আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নজরুল
- সাঈদ চৌধুরী
- ২০ মে ২০২২, ০০:০০
কাজী নজরুল ইসলাম হলেন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্তর্জাতিক কবি। আমাদের জাগরণের স্মারক। আন্তর্জাতিক চেতনায় উজ্জীবিত নজরুল হয়ে উঠেছিলেন শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর। তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর এক বিস্ময়। প্রথম মহাযুদ্ধের সূচনাকালে নজরুল নিজেই বলেছেন, বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির। মহাযুদ্ধের সময় অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যের সাথে ইংরেজদের সংঘাতে মর্মাহত নজরুল বেশ কিছু বিপ্লবী কবিতা রচনা করেছেন। পাশ্চাত্য শক্তির বিরুদ্ধে যারাই ছিলেন আপসহীন, নজরুল তাদের জয়গান গেয়েছেন।
প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মানি ও তুরস্কের পরাজয়ের পর ১৯১৯-২০ সালে মধ্যপ্রাচ্যের বড় অংশ ইউরোপীয়দের দখলে চলে যায়। সেসময় আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইতালি কর্তৃক মধ্যপ্রাচ্যে রণক্ষেত্র সৃষ্টির বিরুদ্ধে নজরুল ছিলেন বজ্রকণ্ঠ। তখন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে উপনিবেশবাদ বিরোধী মানবজাতিকে জাগিয়ে তুলেছেন নজরুল। পশ্চিমা আগ্রাসন মোকাবেলায় সাহসী সংগ্রামী তুরস্কের মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক, ইরানের রেজা শাহ পহলবী, মিসরের জগলুল পাশা, আফগানিস্তানে বাদশা আমানুল্লা, মরক্কোর রীফ–কামাল প্রমুখের কথা এসেছে নজরুলের কবিতায়। আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার।
নজরুল লিখেছেন, ‘দিকে দিকে পুন জ্বলিয়া উঠেছে দীন-ই-ইসলামী লাল মশাল/ ওরে বে-খবর, তুইও ওঠ জেগে, তুইও তোর প্রাণ-প্রদীপ জ্বাল/ গাজী মোস্তফা কামালের সাথে জেগেছে তুর্কি সূর্খুতাজ,/ রেজা পহলবী-সাথে জাগিয়েছে বিরান মুলুক ইরানও আজ/ গোলামী বিসরি, জেগেছে মিসরী, জগলুল সাথে প্রাণ মাতাল/ ভুলি গ্লানিলাজ জেগেছে হেজাজ নেজদ আরবে ইবনে সউদ/ আমানুল্লার পরশে জেগেছে কাবুলে নবীন আল-মাহমুদ/ মরা মরক্কো বাঁচাইয়া আজি বন্দী করিম রীফ–কামাল/ জাগে ফয়সল্ ইরাক আজমে, জাগে নব হারুন-আল-রশীদ,/ জাগে বয়তুল মোকাদ্দাস রে, জাগে শাম, দেখ্ টুটিয়া নিদ্/ জাগে নাকো শুধু হিন্দের দশ কোটি মুসলিম বে-খেয়াল।’
কবি নজরুলের এমন কবিতা ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন গবেষণা হচ্ছে। বিশেষ করে দ্রোহের কবি কাজী নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ একটি প্রভাবক কবিতা। বাংলা ভাষা যে এতটা আণবিক শক্তিসম্পন্ন, বিদ্রোহী প্রকাশের আগে কারো জানা ছিল না। বিদ্রোহী কবিতা বিপ্লবীদের কণ্ঠে দিয়েছে সংগ্রামের ভাষা। ‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না’ কথাটি আপামর জনতাকে করেছে অনুপ্রাণিত। অপূর্ব সাহস ও শৌর্যে জনচিত্ত আহ্লাদিত হয়েছে।
জালিম শাহী এ কবিতায় অব্যক্ত ক্ষোভের প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছে। স্বৈরশাসকের গর্দানে ছিল মহা দুরমুশ। বিস্ময় আর অস্বস্তি তৈরি করেছে ব্রিটিশ প্রশাসনে। নিগৃহীত মানুষের মনে জাগিয়েছে পরিবর্তনের চেতনা ও প্রেরণা।
নজরুল সর্বাংশে স্বদেশী আবার বিশেষভাবে আন্তর্জাতিক। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। সমানভাবে সমাদৃত তার জন্মভূমি পশ্চিমবঙ্গে। ভারত ও বাংলাদেশে রয়েছে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়। ইউরোপেও নজরুল চর্চা আগের চেয়ে বেড়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।
নজরুল কোনো নির্দিষ্ট কালে বা অঞ্চলে সীমিত নন। বিশ্বময় বিদ্রোহী কণ্ঠ হিসেবে আলোচিত ও সমাদৃত। মানবতা ও সাম্যের কবি হিসেবে অনন্তকাল ধরে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে।
১৯২১ সালে ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে বিদ্রোহী লেখা হয়েছে। ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় কবিতাটি ছাপা হয়। কয়েক দিনের মধ্যে প্রবাসী, সাধনা, ধূমকেতু ও বসুমতীসহ বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় এটি মুদ্রিত হয়। সৃষ্টি হয় সর্বত্র মহা তোলপাড়।
সাহিত্য সমালোচকেরা মনে করেন বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে নজরুলের মতো এমন সৌভাগ্য আর কারো হয়নি। মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি বিস্ময়কর সাড়া জাগিয়েছেন।
বিদ্রোহী একটি কালজয়ী সৃষ্টি। ৮টি স্তবক, ১৪৯টি পঙ্ক্তির একটি দীর্ঘ কবিতা। অবশ্য বাংলা একাডেমির ‘নজরুল রচনাবলী’ ১৯৯৬ মোতাবেক একশ ঊনচল্লিশ পঙ্ক্তি উল্লেখ করা হয়েছে। আর একশ বেয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ গুণেন কেউ কেউ।
বিদ্রোহী মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। মুক্তক ছন্দে কবিতাটি মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে। বাংলা ভাষায় নজরুলই এই ছন্দের প্রবর্তক। বিদ্রোহীর তাল ও ছন্দ সাগরের ঢেউয়ের মতো তরঙ্গ সৃষ্টি করেছে। জাগিয়ে তুলেছে পাঠকহৃদয়। হাবিলদার নজরুল বিদ্রোহী কবি আখ্যায় ভূষিত হয়েছেন।
কবিতাটি শোনানোর পর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, আমি যদি আজ তরুণ হতাম, তাহলে আমার কলমেও ওই সুর বাজত।
বিদ্রোহী কবিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাথে দারুণ ভাবে জড়িয়ে আছে। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে বিদ্রোহী লেখা হয়েছে। ১৯৭১ সালে ছিল বিদ্রোহী প্রকাশের GOLDEN JUBILEE বা সুবর্ণজয়ন্তী। আর এখন ২০২১ সালে বিদ্রোহী কবিতার শতাব্দী (CENTURY) ও বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী।
[চলবে]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা