২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কবি কে জি মোস্তফা

-

তোমারে লেগেছে এত যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে/আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন কপোলের কালো টিপ পড়বে চোখে/এমন দু’টিসহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের রচয়িতা কবি ও গীতিকার কে জি মোস্তফা। তিনি মূলত কবি। কিন্তু গানের বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে তার কবি পরিচিতি অনেকটা ঢাকা পড়ে গেছে। কারণ কে জি মোস্তফার নাম শোনার সাথে সাথে সবার ওই জনপ্রিয় গান দু’টির কথা মনে পড়ে যায়।
জনপ্রিয় এই কবি ও গীতিকার গত ৮ মে রোববার রাতে না ফেরার দেশে চলে গেছেন।
মৃত্যুর পরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে যেসব সংবাদ ছাপা হয় এবং সাংবাদিকসহ অন্যদের আলোচনায় তাঁকে নন্দিত, জনপ্রিয় গীতিকার কিংবা গীতিকবি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তিনি প্রথমে কবিতা লেখা দিয়েই সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেছিলেন এবং সারাজীবন এই কবিতার পেছনেই ব্যয় করেছেন।
মাঝখানে দুই দশক ধরে সিনেমার স্বর্ণযুগে গান লিখে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তার গান মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হতে থাকে। তার গানের সংখ্যা হাজারের উপরে। বিশেষ করে বেশির ভাগ বাংলা রোমান্টিক গানের রচয়িতা তিনি। ফলে তাকে খুব কম মানুষই একজন আধুনিক কবি হিসেবে চেনে।
কে জি মোস্তফা ছিলেন আপাদমস্তদক একজন কবি। শুধু তাই নয় অত্যন্ত ছন্দ সচেতন একজন দক্ষ কবি। তিনি কতটা আধুনিক ও দক্ষ কবি ছিলেন তার দু-একটি উদাহরণ দেয়া যাক।
একটি কবিতায় তিনি বলছেন, ...সময় তুমি যতই বিশৃঙ্খল হওনা কেন/ কবিতাই আমার জয়লাভের প্রধান অস্ত্র/আমরা বুঝে নিতে পারি তিনি কবিতা দিয়েই সময়কে জয় করতে চেয়েছেন। কারণ শেষ পর্যন্ত কবিতাই টিকে থাকে। আর সব কালের গর্ভে হারিয়ে যায়।
জীবন এখন এক নোংরা জলের নর্দমা/সেখানে কেবল মরা ব্যাঙ আর ইঁদুরের হাড়/ গিজগিজ পোকাদের উৎসব, বুনো জঙ্গলে বিষাক্ত/ সাপের হিসহিসানি; এ বিশ্বে এখন অবাঞ্ছিতা বলে/ ফুরিয়ে গেছে আমার সব দাবি সব প্রয়োজন।/ বিমূঢ় যুগের বিভ্রান্ত পথিক আমি যেন আজ/হাত থেকে হাতে ঘোরা শুধু এক উড়ন্ত রুমাল/
কতটা আধুনিক হলে সময়কে নিয়ে এমন উচ্চারণ করা যায়? আর একটি কবিতায় তিনি বলছেন,
শব্দের পেছনে আছে বিশৃঙ্খলা, তবু শব্দ আমি/সাজাবোই; আমার নিয়মিত ভালোবাসা ও সৌন্দর্য/
আধুনিক মানুষ বেশির ভাগ নগরবাসী। তার পরও তারা খুবই নিঃসঙ্গ আর এই নিঃসঙ্গতা বোধকে তিনি তুলে ধরেছেন এভাবে- মানুষের অরণ্যের মাঝে কখনো কখনো/নিজেকে সম্পূর্ণ একা মনে হয়/তখন বন্ধু বলতে কেবল ঐ রাস্তাগুলো।
কে জি মোস্তফা ছড়াও লিখেছেন। তার কয়েকটি ছড়ার বই রয়েছে। শেষের দিকে তিনি কিছু হামদ ও নাত রচনা করেছিলেন। এবারের একটি দৈনিকের ঈদ সংখ্যায় তার কয়েকটি হামদ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ গোড়ামিমুক্ত উদার আধুনিক মনস্ক একজন মানুষ। ধীরস্থির আর ধ্যানী। প্রাচীন যুগের ঋষিদের মতো চলাফেরা। নরম কোমল আর সব সময় মৃদুভাষী। কারো সাথে ঝগড়াঝাটি তো দূরের কথা, উচ্চস্বরেও কথা বলতেন না।
তিনি নিজে যেমন কবি ছিলেন তেমনি ছিলেন অনেক কবি নির্মাণের কারিগর। বাংলা সাহিত্যে গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে বুদ্ধদেব বসুর হাত ধরে যেমন অনেক কবি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন তেমনি ঢাকার কবিতাঙ্গনে গত কয়েক দশকে কে জি মোস্তফার হাত ধরেও অনেক কবি কবিতার জগতে এসেছেন এবং কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। সারা জীবন সৃজনশীল কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
তিনি সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে যখন কাজ করেছেন তখনো নবারুণ, সচিত্র বাংলাদেশের মতো সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন দীর্ঘদিন। এমন নিরহঙ্কার আর বিনয়ী মানুষ এ যুগে তেমন একটা দেখা যায় না। কোনো দিন কোনো সরকারি সুযোগ সুবিধা বা পুরস্কারের জন্য তদবির বা কোথাও ধরনা দিতে তাকে দেখা যায়নি।
আমার সাথে কে জি ভাইয়ের পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা এই কবিতাকে কেন্দ্র করেই। ২০০৪ সালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য হওয়ার পর জানতে পারি যে এখানে প্রতি মাসে নিয়মিত স্বরচিত কবিতা পাঠের একটি আসর বসে এবং কবিতাপত্র নামে একটি কবিতা পত্রিকাও ছাপা হয়। সেই কবিতাপত্রের সম্পাদক কে জি মোস্তফা। আর এর উদ্যোক্তা এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষক সিনিয়র সাংবাদিক কবি এরশাদ মজুমদার। এরশাদ ভাইকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। তিনি ছিলেন ইংরেজি দৈনিক নিউ নেশন-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এবং নামকরা সাংবাদিক। দি ডেইলি স্টারের রিপোর্টার হিসেবে আমি এরশাদ ভাই আয়োজিত বেশ কয়েকটি সেমিনার ও আলোচনা অনুষ্ঠান কাভার করেছি। তখনই এরশাদ ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয়। প্রেস ক্লাবের সদস্য হওয়ার পর সেই পরিচয় আরো ঘনিষ্ঠ হয়। আর কে জি ভাইকে আমি প্রেস ক্লাবের সদস্য হওয়ার আগে দেখিনি তবে নাম শুনেছি।
কবিতার প্রতি প্রবল আকর্ষণের কারণে একদিন ঠিকই কবিতার আসরে গিয়ে আমি হাজির হই। দুরু দুরু বক্ষে প্রবেশ করে এক কোনায় গিয়ে আসন গ্রহণ করি। কিন্তু এরশাদ ভাই ঠিকই আমাকে দেখে ফেলেন এবং নতুন আগত হিসেবে সবাইকে করতালি দিয়ে আমাকে বরণ করে নেয়ার আহ্বান জানান।
আমি একবারে মুগ্ধ এবং অভিভূত হয়ে যাই। কারণ তখন আমার কবি হিসেবে কোনো পরিচিতি ছিল না। আমার কোনো কবিতাও কোনো জাতীয় পত্রপত্রিকা কিংবা ম্যাগাজিনে ছাপা হয়নি। কৈশোরে কবিতা লেখা শুরু হলেও সংবাদপত্রে রিপোর্টার হিসেবে চাকরি করার কারণে আমি দীর্ঘদিন কবিতা থেকে বেশ দূরেই ছিলাম। সেই আমাকে এভাবে বরণ করা হলো? সেখানে পঠিত কবিতাটি পরের মাসে আবার কবিতাপত্রে ছাপা হওয়ায় আমার উৎসাহ আরো বেড়ে গেল। সেই যে শুরু তারপর থেকে গত প্রায় দুই দশক ধরে আমি কবিতার আসরে এবং কবিতাপত্রে নিয়মিত। আমার প্রায় সব কবিতাই কবিতাপত্রের কোনো না কোনো সংখ্যায় ছাপা হয়েছে। আর কে জি ভাই নিয়মিত সেসব কবিতা কবিতাপত্রে স্থান দিয়েছেন।
কবিতাপত্রের শুরুর দিকে কে জি মোস্তফা ও এরশাদ মজুমদার ছিলেন এর প্রাণপুরুষ। এরশাদ ভাই অর্থ ও প্রকাশনার বিষয়গুলো দেখতেন আর কে জি ভাই কবিতা সংগ্রহ, সম্পাদনা ও আসর পরিচালনা করতেন।
সে সময় আন্তর্জাতিক কবিতা দিবস উপলক্ষে দ্বি-ভাষিক ইংরেজি ও বাংলা কবিতা নিয়ে কবিতাপত্রের বেশ কয়েকটি উন্নতমানের সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এভাবে বছরের পর বছর কবিতাপত্রিকা এগিয়ে চলেছে। বর্তমানে অবশ্য এই দু’জন আর এই দায়িত্বে নেই। এখন নতুন একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে। তারাই সব ব্যবস্থা করে থাকেন। তবে শুরুর দিকে এই দু’জন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যদি এটি দাঁড় না করাতেন তাহলে এটি অনেক আগেই অকাল মৃত্যুমুখে পতিত হতো। আমি দেখেছি কী নিষ্ঠা আর মমতার সাথে কেজি ভাই খুদে এই ম্যাগাজিনের পেছনে লেগে থাকতেন। কবিতার প্রতি অসীম ভালোবাসা না থাকলে কারো পক্ষে এভাবে লেগে থাকা সম্ভব নয়।
কিন্তু এখন কবিতাপত্র একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে এবং বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন প্রতি মাসের শেষদিন অনুষ্ঠিত স্বরচিত কবিতাপাঠের আসরে ৫০-৬০ জন কবি কবিতা পাঠ করেন। প্রেস ক্লাবের সদস্য ছাড়াও অনেক অতিথি কবি আসরে স্বরচিত কবিতা পেশ করে থাকেন। শুরুতে যার সংখ্যা ছিল মাত্র ১০-১৫ জন।
২০০৭ সালে তিতাশ চৌধুরীর সম্পাদনায় তার উপর একটি সঙ্কলন বের হয় যার নাম ছিল একজন কে জি মোস্তফা। সেখানে দেশের শীর্ষস্থানীয় কবি-সাহিত্যিকরা তার স্মৃতিচারণ করেছেন এবং তাঁর লিখিত গান ও কবিতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
কে জি মোস্তফার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ১.কাছে থাকো ছুঁয়ে থাকো ২. উড়ন্ত রুমাল ৩. চক্ষুহীন প্রজাপতি ৪. সাতনরী প্রাণ ৫. এক মুঠো ভালোবাসা ৬. যে কথা মনের কথা ৭. প্রেম শোনে না মানা ৮. আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন। ছড়ার বই ১. শিশু তুমি যিশু ২. কন্যা তুমি অনন্যা ৩. হাজার ছড়া শিশুর পড়া।
গদ্যগ্রন্থ ১. কোথায় চলেছি আমি (আত্মকাহিনি ২. যেতে হবে কত দূর (আত্মকাহিনী। গানের সিডি ১. তোমারে লেগেছে এত যে ভালো ২. তৃষ্ণা আমার হারিয়ে গেছে ৩. হারানো গান হারানো স্মৃতি।
কবি পরিচয়ের বাইরেও তিনি ছিলেন সাংবাদিক ও বিশিষ্ট হোমিওচিকিৎসক। তিনি আরো অনেক কাজ করেছেন বলে আমাকে জানিয়েছেন। যেমন একবার ব্যবসায় নেমেছিলেন। ঠিকাদারি ও কোম্পানির ডিলারিও করেছেন বেশ কিছুদিন। তবে সে সব পরিচয়ের কথা আজ কেবল অতীতের স্মৃতি। কিন্তু কবি হিসেবে এবং কালজয়ী অনেক গানের রচয়িতা হিসেবে তিনি যে বাঙালি মানসে আরো বহুযুগ বিরাজ করবেন তা বলা যায় নিশ্চিতভাবে।


আরো সংবাদ



premium cement