২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কে জি মোস্তফা এবং একরাশ শূন্যতা

-

বৈচিত্র্য বেরুবে। নতুন ব্যবস্থাপনায় নতুন আঙ্গিকে। ঈদ সংখ্যা দিয়ে শুরু হবে যাত্রা। বসলাম লেখক তালিকা নিয়ে। কত নাম। লিখছি কাটছি লিখছি। তালিকা মোটামুটি চূূড়ান্ত। ফোন তুললাম প্রথম লেখাটি চাওয়ার জন্য। ফজল ভাই অপর প্রান্ত থেকে বললেন, এভাবে নয়, অফিসে আসো। সামনাসামনি কথা হবে। ছুটলাম তার অফিসে। লেখক তালিকা তুলে দিলাম হাতে। তিনি চোখ বুলিয়ে বললেন, কে জি মোস্তফার নাম কই? আমি মাথা চুলকে বললাম, ভুল হয়ে গেছে। তিনি নিজের হাতে নাম লিখে বললেন, কে জি খুব বড় মাপের মানুষ। বিশেষ সংখ্যায় বিশেষ মানুষেরা থাকে। কে জি সে কারণেই থাকবে। পরদিন লেখার জন্য ফোন করতেই কে জি ভাই হেসে বললেন, গদ্য না পদ্য। বললাম, গদ্য। তিনি বললেন, একটু সময় দিও। বললাম, পাঁচ দিন। তিনি তাতেই রাজি। বললেন, শনিবার এসো।
দুই.
প্রথম দেখা। সাল মনে নেই। হয়তো ১৯৭৭-৭৮ হবে। সবেমাত্র ঢাকা এসেছি। থাকি ঢাকা কলেজ হোস্টেলে। বন্ধুদের সাথে নিউমার্কেটে এসেছি ঘুরতে। হঠাৎ এক বন্ধু আঙুল তুলে বলল, দেখ দেখ ওই কে জি মোস্তফা। দেখলাম রোগা পটকা, ছোটখাটো একজন মানুষ, একটি বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। এর মধ্যে কোনো বিশেষত্ব খুঁজে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম- তো? সে বেশ গুরুত্বের সাথে বলল, আরে ওই যে বিখ্যাত গানটা ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো’ এই গানটার তিনি লেখক। অবাক হলাম। ছোটবেলায় বাসায় একটা বিরাট আকারের রেডিও ছিল। নাম ‘পাই’। ছয়টা ব্যাটারি দিয়ে চালাতে হতো। মা প্রতিদিন সকালে রেডিও ছেড়ে দিয়ে কাজ করতেন। কত যে স্টেশন, কখনো আকাশবাণী, কখনো শিলিগুড়ি, কখনো পাকিস্তান থেকে ভেসে আসা মিতালীও ছিল তার প্রিয় অনুষ্ঠান। এ ছাড়া দুপুরের অনুষ্ঠানগুলো তো ছিলই। মিতালীতে তখন দু’টি গান প্রায় প্রতিদিনই বাজত, একটি ‘আকাশের ওই মিটি মিটি তারার সাথে’ আরেকটা ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে’। শুনতে শুনতে এর কথাগুলো আমার মুখস্থ। কেমন একটা সম্মোহনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেলাম। কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে বললাম, স্যার আমার নাম শাহীন। আমি আপনার গানের ভক্ত। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় বাড়ি? বললাম, পিরোজপুর। এরপর টুকটাক অনেক কথা। বিদয়ের সময় বললেন, তুমি আমার ছোট ভাইয়ের মতো। স্যার বলবে না, ভাই বলে ডেকো। এরপর থেকে তিনি শুধু আমার কে জি ভাই।
তিন.
আমার পঞ্চাশতম জন্মদিন, প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে। সভাপতি কে জি ভাই। তার শরীর অসুস্থ। তিনি আগেভাগেই বক্তৃতা দিয়ে চলে যাবেন। আল মাহমুদ বললেন, ওনাকে ছেড়ে দাও। তখনো প্রধান অতিথি আসেননি। ফজল ভাই বললেন, একটু দেরি করো। এর মধ্যেই ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন এলেন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। তিনি মঞ্চে আসন নেয়ার পরপরই কে জি ভাইয়ের নাম ঘোষিত হলো। হুমায়ুন ভাই তাকালেন এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তার দেখাদেখি অন্যরাও। নিজের বক্তব্য রাখার সময় এর ব্যাখ্যা দিলেন হুমায়ুন ভাই। বললেন, কে জি সাহেবের নাম ঘোষণার পর আমি উঠে দাঁড়িয়েছিলাম যে কারণে সেটা হচ্ছে, শ্রদ্ধা। আমি তাকে এবং তার কলমকে শ্রদ্ধা করি। তার গান শুনেই আমার হৃদয়ে প্রথম প্রেমের কলি ফুটেছিল। হলজুড়ে তখন তুমুল করতালি।
চার.
একটা শূন্যতা চার পাশে। ফেসবুকে কার যেন একটা স্ট্যাটাস জানিয়ে দিলো, কে জি ভাই নেই। বিশ্বাস হচ্ছিল না। এরপর ফোনে নিশ্চিত হয়ে চুপ করে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। আহ্ কে জি ভাই। কত স্মৃতি কত কথা। আল মাহমুদ কিংবা ফজল শাহাবুদ্দীন চলে যাবার পর কি এমনই শূন্যতা ঘিরে ধরেছিল আমাকে? হয়তো বা। স্মৃতি খুবই বাজে একটা জিনিস। সে কখনো কাঁদায়, কখনো হাসায়। কে জি ভাই শুধুই কাঁদাচ্ছেন। আমার ভেতরটা হু হু করছে। একরাশ অপার শূন্যতায় আমি হাবুডুবু খাচ্ছি ক্রমশ।

 


আরো সংবাদ



premium cement