২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কবিতার সময়

কবিতার সময় -

‘প্রত্যেক কবিই জন্ম নেন তাঁর নিজস্ব কিছু বলার জন্য এবং তাঁর আদি কর্তব্য হলো পূর্বজদের অস্বীকার করা, যারা তাঁর আগে জন্মেছেন তাঁদের অলঙ্কারাদিকে পরিত্যাগ করা’। ‘কথাটি মূলত রবার্ট ফ্রস্টের, সাক্ষাতের বিবরণ লিখেছেন অক্তাভিও পাস রোমান্টিক যুগের ইংরেজ কবি পার্সি বিশি শেলি বলেছিলেন ‘কবিতার চর্চা মানুষকে সেসব সময়ে বেশি করতে হবে যখন স্বার্থপরতা ও হিসাব-নিকাশের বাড়াবাড়ির কারণে সুখের তুলনায় সম্পদের সংগ্রহ বেশি ভারী হয়ে পড়বে, শরীর মনের তুলনায় বেশি ওজনদার হয়ে পড়বে’ প্রথমত ফ্রস্টের এ মতামত আজকের সময়ের জন্য খুব বেশি প্রাসঙ্গিক হলেও চারদিকের কবিকূলের বদলে যাওয়ার আকাক্সক্ষার তেমন কোনো দিকগত পরিবর্তন আমাদের কবিতায় স্পষ্ট হয়েছে বলে মনে হয় না। জীবনের প্রাসঙ্গিকতার দিক নানাভাবে বদলে গেলেও সামগ্রিক পরিবর্তনের লক্ষণ বাস্তবগতভাবেই অনুপস্থিত। ফলে আমাদের কবিতা গতানুগতিকতাকে পরিহার করে গা ঝাড়া দিয়ে নতুনকে সংযোজন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। সামান্য কিছু পরিবর্তন ঘটলেও সেসবই অতীতকে আঁকড়ে ধরে আছে; তার মূল কারণ হচ্ছে কবিরা সমাজ পরিবর্তনের ধারার অগ্রমুখকে চিহ্নিত করতে অপারঙ্গম হচ্ছে। তারা আবদ্ধ সমাজের আবেগকেই কবিতা মনে করে প্রাচীন রীতিগুলোকে বর্তমানের হাওয়ায় ভাসিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে; কোথায় গেলে একটু সুবিধা পাওয়া যাবে এবং কোন পূর্বজ কবির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে তা উপস্থিত করবে সেই ঝোঁক তীব্র। কারণ তারা মনে করে এতে করে খুব শিগগিরই তারা কবি খ্যাতিতে অভিষিক্ত হবে এবং ভবিষ্যতে পুরস্কার সম্মাননা ইত্যাদির প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে পুরোপুরি ‘কবি’ হয়ে যাবে। শেলির উক্তিটি আমাদের বেশির ভাগ কবিদের দিকে তাকালে মিলিয়ে নেয়া যায়। তাঁর এ বক্তব্যের মধ্যে আরো একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলো- ‘স্বার্থপরতার হিসাব-নিকাশ’ আর তা যখন মনকে নিয়ন্ত্রণ করে তখন কবিতাও তার অনুগামী হয় সেখানে মুক্তির প্রসঙ্গটি কেবলই পাথর। প্রযুক্তির উন্নয়নে সমাজচিত্র বদলে যে পরিবর্তন ধারা আজ অগ্রযাত্রামুখী প্রবহমান বাস্তবে যা জনচাহিদার ফলাফল, তাকে যতœ দেয়া আরো তীব্র করা এবং তার চেতনাজগতকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে নতুন উপমা, নতুন প্রতীক, নতুন বাকবিন্যাস ইত্যাদি আয়ত্ব চেষ্ট না হয়ে চিন্তাকে সামন্তীয় যুগের রূপকাঠামোর মধ্যে ঠেসেঠুসে বাকবিস্তার করা; কবি হওয়ার বাসনায় বিভোর থাকার জাজ্বল্যমান প্রবণতা। পাশাপাশি রহস্যময়তা, মরমীয়া জীবনবোধের সরল রূপান্তর এসবই তো এখনো কবিতা, যদিও এসব কিন্তু সেসব আরব্যরজনীর গল্প সাজানোর মতো যা তখনকার সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতকে সামনে রেখে রচিত এবং যাতে রয়েছে মানুষকে আধুনিকতার আলোকপ্রাপ্তি থেকে দূরে সরিয়ে ক্ষমতার নি¤œ চাতুরি টিকিয়ে রাখার সুবিধা। চিরকাল একদল মানুষ নির্যাতিত হয়েছে, মরেছে, দাসত্ব করেছে এবং একদল মানুষ সব সম্পদ তাদের কুক্ষিগত করে পিরামিড বানিয়েছে, মাটিতে পুঁতে রেখেছে, আয়েশের চেয়েও বেশি সম্পদ তারা হস্তগত করে দমন নিপীড়নসহ পরকাল সাধারণের উপরই চাপিয়েছে। তখনো কবিতায় ছিটেফোটা বিদ্রোহ ছিল, বেশি যা ছিল তা চাটুকারিতা, ক্ষমতাবানের স্তবস্তুতি। আজও সম্ভবত তেমন আরব্য রজনীর বোধ থেকে কবিতার মুক্তি ঘটেনি।
রাজনৈতিক টাউট ও নব্য প্রতারকরা এমন কাণ্ড করে, তারা ক্ষমতাবানদের দরবারে বা তাদের কোনো সভা সেমিনারে উপস্থিত হয়ে সময় সুযোগে নেতার পাশে দাঁড়িয়ে কিংবা নেতাকে ফুল দিয়ে ছবি তুলে যেমন নিজের ঘরে টানায়, আবার প্রতারণার অফিস ঘরে টানিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। প্রতারণার বিপত্তিগুলোকে ক্ষমতা মালিকের শক্তি সামর্থ্য ও তার উপযুক্ততা ইত্যাদিও ছায়া দিয়ে সহজ করে নেয়। কবি লেখকরাও তা করে এবং ভিড় করে প্রায়ই কোনো ক্ষমতাবান কবি সাহিত্যিকের নাম পদক্ষমতা ব্যবহার করে নিজেকে হাজির করতে চান পরিচিতির বলয়ে। ফলে আমাদের কবিতা যত না নতুন তার চেয়েও অনেক বেশি পশ্চাৎপদতার চিন্তাবাহী এবং অনাধুনিক। যদিও কবিতা নিজেই শান্তির সংবাদবাহী, নিজের পবিত্রতা শুভের দিকে। কবিতা হলো আবেগ ও বুদ্ধিদীপ্ত কল্পনার এক রসায়ন যা নতুন, নির্মিত উপমা, উৎপ্রেক্ষা, অলঙ্কার ও প্রতীক দ্বারা শোভিত। যা কবির একান্ত নিজস্ব চেতনা থেকে উৎসারিত পুরোনোকে ভাঙার জন্য। আধুনিক কবিতা কি কি বর্জন করবে তাই এখন আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিত।
আধুনিক কবিতাকে বর্জন করতে হবে অতীতের অনেক কিছু। বর্জন করতে হবে পুরোনো মানসিকতা। পুরোনো রীতিনীতি ছন্দ চাতুর্য। তাকে হয়ে উঠতে হবে স্পন্দিত এক ভাষাশৃঙ্খলার মাধ্যম; যা পাঠকের চিন্তাজগতে ওলটপালটের হাওয়া বইয়ে দেবে কখনো দিকপ্রত্যয়ী কখনো বা দিকশূন্য। তাকে বর্জন করতে হবে সেই সব প্রাচীন মোসাহেবি উপমা উৎপ্রেক্ষার বিষয়াবলি এবং ভাষার চাতুর্যে গড়ে নিতে হবে মানুষের সচেতন চেতনবাহী রূপতরঙ্গ। আধুনিক কবিতা আধুনিক সময়কে কেবল উপজীব্য করবে না তার খাদ, গাদ, তিক্ততা এবং অন্তর-বিষয়কে প্রশমিত করে মওসুমি হাওয়ার দিকে নিয়ে যাবে, যে পারঙ্গম হবে চেতনা জগতের দিকহীনতায় নতুন দিকচিহ্ন তৈরিতে। আধুনিক কবিতার কোনো প্রারম্ভ নেই কোনো শেষও নেই, থাকাও উচিত নয়- এ হলো গতানুগতিকতা, আধুনিক কবিতার প্রসঙ্গ ও প্রসঙ্গান্তর সর্বদাই ক্ষমতার ছোবলের বিষাক্ততা প্রতিহতে ইন্ধন জোগাবে এবং হয়ে উঠবে সহিসপ্রিয় আস্তাবলের ঘোড়া। কবিতা তখনই আধুনিক যখন একজন কবি মনমানসিকতায় নিজেই সময়েরও অগ্রগামী। যদিও কখনো কখনো আধুনিক কবিতা পাঠকের কাছে হইচই মনে হতে পারে, কিন্তু তা নিবিড় পর্যবেক্ষণে শৃঙ্খলারস পাইয়ে দেয়। আর তা পাঠককেই আবিষ্কার করে নিতে হয়। কেউ কেউ শুরু থেকে শেষের পারম্পার্যকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে, বাস্তবে আধুনিক কবিতার পারম্পার্য একটি অবলুপ্ত নগরী দেখা এবং তার জন্য আফসোস করার মতো নয়। কারণ বিলুপ্তি ও পুনর্জাগরণের মধ্যেই আধুনিকতা। আধুনিক কবিতা যেকোনো বিষয় নিয়ে শুরু হলেও এবং তার মধ্যে নানা ছেদপর্ব ও নতুন পর্বেরও আকস্মিকতার সূচনা থাকলেও তার একটা উদ্দেশ্যমুখিনতা থাকে এবং একটা বার্তা অবশ্যই উপস্থিত হয় যা তার সমাজ অবলোকনের মধ্যদিয়ে স্পন্দিত এবং আবেগপিষ্ট হয়ে বুদ্ধিদীপ্ত ও কল্পনায় বাস্তব ও অতিবাস্তবতার ছোঁয়াছ নিয়ে ক্ষমতাকে অস্বীকার করে ক্ষমতাকে নিজেদের দিকে ফিরাতে এবং তা সামঞ্জস্যপূর্ণ করে নিতে। স্মৃতি কাতরতা-প্রেম কাব্যশরীরের নকশা হতে দোষ কিছু নেই; কিন্তু লক্ষণীয় হবে যে, মানুষ কেবল বেদনার দাস নয়, তারও ঊষা চাই, বিকাশ চাই। আর তা হলে স্মৃতিকাতরতার রঙঢঙও বদলে যাবে। কারণ বিশ^ জীবন মানুষের বদলক্রিয়ার মধ্যদিয়ে একটা ঊর্র্ধ্বমুখী গতি দিচ্ছে, সে কেবলই শোক আর কান্নার জন্য নয়। বরং হারানো এবং অর্জনের মধ্য দিয়ে জীবনের মৌলিককে সামগ্রিক বেদনার সাথে একীভূত করে নিতে একটা নতুন সমাজ কবির কাম্য হয়ে অন্যেরও আকাক্সক্ষার সামগ্রী হবে। তাই আধুনিক কবিতার রূপায়ন বেশির ভাগ সময় কবির নিজের, নিজস্ব চিন্তা প্রতিফলনের নিঙড়ানো রস। পাঠকপ্রিয়তা কেবল পাঠকের আয়ত্ত আয়েশের মধ্যে।
আসলে সফল কবিতা তাই, যা অসফল হয়ে আছে তার ভোক্তাদের কাছে, কারণ কবিতা বাস্তবের পারম্পার্যকে মিলিয়ে পড়তে না পারলে তা অনাস্বাদিতই থেকে যায়, তাতে কবির কিছু যায় আসে না। কবিকে জানতে হয় কেবল সেইটুকু যা সে লিখেছে তা সে সততার সাথে লিখেছে কি না। কোনো চাটুকারিতা, অন্যায় স্তুতি, অসামঞ্জস্য বিধি-বিধানমালার প্রতি অন্যায় সমর্থন কিংবা নিজ পেট ভারী করার সুযোগ পাওয়া ও নেয়ার জন্য তার এ কলমযুদ্ধ নয়। সলোখভ যেমন বলেছিলেন, লেখককে অবশ্যই সৎ হতে হয়। নিজ জীবনে ঘৃণ্য মানসিকতা ও ভণ্ডামিকে সঙ্গী করে কবিতায় ভালো উচ্চারণের শব্দমালা গ্রথিত করার জালিয়াতি একজন কবির কিছুতেই করা উচিত নয় এবং আপাতত পিঠ চাপড়ানির সুযোগ পাওয়া গেলেও আখেরে এসব কবি তেলশূন্য প্রদীপের মতো অন্ধকারেই ডুবে যায়। শেলির কথায়ই শেষ করা যায়- ‘কবিতার চর্চা মানুষকে সেইসব সময়ে বেশি করতে হবে যখন স্বার্থপরতা ও হিসাব-নিকাশের বাড়াবাড়ির কারণে সুখের তুলনায় সম্পদের সংগ্রহ বেশি ভারী হয়ে পড়বে।’


আরো সংবাদ



premium cement