবণ, ১৩২৮ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। আসলে এটি ছিল সে সময়ে বারীন্দ্র্রকে লেখা নজরুলের একটি ছন্দোবদ্ধ পত্র। তাতে বিপ্লবীপন্থা ছেড়ে আধ্যাত্মিকতায় সমর্থিত হওয়ায় তাঁর মৃদু সমালোচনাও করেছেন, ‘অগ্নিহৃষি অগ্নিবীণা তোমায় শুধু সাজে।/তাই তো তোমার বহ্নিরাগেও বেদন-বেহাগ বাজে।/...দুর্বাসা! হে রুদ্রতাড়িত হানছিলে বৈশাখে।/হঠাৎ সে কার শুনলে বেণু কদম্বের ঐ শাখে।’/উল্লেখ্য, নজরুল ছাত্রজীবনে বিপ্লবের দীক্ষা পান স্কুলে তাঁর শিক্ষক নিবারণচন্দ্র ঘটকের কাছে। ১৯২১ সালে ‘ধূমকেতু’র মাধ্যমে তিনি বিপ্লবী ভাবধারা প্রকাশ করেন এবং এ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে বিপ্লবীরা পুনঃউত্থানের চেষ্টা করে। পরিণামে নজরুল গ্রেফতার হন, পত্রিকাটি বাজেয়াপ্ত হয়। ‘অগ্নিবীণা’সহ আরো কিছু গ্রন্থ বাজেয়াপ্তের সুপারিশ করা হলেও শেষ পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়নি।
‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থে সর্বমোট ১২টি কবিতা স্থান পায়। কবিতাগুলো ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়; কিন্তু কবি প্রকাশের কালানুসারে কবিতাগুলো না সাজিয়ে নিজের কাব্যবোধ অনুসারে সাজিয়েছেন। পত্রিকায় প্রকাশের কালানুসারে কবিতাগুলো হচ্ছে : শাতইল আরব (মোসলেম ভারত, জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৭), খেয়াপারের তরণী (ঐ, শ্রাবণ, ১৩১৭), কোরবাণী (ঐ, ভাদ্র, ১৩২৭), মোহররম (ঐ, আশ্বিন, ১৩২৭), আগমনী (উপাসনা, শ্রাবণ, ১৩২৮), রণ-ভেরী (সাধনা, আশ্বিন, ১৩২৮), কামাল পাশা (মোসলেম ভারত, কার্তিক, ১৩২৮), আনোয়ার (সাধনা, কার্তিক, ১৩২৮), বিদ্রোহী (বিজলী, পৌষ, ১৩২৮), প্রলয়োল্লাস (প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৯), ধূমকেতু (ধূমকেতু, শ্রাবণ, ১৩২৯) ও ‘রক্তাম্বরধারিণী ম্য (ধূমকেতু, ভাদ্র ১৩২৯)। দেখা যাচ্ছে, ‘অগ্নিবীণা’ গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্ববর্তী এক/দেড় বছরের মধ্যেই এতে অন্তর্র্ভুক্ত সবগুলো কবিতাই রচিত ও পত্রিকায় প্রকাশিত। তখন কবির বয়স বাইশ-তেইশ বছর। অথচ কবিতাগুলো বিষয় বিন্যাসে ও শৈল্পিক নৈপুুণ্যে অসাধারণ, অভিনব। কবিতাগুলো গ্রন্থভুক্ত করার সময় নজরুল খুব মনোযোগী ও সতর্ক ছিলেন, তাই দেখা যায়, কোনো কোনো কবিতার কোনো কোনো পঙ্ক্তি ও স্তবক সংশোধিত ও বর্জিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার কিছু পঙ্ক্তি ও স্তবক বর্জন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব পরিবর্তন, সংশোধন ও বর্জনের ফলে ওই কবিতাও বেশ অধিকতর সুন্দর ও সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে এবং সেই সাথে নজরুলের কাব্যবোধ, কাব্যপ্রতিভা ও ঔচিত্যবোধের উজ্জ্বল প্রকাশ হয়েছে স্পষ্টতর। স্মর্তব্য, করাচি সেনানিবাসে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের পাঠ এবং তার অব্যবহিত পরে কলকাতার সাহিত্যিক পরিবেশে অবস্থান তাঁর কাব্যচিন্তা সমৃদ্ধ করে। কাব্যজগতে আত্মপ্রকাশ লগ্নে, ১৯২০ সালে রচিত ও সে সময়ে ‘নবযুগে’ প্রকাশিত তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলমান’ শীর্ষক নিবন্ধে তার স্পষ্ট প্রমাণ মেলে; যেখানে তিনি বলেছেন, যে সাহিত্য নি®প্রাণ, নির্জীব ও জড় সে সাহিত্য দিয়ে কোনো উপকার হয় না, সে সাহিত্য স্থায়িত্বও পায় না, সাহিত্যের মুক্তধারায় থাকবে চলার আনন্দ, স্রোতের বেগ, ঢেউয়ের কলতান ও চঞ্চলতা, আর্টের (ধৎঃ) অর্থ সত্যের প্রকাশ বীবপঁঃরড়হ ড়ভ ঃৎঁঃয) এবং সত্য মাত্রই সুন্দর, সত্য চিরমহালময়। আর্টকে সৃষ্টি আনন্দ বা মানুষ এবং প্রকৃতি (সধহ ঢ়ষঁং হধঃঁৎব) ইত্যাদি অনেক কিছু বলা যেতে পারে। তবে সত্যের প্রকাশই এর অন্যতম উদ্দেশ্য। ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের কেন্দ্রীয় বিষয় বিদ্রোহ, বিপ্লব এবং এর মাধ্যমে ঔপনিবেশিক দুঃশাসন ও দেশীয় সামন্ত শোষণ থেকে মুক্তির উদগ্রস্বপ্নাকাক্সক্ষা। এর প্রতিটি কবিতারই নানাভাবে তা মর্মরিত। যুদ্ধোত্তরকালে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী নানা কালাকানুন জারি করে, বাড়িয়েছে নির্যাতন, নিপীড়ন, জেল-জুলুম, হত্যাযজ্ঞ, যুদ্ধকালে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে প্রত্যক্ষ শাসন, তুরস্ক ভূখণ্ড খণ্ড-বিখণ্ড করে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেয়া, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড প্রভৃতি কারণে ভারতীয় মুসলমানরা খিলাফত আন্দোলন ও হিন্দু-মুসলমান মিলে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। এ দুটি আন্দোলন চলছিল অভিন্ন ধারায় ও গতি স্পন্দনে। এ ঊর্মিময় রাজনৈতিক পেক্ষাপটে ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের কাবিতাগুলো লেখা হয়। নানা উপমা-রূপকে, চিত্রে-চিত্রকল্পের, মিথ পুরাণ-ঐতিহ্য ও ইতিহাসের প্রসঙ্গে চরিত্রে নজরুল পরাধীনতা শোষণ বঞ্ছনা দুঃশাসনের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠে অথচ শিল্পিত সুরে স্বরে উচ্চারণ করেছেন জনগণ মুক্তির অমিয় বাণী। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিকে যদি ‘অগ্নিবীণা’র মূল ভাবের কবিতা বলি, তাহলে কবিতাগুলো ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সম্পূরক ভাবের কবিতা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
পুরাতন সমাজ রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে নতুন সৃষ্টির দুর্মর আকাক্সক্ষা ব্যক্ত হয়েছে বিভিন্ন কবিতায়; অসুন্দর, পুরাতন জীর্ণ ধ্বংস করে তদস্থলে নতুন সৃষ্টি করবে নতুন যুগের তরুণরা, ধ্বংস তো সৃষ্টির জন্যই, তাতে ভয় পেলে চলবে না, ‘ধ্বংস দেখে ভয় কেন তার? প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন!/ আসছে নবীণ-জীবনহারা অসুন্দরের করতে ছেদন!/ তাই সে এমন কেশে দেশে/ প্রলয় বয়েও আসছে হেসে-/ মধুর হেসে।/ ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির-সুন্দর!’/ ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘বিদ্রোহী’, ‘ধূমকেতু’, ‘আগমনী’, ‘রক্তাম্বর ধারিণী মা’, কবিতায়-নানাভাবে ধ্বংস ও সৃষ্টির দ্বৈত অনুষঙ্গ উল্লিখিত; অন্যান্য পৌরাণিক চরিত্রও একই উদ্দেশ্যে উল্লিখিত, যেমন- ‘আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার,/ নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্বা, আনিব শান্তি শান্ত উদার!/ আমি হলবলরাম স্কন্ধে,/ আমি উপাড়ি’ ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে সৃষ্টির মহানন্দে।’ (বিদ্রাহ), ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ কবিতাটিতেও আহ্বান করেছেন ধ্বংস করে সৃষ্টির জন্য, ‘নিদ্রিত শিবে লাথি মার আজ,/ ভাঙো মা ভোলার ভাঙ-নেশা,/ পিয়াও এবার তা-শিব গরল/ নীলের সঙ্গে লাল নেশা।/ ...শ্বেত শতদল-বাসিনী নয় আজ/ রক্তাম্বরধারিণী মা,/ধ্বংসের বুকে হাসুক মা তোর/ সৃষ্টির নব পূর্ণিমা।’/‘আগমনী’ কবিতায়ও ধ্বংসের পরে সৃষ্টির কামনা ‘ভুলে যাও শোক- চোখে জল ব’ক/ শান্তির-) আজি শান্তি-নিলয় এ আলেয় হোক।/ ঘরে ঘরে আজি দীপ জ্বলুক।/ মা’র আবাহনগীত চলুক।’ ‘ধূমকেতু’ কবিতায় ধূমকেতুরূপে কবি আবির্ভূত হয়েছেন। বিপ্লবের ও ধ্বংসের প্রতীক রূপে, আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃমহাবিপ্লব হেতু/স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু/ পরিণামে সৃষ্টিই উদ্দেশ্য, ‘আজিও ব্যথিত সৃষ্টির বুকে ভগবান ‘কাঁপে ত্রাসে,/ স্রষ্টার চেয়ে সৃষ্টি পাছে বা বড় হয়ে তারে গ্রাসে।’ ‘ধূমকেতু)
আবার ‘কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার’ ‘রণভেরী, ‘শাত-ইল আরব’ ‘কোরবাণী’ ‘খেয়া-পারের তরণী’ ও ‘মোহররম’ কবিতায় তিনি মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্য ও মিথ-পুরাণের প্রসঙ্গ চরিত্রে শক্তি-সাহস বীরত্ব সন্ধান করেছেন। অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে উদ্দীপনা সৃষ্টির লক্ষ্যে এসব কবিতা রচিত, অবশ্য তাতে কবির রোমান্টিক অনুভব ও স্বতঃস্ফূর্ততা এবং শিল্প প্রযতœ সমান সক্রিয় ছিল। ‘কামাল পাশা’ কবিতায় সাকারিয়ার যুদ্ধে কামাল পাশার বিজয়ে উল্লসিত কবি, সে উল্লাস নিজ দেশের তরুণদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতেই কবিতাটির সৃষ্টির লক্ষ্য যেন তারাও কামাল পাশার মতো বীরবিক্রমে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পারে।’ আবার ‘আনোয়ার’ কবিতায় নিষ্ক্রিয় মুসলমানকে ‘জানোয়ার’ বলে অভিহিত করেছেন, ‘দুনিয়াতে মুসলিম আজ পোষা জানোয়ার।/’ যে বলে সে মুসলিম জিভ ধরে টানো তার।/ বেঈমান জানে শুধু জানটা বাঁচানো সার।’ ‘শাত-ইল আরব’ কবিতায় মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের পরাধীনতার দুর্দশার করুণ চিত্র ও সেই দুর্দশা থেকে মুসলমানদের উদ্ধার করার আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে। ‘রণভেরী’ কবিতায়, ‘কোরবাণী’ ‘মোহররম’ কবিতায় শক্তি ও ত্যাগের স্পৃহা জাগাতে চেয়েছেন পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি অর্জনের অন্বিষ্ট লক্ষ্যে। ‘খেয়াপারের তরণী’ কবিতায় চিত্রকল্পে ও রূপক ব্যঞ্জনার মধ্য দিয়ে আদর্শবাদী’ যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব আকাক্সক্ষা করেছেন, যে নেতৃত্ব জনগণকে স্বাধীনতার স্বাদ দিতে পারবে। এ নেতৃত্বই পাকা মাঝির মতো গভীর সমুদ্রে ঝড়-ঝঞ্ঝা মোকাবেলা করে যাত্রীদের পাড়ে নেয়ার মতো জনগণকে স্বাধীনতা এনে দিতে পারে, ‘আবু বকর, ওসমান, উমর, আলী হায়দর/ দাঁড়ী যে এ তরণীর, নাই ওরে নাই ডর।’/ কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা,/ দাঁড়ি-মুখে সারি গান- লা শরিক আল্লা।’
হিন্দু বা মুসিলম যে মিথ-ঐতিহ্য, বা ইতিহাস ও চরিত্র নিয়েই কবিতা লিখুন না কেন, তাতে তাঁর অন্বিষ্ট লক্ষ্য ছিল জনজাগরণ, আর সে জাগরণের অন্বিষ্ট লক্ষ্য ছিল দেশের স্বাধীনতা আনয়ন। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশের প্রধান দু’সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমান সংঘবদ্ধ হয়ে দেশোদ্ধারের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী তল্পিতল্পা নিয়ে পালাতে বাধ্য হবে। মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি চেতনা জাগাতে, কবিতাকে সর্বজনীন করতে এবং সর্বোপরি কাব্যসৌন্দর্য সৃষ্টি করতে ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের কাবিতাগুলোতে তিনি অবাধে অকৃপণভাবে হিন্দু-মুসলিম পুরাণ, পুরাণ প্রসঙ্গ ব্যবহার করেছেন; এর পাশাপাশি দু-এক জায়গায় খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ ধর্মেরও মিথপুরাণ প্রসঙ্গ ব্যবহার করেছেন। ‘বিদ্রোহী কবিতায় এ চার ধর্ম সম্প্রদায়ের মিথ পুরাণ-ঐতিহ্যের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। বিদ্রোহী কবিতায় মিশ্র মিথ পুরাণ ঐতিহ্যের ব্যবহার সুলভ; অন্যদিকে ‘আগমনী’, ধূমকেতু’, ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ কবিতায় শুধু হিন্দু মিথ পুরাণ ঐতিহ্য এবং ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘কোরবাণী’ ‘মোহররম’ কবিতায় শুধু মুসলিম মিথ পুরাণ ঐতিহ্যের ব্যবহার করেছেন। আবার ‘কামাল পাশা’, ‘আনোয়ারা; ‘রণভেরী’, ও ‘শাত-ইল আরব’ কবিতায় সঙ্গত কারণে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস প্রসঙ্গ ব্যবহৃত।
এ কাব্যগ্রন্থে শব্দ ব্যবহারেও তাঁর স্বাতন্ত্র্য, অভিনবত্ব ও শিল্প নৈপুণ্যের সাক্ষর সুস্পষ্ট, তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংস্কৃত ও বাংলা শব্দের সাথে আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছেন, তাঁর এ ব্যবহার কৃত্রিম বা আরোপিত মনে হয় সৃষ্টিশীলতা ও শৈল্পিক নৈপুণ্যের কারণেই; এ কারণে বলা যায়, তিনি এ কাব্যগ্রন্থে একটি স্বতন্ত্র কাব্যভাষা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন, যা একজন কবির সহজ শনাক্তযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগন্থে ছন্দ ব্যবহারেও তাঁর স্বাতন্ত্র্য বৈচিত্র্য ও সৃষ্টিক্ষম প্রজ্ঞার পরিচয় মেলে। এ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো তাঁর প্রিয় ছন্দমাত্রাবৃত্তে রচিত, কিন্তু মাত্রাবৃত্তের নিরূপিত বা অতিপ্রচলিত পর্ব, পর্বাঙ্গ ও মাত্রায় অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন, পর্ব ও পঙ্ক্তির প্রবহমানতায় যোগ করেছেন নতুনত্ব। আবার অন্ত্যমিলের জন্য স্বরসত্তাতিবিশিষ্ট শব্দের প্রয়োগে কী স্বতঃস্ফূর্ততা ও সাবলীলতা বিধৃত।
এ বছর ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশের শতবর্ষ পূর্ণ হবে। এ কাব্যের আবেদন শতবর্ষ আগের মতো এখনো সমান, এখনো দেশের মানুষ স্বাধীন হলেও, স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ পায়নি। সর্বোপরি, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা দেশে চলছে ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব। এখনো বিশ্বে উৎপীড়িতের ক্রন্দন ধ্বনি শোনা যায়। এ কাব্যগ্রন্থেই তো কবি নজরুল অঙ্গীকার করেছেন দৃঢ় কণ্ঠে, ‘আমি সেই দিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রনিবে না।’ (বিদ্রোহী) অতএব, নজরুল ও তার এ ‘অগ্নিবীণা’ এখনো প্রাসঙ্গকি, আবেদনময় ও রসাস্বাদ্য এবং সে কারণেই কালোত্তীর্ণ।

 


আরো সংবাদ



premium cement