১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
প্রিয় গীতিকবি কে জি মোস্তফা

অন্তিম অভিবাদন

-

কে জি মোস্তফার একটি বইয়ের নাম ‘কোথায় চলেছি আমি’। বেরিয়েছিল ২০১১ সালে। প্রকাশক জ্যোতিপ্রকাশ। মোট ৪১টি ছোট ছোট নিবন্ধ নিয়ে গঠিত বইটির শরীর। এগুলো ঠিক আত্মকাহিনী নয়, আত্মজীবনীও নয়। বইটিকে তিনি অভিহিত করেছেন ‘কিছুটা জীবননামা’ হিসেবে। নিজেকে তিনি ভাবতেন নিঃসঙ্গ। পূর্বকথনে লিখেছেন :
‘বেসিক্যালি আমি খুব লোনার। ছোটবেলা থেকে সম্পর্কহীন হয়ে একা একা বড় হয়েছি। বলা যায়, গৃহ থেকে গৃহহীনতায় যাত্রা। তবে নিদারুণ অর্থকষ্টের দিনগুলো ছিল সবচেয়ে আনন্দময় সময়। বন্ধুবান্ধবদের সাহচর্য, বিত্তবানদের উৎসাহ ও আগ্রহ চলার পথে জুগিয়েছে অমূল্য পাথেয়। জীবন তো থেমে থাকে না। প্রবাহিত হয়ে চলে নতুনভাবে নতুন খাতে। মানুষের তাই একমাত্রিক পরিচয় হয় না। প্রয়োজনে ও পরিবেশে হয়ে যায় তিন চার টুকরোর সমাহার। এমনই এক বিচিত্র জীব মানুষ।
জীবন এগিয়ে চলে মোটামুটি এক সরলরেখায় তার নিজস্ব বিষাদ, আনন্দ নিয়ে। কোনো জীবনে হঠাৎ আসে তীক্ষè বাঁক, অস্থির মোড়। তখন বদলে যায় প্রতিবেশ, মানুষজন। এটাই তো জীবন। মাঝে মধ্যে পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে যায়। সব কী রকম গোলমাল ঠেকে মনের ভেতর। পিছু ডাক যেন পিছু ছাড়ে না। শিকড় তো কবে উপড়ে ফেলেছি। কেন যে আজো সেসব বয়ে যাওয়া ক্ষয়ে যাওয়া স্মৃতির জন্য মন খারাপ হয়। কী প্রগাঢ় মোহ!’
কবি, রিপোর্টার, কলামিস্ট, গীতিকার, সম্পাদক, হোমিওপ্যাথ ডাক্তার- অনেক গুণ ছিল তাঁর। সবকিছু ছাপিয়ে প্রধান ও প্রবল হয়ে উঠেছে গীতিকবি হিসেবে তাঁর পরিচয়। সেই ব্যাপ্তি এত প্রসারিত যে, রীতিমতো বিস্ময়কর। একটি গান, মাত্র একটি গানই যে কিংবদন্তি হয়ে উঠতে পারে, তার উজ্জ্বল উদাহরণ এটি। আজ থেকে ৬২ বছর আগে তাঁর লেখা গান ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে/রাতের বাসরে দোসর হয়ে তাই সে আমারে টানে...’ তৎকালে সুপার ডুপার হিট হয়েছিল। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন তালাত মাহমুদ। সুরসৃষ্টি রবীন ঘোষের। গানটি ছিল ‘রাজধানীর বুকে’ সিনেমার। এই চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন খ্যাতিমান পরিচালক এহতেশাম। এখনো সেই গান জনপ্রিয়। তাতেই প্রমাণিত হয় যে, গীতল মাধুর্যমণ্ডিত এই গানটি কালোত্তীর্ণ এবং শিল্পোত্তীর্ণ। গানটি তিনি লেখেন ১৯৬০ সালে। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। কবিতা লিখতেন, শখের বশে কিছু কিছু গানও লিখতেন। আচমকা ও অপ্রত্যাশিতভাবে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন গান লেখার।
ওই গানটি সম্পর্কে তিনি নিজে কী ভাবতেন?
কী ছিল তাঁর নিগূঢ় মনোভাবনা, পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ ও অনুভূতি? ‘কোথায় চলেছি আমি’ নামের আত্মজৈবনিক ধাঁচের এই বইটিতে গোটা একটি নিবন্ধই তিনি লিখেছেন। বিষয় : সেই গান। শিরোনাম যথারীতি ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো’। সেই লেখা থেকে একটু উদ্ধৃতি এখানে দিচ্ছি। কোটেশনটা সামান্য দীর্ঘ হবে, কিন্তু ক্লান্তিকর পাঠ হবে না বলে বিশ্বাস করি। কে জি মোস্তফা ওই নিবন্ধে লিখেছেন,
“১৯৬০ সালে ‘রাজধানীর বুকে’ মুক্তি পাওয়ার পর সাপ্তাহিক চিত্রালীতে বিশিষ্ট কথাশিল্পী বন্ধুবর ফখরুজ্জামান চৌধুরী একটি সমালোচনা লেখেন। ছবির কাহিনী, চিত্রায়ন ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিষয়ের ওপর তাঁর মন্তব্য ছিল তীক্ষè। কিন্তু ছবির সঙ্গীত সম্পর্কে মতামত ছিল উদার ও আশাব্যঞ্জক। বিশেষ করে ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো’ গানটি সমকালকে অতিক্রম করে যাবে বলে তিনি পূর্বাভাস দেন। যাই হোক, ‘রাজধানীর বুকে’ ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হলো। প্রায় সবকটি গানও জনপ্রিয় হয়েছিল। তবে ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো’ অচিরেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যায়। সেই জনপ্রিয়তা অব্যাহত গতিতে আজও সচল। বিটিভিসহ বিভিন্ন চ্যানেলে এ গান অসংখ্যবার প্রচারিত হয়েছে এবং হচ্ছে। তাছাড়া আমার জানামতে প্রায় ১০ জন বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী গানটি ‘রিমেক’ করেছেন।
৮০ দশকে বিটিভির এক সঙ্গীতানুষ্ঠানে স্বনামধন্য সঙ্গীতকার খান আতাউর রহমান মন্তব্য করেছিলেন, এ গানটি আমাদের আধুনিক গানের জগতে একটি মাইলফলক। অন্য এক সময় ব্যক্তিগত সাক্ষাতে তিনি আমাকে বলেছিলেন, এ গানে নাকি আধ্যাত্মিকতা লুকিয়ে আছে। বিশিষ্ট সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক হুমায়ুন আজাদ চট্টগ্রামের ‘বলাকা’ ম্যাগাজিনে এক সাক্ষাৎকারে সঙ্গীত সম্পর্কে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, এ দেশে এ পর্যন্ত মাত্র ৪টি আধুনিক গান তৈরি হয়েছে এবং এর মধ্যে ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো ১নং। বিশিষ্টজনদের এমনতর মন্তব্যে কৃতজ্ঞতায় আমি সত্যি অভিভূত। আসলে এ গানটি আমার অন্য সব পরিচিতিকে ছাড়িয়ে যেন একমাত্র ‘আইডেন্টিটি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জন আমার প্রতি যেভাবে আবেগ ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে থাকেন তাতে আমি একদিকে যেমন খুশি হই, তেমনি বিব্রতও বোধ করি। কেননা গানটি যদিও আমি লিখেছি, কিন্তু এর সাথে সুরকার ও গায়কের অবদান অনস্বীকার্য।
সে যাই হোক, এ গানটির সাথে জড়িয়ে আছে হাসি-কান্নায় মেশানো আমার জীবনের অনেক চমকপ্রদ ঘটনা। তবে সবচেয়ে কঠিনতর যেটা, তা হলো দীর্ঘদিন ধরে চেনা-জানা অসংখ্যজনের কৌতূহলভরা একটি প্রশ্ন : এ গানের ‘তুমিটা’ কে? এবং অদ্যাবধি সে একই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় আমাকে।
আসলে গানটি তো ছিল ফরমাশি। ছবির কাহিনী অনুযায়ী লিখতে হয়েছে। কিন্তু সে কথা কেউ যেন মানতে চায় না, শুনতে চায় না। সবারই ধারণা, নিশ্চয়ই তেমন কেউ একজন আমার ছিল, যাকে কল্পনা করে গানটি আমি লিখেছিলাম। দীর্ঘকাল ধরে এ প্রশ্ন শুনতে-শুনতে একসময় আমারও মনে প্রশ্ন জাগল : গানটি লেখার সময় অবচেতন মনে আসলে আমার এমন কেউ কি ছিল? নিজেরই প্রশ্নের জবাবে একসময় আমি আরেকটা গান লিখলাম, সেটা এরকম- ‘সে মন রাখে, মনে রাখে না, কত ভাবনা রেখে যায় সে থাকে না।’ কিন্তু তাতেও যেন উত্তরটা আমার মিলল না। কিছু দিন পরে আবার লিখলাম- ‘সে আলোর দুয়ারে দাঁড়িয়ে, আমি আঁধারে গেলাম হারিয়ে, সে রয়েছে মনের কাছে, আমি পাই না হাত বাড়িয়ে।’ ‘তুমি’ শব্দটা সম্পর্কে সুফি সাধকদের একটি গল্প বলে শেষ করছি। এক বাড়িতে এক মেহমান এসে দরোজায় কড়া নাড়ল, ভিতর থেকে প্রশ্ন হলো ‘কে?’ উত্তর এলো ‘আমি’। দরোজা কিন্তু খুলল না। আবারও কড়া নাড়ার শব্দ, আবারও একই প্রশ্ন ‘কে’, এবার উত্তর হলো ‘তুমি’। কী আশ্চর্য এবার যথারীতি দরোজা খুলে গেল।
কে জি মোস্তফার জন্ম ১৯৩৭ সালের ১ জুলাই নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে। মৃত্যু ৮ মে ২০২২। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। সফল সাংবাদিক এবং কলামিস্ট ছিলেন। ১৯৫৮ সালে দৈনিক ইত্তেহাদে শিক্ষানবিস হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু। ওই বছরই ‘দৈনিক মজলুম’-এ সহ-সম্পাদক পদে নিয়োগ পান এবং পত্রিকাটির বিলুপ্তির আগ পর্যন্ত বহাল ছিলেন। দীর্ঘবিরতি কাটিয়ে ১৯৬৮ সালে সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন সাপ্তাহিক জনতায়।
১৯৬০ সাল থেকে চলচ্চিত্র, রেডিও এবং টেলিভিশনে তাঁর লেখা প্রচুর গান প্রচারিত হয়। হাজার গানের গীতিকার কে জি মোস্তফার ফিল্মি গানগুলো খুবই জনপ্রিয়। একসময় তিনি নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালনার দিকেও ঝুঁকেছিলেন। ‘মায়ার সংসার’, ‘অধিকার’ ও ‘গলি থেকে রাজপথ’ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজও করেন।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে কে জি মোস্তফা প্রথমে ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’, পরে ‘দৈনিক স্বদেশে’ চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ‘দৈনিক জনপদে’ কূটনৈতিক রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন। ওই সময় ‘নূপুর’ নামে একটি বিনোদন মাসিকও সম্পাদনা করতেন তিনি। ১৯৭৬ সালে বিলুপ্ত সংবাদপত্রের একজন সাংবাদিক হিসেবে বিসিএস (তথ্য) ক্যাডারভুক্ত হন এবং চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরে সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। পদোন্নতি পেয়ে প্রথমে সম্পাদক, পরে জ্যেষ্ঠ সম্পাদক হন।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সঙ্গীত বিভাগ কর্তৃক ‘দেশবরেণ্য গীতিকার’ পদকসহ বহু পদকে ভূষিত হয়েছেন এই ব্যক্তিত্ব।

 


আরো সংবাদ



premium cement
সারা বিশ্ব আজ জুলুমবাজদের নির্যাতনের শিকার : ডা. শফিকুর রহমান মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশী : পররাষ্ট্রমন্ত্রী চন্দনাইশ, বাঁশখালী ও বোয়ালখালীতে ৩ জনের মৃত্যু গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়াল শ্যালকের অপকর্মে দুঃখ প্রকাশ করলেন প্রতিমন্ত্রী পলক রাজশাহীতে ট্রাকচাপায় ৩ মোটরসাইকেল আরোহী নিহত পাবনায় দুই গ্রুপের সংঘর্ষে হতাহত ২২ বিল দখলের চেষ্টা, জেলা ছাত্রলীগ নেতাকে গণপিটুনি ‘শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত হয়ে কাজ করলে বিজয় অনিবার্য’ কারাগারে নারী হাজতিকে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন, প্রধান কারারক্ষীসহ ৩ জনের বদলি প্যারিসে ইরানি কনস্যুলেটে ঢুকে আত্মঘাতী হামলার হুমকিদাতা গ্রেফতার

সকল