২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কবিতার পঙ্ক্তিতে বৈশাখ

-

বাংলা সাহিত্যে এমন কোনো কবি নেই , যিনি বৈশাখ নিয়ে কবিতা লেখেননি কিংবা কারুর কবিতায় বৈশাখ আসেনি। পরোক্ষভাবেও পয়লা বৈশাখ এসেছে- এমন কবিতার সংখ্যা নেহাৎ অল্প নয়। বাংলা কবিতায় নববর্ষ যেভাবে, যত বহুমাত্রিকতায় এসেছে- তা অন্য কোনো জাতির নববর্ষে এসেছে বলে আমার মনে হয় না। তাই বাংলা নববর্ষ এলে আমরা এক অন্য রকম আনন্দ অনুভবে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি। আমাদের কাব্যে যোগ হয় নতুন নতুন মাত্রায়, নতুন নতুন শব্দ চয়নে, নতুন নতুন ছন্দ সম্ভার, বাংলা নববর্ষ এবং বৈশাখ হয়ে উঠেছে জীবন্ত।
বাংলাদেশে এখানকার বৈশাখী উৎসবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই চির পরিচিত গান বা কবিতার মধ্য দিয়েই নতুন বছরকে বরণ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠ এই রচনা বাঙালিদের মনকে উৎসাহ দেয়। ‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ/তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি/অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক/মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা/রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি/আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ/মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক’। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ঋতু পরিবর্তনের চিত্র তুলে ধরেন। প্রকৃতির পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্যগুলো সহসা কবির উপলব্ধিতে সাড়া জাগিয়েছে। আর সে কারণে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আমাদের ভূগোল, পঞ্জিকার মাসগুলো অনায়াসে স্থান করে নিয়েছে। সেই সব মাসের উচ্চারণ যেমন প্রকৃতি দর্শন তেমনি অনুসঙ্গ কিংবা প্রসঙ্গ, কখনো তত্ত্ব-তথ্যের প্রতীকী ছোঁয়ায় নতুন ব্যঞ্জনায় ঋদ্ধ হয়ে ওঠেছে। যেমন... ‘আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে/পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি/দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি’। (আমাদের ছোট নদী) ‘আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর/মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর/মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে/ঘোলা জলে পাকগুলো ঘুরে ঘুরে ছোটে/দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া/বরষার উৎসব জেগে ওঠে পাড়া’। (আমাদের ছোট নদী) ‘এমনি করে কাজল কালো মেঘ/জ্যৈষ্ঠমাসে আসে ঈশান কোণে/এমনি করে কালো কোমল ছায়া/আষাঢ় মাসে নামে তমাল-বনে’। (কৃষ্ণকলি)
পয়লা বৈশাখ একটি অন্যরকম উৎসব। সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মেতে ওঠেন বৈশাখী মুখরতায়। শহুরে বৈশাখের পান্তা ইলিশ সংস্কৃতি নিয়ে অনেকের নানান মত আছে। শহরে ইটপাথরের জীবনে মাঝে পান্তা ইলিশ যদি সব ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে দাঁড়ালে তাতে ক্ষতি কী। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বৈশাখের স্বকীয় স্বরকে তিনি নিজ সাধনে নতুন সৃষ্টির প্রয়াস করেছেন। বৈশাখ মাস শুধু যে কাল-বৈশাখী নিয়েই প্রকৃতির প্রতি নিদারুণ উত্তপ্ত প্রকাশে থাকছে তা নয়। বৈশাখের একটি প্রধান অনুষঙ্গ হলো ‘বৈশাখী ঝড়’ সেই ঝড়ের আওয়াজ বাতাসের শনশন শব্দে গেঁথে তোলায় তার মতো কে আর মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন?
‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখী ঝড় তোরা সব জয়ধ্বনি কর/তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর/প্রলয় নূতন সৃজন বেদান/আসছে নবীন জীবন ধারা অসুন্দরে করতে ছেদন/তাই যে এমন কেশে-বেশে/মধুর হেসে/ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির সুন্দর’। বৈশাখের বৈশিষ্ট্য ধারণ করেও কবিতায় অভিনব কী অনুভূতি সংযুক্ত হয়েছে- তার অনুসন্ধান অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এখানেও বৈশাখ মাস নজরুলের মতোই বৈচিত্র্যীয় রূপে নিজেকে প্রকাশ করে। কখনো শান্ত কখনো উদাস কখনো নীল আকাশ বুকে করে নিশ্চিন্ত,কখনো কালো মেঘ সেই নীলাকাশকে গ্রাস করে বাতাস বন্ধ। হঠাৎ প্রলয় বেগে ঝড়। ক্ষণিকের প্রকৃতি ঝড় চলে গেলে শান্ত রূপ নিয়ে আনমনা হয়ে থাকে। নজরুল বৈশাখ নিয়ে নানা বৈচিত্র্যীয় চিন্তায় নিমগ্ন রইতেন। একটি কাব্যগীতির দ্বিতীয় অন্তরায় বর্ণনায় কবি নজরুল তার প্রেয়সীকে মনে করেন। অস্থির মনের বাণীতে বৈশাখী ঝড়ের বর্ণনা পাই...‘বৈশাখী ঝড়ে রাতে চমকিয়া উঠি জেগে’/বুঝি অশান্ত মম আসিলে ঝড়ের বেগে/ঝড় চলে যায় কেঁদে ঢালিয়া শ্রাবণধারা সেকি তুমি? সে কি তুমি’। এই বৈশাখী ঝড়কে কবি ‘ভাঙার গান’-এ দারুণভাবে আন্দোলিত করেছেন। গানটিতে যে ধরনের যন্ত্রসঙ্গীত ব্যবহার করার ব্যবস্থা নজরুল রেখেছেন, তাতে গানখানির সুর যে নিপুণ মার্চের তালে মনকে নাড়া দেয় সেখানে কাল-বোশেখীর প্রলয়ঙ্করী রূপের সাথে পরিবেশকে ক্ষেপিয়ে তোলে। তিনটির শেষ অন্তরায় পাই কাল-বোশেখীর কাব্যিক প্রকাশ। কাল-বোশেখীর প্রলয়ঙ্করী দাপটকে কবি নৃত্যের সাথে তুলনা করেছেন। অপূর্ব এক পৌরুষদীপ্ত রূপ প্রকাশ এখানে ফুটে উঠেছে-
‘নাচে ঐ কাল-বোশেখী/কাটাবি কাল বসে কি/দেরে দেখি/ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি/লাথি মার ভাঙরে তালা/যত সব বন্দি-শালায়/আগুন জ্বালা/আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ে’।
বাংলা সাহিত্যের মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর ‘নূতন বৎসর’ শীর্ষক চতুর্দশপদী কবিতায় বৈশাখকে দেখেছেন প্রকৃতির বহুমুখী ক্রিয়া আর বৈচিত্র্যিক রূপময়তার উৎস হিসেবে। বৈশাখ সাথে তিনি খুঁজে পেয়েছেন মানব মনের মিল এবং সে মিলে দেখেছেন মানুষের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের প্রভাব। আর চিরন্তন ঋতুচক্রের পরিবর্তনিক বোধের অনুপমতায় সুখ-দুঃখ আর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিহ্বলতা তাই বলেন।... ‘ভূত-রূপ সিন্ধু-জলে গড়ায়ে পড়িল/বতসর, কালের ঢেউ, ঢেউর গমনে/নিত্যগামী রথচক্র নীরবে ঘুরিল/আবার আয়ুর পথে। হৃদয়-কাননে/কত শত আশা-লতা শুখায়ে মরিল/হায় রে, কব তা কারে, কব তা কেমনে/কি সাহসে আবার বা রোপিব যতনে/সে বীজ, যে বীজ ভূতে বিফল হইল/বাড়িতে লাগিল বেলা, ডুবিবে সত্বরে/তিমিরে জীবন-রবি। আসিছে রজনী/নাহি যার মুখে কথা বায়ু-রূপ স্বরে/নাহি যার কেশ-পাশে তারা-রূপ মণি/চির-রূদ্ধ দ্বার যার নাহি মুক্ত করে/ঊষা-তপনের দূতি, অরুণ-রমণী’। অতীতের সব সুখ-দুঃখ ভুলে নতুন করে শুরু করার বার্তা নিয়ে আসে নববর্ষ। বাঁচতে শেখায় নতুন করে। কর্মময় পৃথিবীতে কেউ কর্মহীন নয়। কবি কায়কোবাদ তার ‘নববর্ষ’ কবিতায় এ সুরেই কথা বলেছেন... ‘ও হে পান্থ/অতীতে সুখ-দুঃখ ভুলে যাও তুমি/অই যে ব্রহ্মা-জুড়ে/সম্মুখে রয়েছে পড়ে/তোমার সে কর্মক্ষেত্র-মহারঙ্গাভূমি/অই ক্ষুদ্র জলবিন্দু/অথবা অসীম সিন্ধু/কর্মহীন নহে কেহ, কর্মময় সব/উন্নত উন্নতি-পথে/ছুটেছে কালের রথে/বিবর্তন-চক্র সাদা ঘুরিয়ে নীরব’।
পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের বর্ণনায় উঠে এসেছে গ্রাম-বাংলায় বৈশাখের বৈচিত্র্য। চৈত্রের প্রকৃতিকে তুলনা করেছেন সাদা শাড়ি পরা বিধবার সাথে। নদীর পারে হাওয়ায় দোলা ধানের শীষকে তুলনা করেছেন শাড়ির সোনালি পাড়ের সাথে। এতটা কাছ থেকে খুব কম চোখই প্রকৃতির রূপ দেখতে পায়। বৈশাখকে তিনি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এক ধরনের ভালোবাসার তাঁর সাহিত্যকর্মে। কালের নতুন যাত্রাকে স্বাগত জানানোর পয়লা দিনে কোমলতা দিয়ে নির্মাণ করেছেন বৈশাখকে। বোশেখ পরস্পরের সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি কামনার দিন উৎসব আর আনন্দের দিন।...‘বোশেখ শেষে বালুচরের বোরো ধানের ধান/সোনায় সোনা মিলিয়ে দিয়ে নিয়েছে কেড়ে প্রাণ/বসন্ত সে বিদায়বেলায় বুকের আঁচলখানি/গেঁয়ো নদীর দু’পাশ দিয়ে রাখায় গেছে টানি/চৈত্র দিনের বিধাব চরের সাদা থানের পরে/নতুন বরষ ছড়িয়ে দিলো সবুজ থরে থরে/না জানি কোন গেঁয়ো তাঁতি গাঙ চলিবার চলে/জয়-ছোঁয়া তার শাড়ির কোণে পাড় বুনে যায় চলে/মধ্য চরে আউশ ধানের সবুজ পারাবার/নদীর ধারে বোরো ধানের দোলে দোলে সোনার পাড়’। বন্দে আলী মিয়ার কবিতায় উঠে এসেছে বৈশাখে কৃষকের ব্যস্ততা। ধু-ধু প্রান্তরের ছবি এঁকেছেন শব্দের তুলিতে। গাঁয়ের মানুষ কেউ কারো পর নয়, সবাই যেন একই পরিবারের আপনজন কবি সে কথাও বলেছেন ‘বোশেখের মাঠ’ কবিতায় বলেছেন... ‘বোশেখ শেষের মাঠে ঘিরে আছে তিন চারখানা গাঁও/এ-পারে ও-পারে ছড়াছড়ি ঢের দেখাশোনা হয় তা-ও/ও গাঁয়ের মেয়ে এই গাঁ এসেছে পরের ছেলের ঘরে/এ-পাড়ার মেয়ে গেছে ওই পাড়া চিরদিনেকের তরে/কেহ পানি নিতে, নাহিতে বা কেহ মেয়েরা আইসে ঘাটে/পুরুষেরা যায় হাল চষিবারে নারাণপুরের মাঠে/সেই খানে এরা সুখের দুখের ঘরের কাহিনী কয়/সকলের সাথে সকলেরি ভাব কেহ যেন পর নয়’। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী বৈশাখকে দাবদাহ আর প্রাকৃতিক বিক্ষুব্ধতার আলেখ্যে তুলে ধরেছেন।এমন রতœ প্রকৃতি, বাড়ি, বাড়ি মাংস বিক্রেতা ফুল্লরার জীবনে কী বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল কাব্যে তা তুলে ধরা হয়েছে...‘বৈশাখে অনলসম বসন্তের খরা/তরুতল নাহি মোর করিকে পসরা/পায় পোড়ে খরতর রবির কিরণ/শিরে দিতে নাহি আঁটে খুঞ্চার বসন/নিযুক্ত করিল বিধি সবার কাপড়/অভাগী ফুল্লরা পরে হরিণের দুড়/পদ পোড়ে খরতর রবির কিরণ/শিরে দিতে নাহি আঁটে অঙ্গের বসনা বৈশাখ হৈল আগো মোর বড় বিষ/মাংস নাহি খায় সর্ব্ব লোকে নিরামিষ’।
কবি ফররুখ আহমদ বৈশাখকে দেখেছেন নানা চোখে। কখনো চৈত্রের বিশীর্ণ পাতায় গেল বছরের চিহ্ন। শস্য-শ্যামলিমাহীন ঊষর প্রান্তর। মৃত্যুর ভয়ঙ্কর রূপ। কখনো বিজয়ী বীরের সাথে তুলনা করেছেন বৈশাখকে। কখনো পূর্ণকালে মৃত্যু ভীরু শান্তিসম, রুদ্র কেশের চক্র চাই না দেবী এইভাবে কান্তসম। তার আরেকটি বিশিষ্ট হলো বৈশাখ আসে নতুন বছরের খবর নিয়ে, কালবৈশাখীর খবর নিয়ে। যার কবিতা লুকিয়ে রয়েছে এক তাণ্ডবময় অনুভূতি। কবি ফররুখের কবিতায় বৈশাখ স্থান করে নিয়েছে এক ঝড়ো নকশা হয়ে।
কখনো আবার বৈশাখকে বিমূর্ত করেছেন মহাশক্তিধররূপে। এ ক্ষেত্রে তিনি সম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছেন। যেমন ‘বৈশাখের কালো ঘোড়া উঠে এলো, বন্দন শহর/পার হয়ে সেই ঘোড়া যাবে দূর কোকাফ মুলুকে/অথবা চলার তলে ছুটে যাবে কেবলি সম্মুখে/প্রচণ্ড আঘাতে পায়ে পিষে যাবে অরণ্য প্রান্তর’। আবার বৈশাখকে ডেকেছেন ধ্বংসের নকিব বলেও। ফিরে আসতে বলেছেন সুন্দর হয়ে। বিক্ষত প্রাণে পথ চিনে আসতে বলেছেন।
বৈশাখের প্রাণের তাপে জীবনের সব ক্লেদ আর গ্লানি মুছে দিতে চেয়েছেন তিনি।
‘ধ্বংসের নকিব তুমি হে দুর্বার দুর্ধর্ষ বৈশাখ/সময়ের বালুচরে তোমার কঠোর কণ্ঠে/শুনি আজ অকুণ্ঠিত প্রলয়ের ডাক/চৈত্রের বিশীর্ণ পাতা রেখে গেছে, শেষ চিহ্ন সালতামামীর/ফাল্গুনের ফুলদল আজ শুধু কাহিনী স্মৃতির/খররৌদ্র অবসন্ন রাহী মুসাফির যত পক্ষ প্রান্তে নিঃসাড় নিশ্চল’।
বৈশাখ মানেই যেন প্রকৃতির প্রলয় নিত্য। ঝড় পাখির নীলিমা জয়। সব ছুঁড়ে-ছিঁড়ে ফেলার এক ছিন্ন ভিন্ন ছবি। কবি সিকান্দার আবু জাফরের শব্দের বুননে...‘উদ্দাম ঝড়ের পাখি দুই ডানা মেলে/পশ্চাতের পথ-প্রান্তে সম্মুখের ফেলে/ছুটে যায় গ্রহে উপগ্রহে/ক্ষুধিত আক্রোশ নিয়ে উদ্ধত বিদ্রোহে।/এক ডানা আনে তার শ্রাবণের স্নেহ-স্নিগ্ধ-ভাষা/অন্য ডানা মেলে দেয় বর্জ্রের জিজ্ঞাসা’। (বৈশাখ) চৈত্রের স্মৃতি কান্না বুকে চেপে আসে বৈশাখ। চোখে তখন নতুন দিনের আলো জ্বলে। পথের পাশে ঝরে থাকা পাতায় ধূসর অতীতের দেখা মেলে বৈশাখে। কবি শামসুর রাহমান কত সুন্দর করেই না বলেছেন... ‘হৃদয়ে জড়ানো চৈতি স্মৃতির কান্না/দৃষ্টিতে জ্বলে জীবন রাঙানোর পান্না/জীবন দৃপ্ত ধু-ধু প্রান্তর বলছে আজ’। (বৈশাখের গান) বৈশাখে মেঘের কান্নায় আকাশ কেঁপে ওঠে। বাতাস ঝড়ের গন্ধ ছড়ায়। শূন্য ডালে হঠাৎ ঝাঁকি লাগে।- ‘শূন্য ডালে হঠাৎ হাওয়ার লাগলো ঝাঁকি/এই তো আবার এসেছে দিন বৈশাখী/স্বপ্ন ছাওয়া মঞ্জু শাখে/অনেক কিছু চাওয়ার থাকে/এই কথাটি যায় বলে যায় নতুন পাখি’। নতুন বছরে মঙ্গলই সবার কামনা। অতীতের সব ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে যেতে চান নতুন উদ্দীপনায়। সব ক্লান্তি দূরে ঠেলে নতুন উদ্যম ফিরে পাওয়ার সেই কী আকুতি। ‘আমার দু’চোখে তোমার দাহন জ্বালো/নয়া দিগন্তে আনো বৈশাখী আলো/হতাশার কালো মুছে যাক/এসো আশা নিয়ে বৈশাখ/সৃষ্টির দিকে মিছিলের মুখ/ঘুরিয়ে দাও’। বৈশাখকে তুলনা করেছেন বিভেদের লাঙ্গলের সাথে। প্রকৃতির সব কিছু যেন ভাগ দেয় নিমিষেই।
কবি বেলাল চৌধুরী তাই বলেছেন...‘নিঃসঙ্গ আকাশে যায় উঠে যায় চৈত্রের হাওয়া/পাতারা ওড়ে ঘরময় আনাচে-কানাচে কানবে/আলো ছায়ায় নকশা ভাঙে সাদা কাগজে’। আকাশে বৈশাখের বিভা দেখেছেন কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ। সূর্য আর মেঘের মিলন দৃশ্য তুলে এনেছেন শৈল্পিক বর্ণনায়।
‘পুবে সূর্য/পশ্চিম আকাশে কালো/উত্তর আকাশে তামা/এমনি করে এলো পয়লা বৈশাখ আমার/...পুব থেকে সূর্য যেন এক প্রবল ঘোড়ার পিঠে চড়ে/ক্রমাগত ছুড়ে মারছে রুপার তীর’। ‘আকাশগঙ্গায় ঘুরপাক’ কবিতায় কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা তুলে এনেছেন ঋতু বদলের রঙ। ইতিহাস-ঐতিহ্যের মিলন ঘটিয়েছেন এখানে। স্বর্গ-মর্ত্য একাকার করেছেন বৈশাখী আহ্বানে। ‘আজ য়ুসুফ জেগেছে জোলেখার সঙ্গে/নাচে রাধাশ্যাম গাঙ্গেয় বঙ্গে/পুরুষকেশর রমণীকেশরী/মনযমুনায় পারাণির কড়ি/দূরে ও বেদূরে বীজের ফারাক/আজ ভালোবাসা ঝোড়ো মৌচাক/সময়জমিন যাক ছিঁড়ে যাক’।
আধুনিক বাংলা কবিতার প্রকৃতির কবি যাকে বলা যায় সেই জীবনানন্দ দাশও তার কবিতায় বৈশাখি কামনাভরা জীবনের ছবি এঁকেছেন। চিরজীবী করে রেখেছেন প্রকৃতির সাথে মানুষ আর ইতিহাসকে বিলীন করে দিয়ে। তাঁর কবিতায় হৃদয়ানুভূতি যেমন অবিনাশী তেমনি বিস্তৃত, প্রাণগতিক ও মোহনীয়। বৈশাখকে তিনি দেখেছেন শুভ্রতার প্রতীক, মেঘের ভেলা আর সাদা কড়ির মিলন। ঘুমিয়ে পড়ব আমি কবিতায় ধ্বনিত হয়েছে প্রকৃতির অনাবিলতায়।... ‘ঘুমিয়ে পড়ব আমি এক দিন/তোমাদের নক্ষত্রের রাতে/শিয়রে বৈশাখ মেঘ সাদা/যেন কড়ি শঙ্খের পাহাড়’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কঠিন রাজনৈতিক বাস্তবতায় বৈশাখের মাটিতে দেখা দেয় ফাটল তার মেঘ বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ নয়, তার মেঘ কড়ি-শঙ্খের পাহাড়। তার কবিতায় বৈশাখের জোছনার রাত ছায়াময় আর রৌদ্রের দিন রঙিন। গ্রীষ্মের রঙিন রোদ্দুর বিলাসে মেতে ওঠেন। উষ্ণতাভরা বৈশাখের চিত্রে লিখেছেন...‘বৈশাখের মাঠের ফাটলে/এখানে পৃথিবী অসমান/আর কোনো প্রতিশ্রুতি নেই/কেবল খড়ের স্তূপ পড়ে আছে দুই-তিন মাইল/তবু তা সোনার মতো নয়/কেবল কাস্তের শব্দ পৃথিবীর কামানকে ভুলে/করুণ, নিরীহ, নিরাশ্রয়’।
বৈশাখের আগমনে প্রকৃতি যেমন নব রূপ গ্রহণ করে, তেমনি কবি সিকান্দার আবু জাফর মনে করেন বৈশাখকে মানব মনেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগা স্বাভাবিক। তবে সে পরিবর্তন দিগি¦জয়ী সম্ভাবনা হিসেবে দেখেছেন। পুরাতনকে মুছে ফেলে নতুন উল্লাসে হোক কল্যাণমুখী ও সৃষ্টিশীল। মানুষের অস্তিত্ব রক্ষায় এ ধরনের পরিবর্তন নতুন জীবন শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন। কবি বৈশাখকে প্রকৃতি ও মানুষের নবরূপে জেগে ওঠার জয়গান গেয়েছেন। বৈশাখ কবিতায় বলেছেন বর্ষ শেষ দিবসের অশ্রুতে শীর্ণ পাতাগুলো স্পর্শ করি বৈশাখের “এসো এসো এসো হে নবীন এসো এসো হে বৈশাখ এসো আলো রুক্ষ পথ ধূলি... বর্ষে বর্ষে বৈশাখের নিত্য মত্ত অভিযান /কে জানে দুমূল্য এসো হে প্রাণ ডাক কালবৈশাখীর ডাক/বাতাসে আলো ঝড়ের সুর/যুক্ত কোনো বিস্ময়ের কুণ্ঠিত সন্ধান।” করো নিকট দূর/যুক্ত করো শতাব্দীতে দিনের প্রতিদানে ।
কবি গোলাম মোস্তফা অতীতের দুঃখ-হতাশা-শোক ভুলে নতুন জানিয়েছেন আহ্বান। নতুন বছরে নতুন সুখ-সমৃদ্ধির কামনা নিয়ে এগিয়ে চলবার ধুম জটা ধূমকেতুর ওই পুচ্ছসম দীর্ণ করি জীর্ণ ধরা ডাক দিয়েছেন।
কবি ‘নববর্ষের আশীর্বাদ’ শীর্ষক কবিতায় লিখেছেন...“ওই এলোরে ওই এলো/ নূতন বরষ ওই এলো/তরুণ তপন উঠলো রে/ধাবন্ত তিমির ছুটলোরে/...নওরোজের এই উৎসবে/ওঠ জেগে আজ ওঠ সবে/সুপ্ত ভাঙ্গা চোখ খোলো/দুঃখ হতাশ শোক ভোলো/চাও কেন আর পশ্চাতে/চাইলে হবে পসতাতে/হও আজিকে অগ্রসর/নূতন আশায় ব্যগ্রতর... “নববর্ষকে কেন্দ্র করে নতুন করে ভাবেন। আর এ ভাবনাই প্রতিফলিত হয় বৈশাখ। তিনি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এক ধরনের ভালোবাসা তার সাহিত্যকর্মে ফুটে উঠেছে।
কালের নতুন যাত্রাকে স্বাগত জানানোর দিনে কোমলতা দিয়ে তিনি নির্মাণ করেছেন বৈশাখকে। বোশেখ পরস্পরের সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি কামনার দিন কবি যেমন বলেছেন- “বোশেখ শেষে বালুচরের বোরো ধান/সোনায় সোনা মিলিয়ে দিয়ে নিয়েছে কেড়ে প্রাণ/ বসন্ত সে বিদায়বেলায় বুকের আঁচলখানি/ গেঁয়ো নদীর দু’পাশ দিয়ে রাখায় গেছে টানি/চৈত্র দিনের বিধাব চরের সাদা থানের পরে/নতুন বরষ ছড়িয়ে দিলো সবুজ থরে থরে”।

 


আরো সংবাদ



premium cement
রাজশাহীতে তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি রাজশাহীতে টানা তাপদাহ থেকে বাঁচতে বৃষ্টির জন্য কাঁদলেন মুসল্লিরা শরীয়তপুরে তৃষ্ণার্ত মানুষের মাঝে পানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ জামায়াতের এক শ্রেণিতে ৫৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী নয় : শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী নজিরবিহীন দুর্নীতির মহারাজার আত্মকথা ফতুল্লায় ১০ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে নির্মাণকাজ বন্ধ, মারধরে আহত ২, মামলা পার্বত্যাঞ্চলে সেনাবাহিনী: সাম্প্রতিক ভাবনা গফরগাঁওয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে টিকটক করতে গিয়ে স্কুলছাত্রের মৃত্যু তানজানিয়ায় বন্যায় ১৫৫ জনের মৃত্যু বাংলাদেশসহ এশিয়ার ৩ দেশে কাতার আমিরের সফরে কী লাভ ও উদ্দেশ্য? মধুখালীর ঘটনায় সঠিক তদন্ত দাবি হেফাজতের

সকল