১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গল্পের ভেতর বাহির

গল্পের ভেতর বাহির -

প্রতিটি কাজেরই একটি নির্দিষ্ট নিয়ম বা কৌশল আছে। লেখার ক্ষেত্রেও তাই। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, কিংবা মহাকাব্য যাই লিখি না কেন, প্রতিটি লেখার একটা নিজস্ব নিয়ম একজন লেখককে আয়ত্ত করেই সাহিত্যের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। একটি সার্থক গল্প লেখার জন্য একজন লেখককে যে কত কিছু ভাবতে হয়, তা কল্পনা করা যায় না। আমার বড় ছেলে মাহিব সেদিন আমার একটি গল্প পড়ে বলল, আব্বু তুমি গল্পটা এখানে শেষ করলা কেন ? আরো লিখতে। আমি ভাবলাম, ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’। রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের সংজ্ঞাটির কথা মনে পড়ল। তাহলে আমার গল্পটা সার্থক গল্প হয়েছিল। কারণ আমি পাঠকের ভেতর তৃষ্ণা জাগাতে পেরেছিলাম। তবে সবসময় যে ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা হবে তাও ঠিক নয়।
ছোটগল্পের মূল বিষয় হচ্ছে, দ্বন্দ্ব বা সংঘাত। এই দ্বন্দ্ব বা সংঘাত হতে পারে। দুটি চরিত্রের মধ্যে দুটি পরিস্থিতির মধ্যে, অন্তর্দ্বন্দ্ব, মানুষ ও পরিস্থিতির মধ্যে। অনেকে ছোটগল্পের মধ্যে প্রেমিক-প্রেমিকার পুরো জীবন, পরিবারের সব সমস্যা, এমনকি দেশের যাবতীয় সমস্যাও নিয়ে আসেন। ফলে ছোটগল্প তখন উপন্যাস হয়ে যায়। ছোটগল্পে মানুষের জীবনের ছোট ছোট অংশকে তুলে ধরার চেষ্টা করতে হবে। মানুষের জীবনে অপ্রত্যাশিত ঘটনা ও তার জের তুলে ধরতে হবে। সাধারণত অনূর্ধ্ব ৫০০০ শব্দের গল্পকে বলা হয় ছোট গল্প। কত শব্দে গল্প লিখতে হবে এ রকম ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। বনফুলের ছোট গল্পগুলো পড়লে বুঝা যায়, অল্প শব্দেও ভালো গল্প লেখা যায়। অকারণে গল্পকে টেনে দীর্ঘ করা আমি পছন্দ করি না। গল্পকার গল্পের বাকি কাজটি পাঠকের জন্য রেখে দিতে পারেন। অবচেতনে পাঠকের মস্তিষ্কে তা ঘটতে পারে।
গল্পের প্লট পাবেন কোথা থেকে? এর উত্তর হচ্ছে গল্পের প্লট আসতে পারে সূত্র থেকে। নিজের অভিজ্ঞতা, অপরের অভিজ্ঞতা, পত্র পত্রিকার সংবাদ। পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন সমসাময়িক ঘটনা, ঐতিহাসিক ঘটনা ইত্যাদি। আপনার পরিচিতজনের সাথে কথা বলুন। তাদের জানুন, তাদের কাছ থেকে প্লট পেতে পারেন। দেশে এবং সম্ভব হলে বিদেশে ভ্রমণ করুন। বিভিন্ন স্থানে যান, যেমন- এয়ারপোর্ট, রেলওয়ে স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট, পার্ক, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, শপিং মল, স্টেডিয়াম, হসপিটাল, ক্লিনিক, ডাক্তার উকিলের চেম্বার ইত্যাদি। পাশাপাশি অনেক বই পড়তে হবে।
লক্ষ করুন ওইসব বইয়ের লেখকরা কোন ধরনের প্লট ব্যবহার করেছেন। গল্পটি লেখার পর আপনার কোন স্বজনকে সেটা শোনাতে হবে এবং লক্ষ করুন তার প্রতিক্রিয়া কী হয়। সে যদি গল্পের শেষটা জানার জন্য আগ্রহী থাকে, তাহলে বুঝবেন আপনার লেখাটি একটি গল্প হয়েছে। সাধারণত প্লটের তিনটি অংশ থাকে। শুরু, মধ্যম ও শেষাংশ। গল্পে মানানসই পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
ছোটগুল্পের শেষে একটা চমক বা টুইস্ট (ঞরিংঃ) থাকা উচিত। অর্থাৎ অভাবিত বা অপ্রতাশিত কিছু ঘটা উচিত। বনফুলের চোখ গেল গল্পের শেষ লাইনে চমক হচ্ছে যে, প্রেমিক বুঝতে পারে যে প্রেমিকা স্বেচ্ছায় নিজেকে অন্ধ করেছে। তবে চমক ছাড়াও গল্প শেষ করা যেতে পারে। কেউ কেউ গল্পের প্রথম প্যারাতেই চমকপ্রদ কিছু লিখে শুরুতেই মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেন। কিন্তু এ ধরনের সাসপেন্স পুরো গল্পে বজায় রাখাটা কঠিন হতে পারে। বড় গল্পের কাঠামো হতে পারে ছয়টি উপাদানের ওপর ভিত্তি করে। কে, কোথায়, কখন, কি, কেন, কীভাবে। অনেকে এ কাঠামোকে হ-র কাঠামো বলেন, হু, হোয়ার, হোয়েন, হোয়াট, হোয়াই এবং হাও।
প্রতিটি গল্পের নাম মানানসই হওয়া খুব দরকার। কেউ কেউ হয়তো একটি নাম স্থির করে গল্প লেখা শুরু করেন। ভালো হবে, গল্প লেখা শেষের পরে নাম স্থির করা। তাহলে গল্পের মূল সুরের সাথে সম্পর্ক রেখে নাম দেয়া সম্ভব হবে। অথবা গল্পের শেষে চমকের সাথে সঙ্গতি রেখে নাম দেয়া সম্ভব হবে। অনেকেই, নায়ক অথবা নায়িকার নামে গল্পের নাম রাখেন। এটা সহজপথ। কিন্তু এতে গল্পের প্রতি কৌতূহল বাড়ে না। গল্প পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ে না। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কিছু ছোটগল্পের নাম মনে করুন, যেমন বনফুলের চোখ গেল, পাঠকের মৃত্যু, আত্ম-পর, সমাধান ইত্যাদি। ভেবে দেখুন, এসব নাম কেন দেয়া হয়েছিল ? চরিত্রগুলোর নাম গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে। অনেকেই নায়ক নায়িকা এবং বিভিন্ন চরিত্রের সুন্দর বা কাব্যিক নাম দেন। যেমন নায়িকার নাম মৌনতা। মৌ নামটি প্রচলিত। কিন্তু মৌনতা নামটি শোনা যায় না বললে চলে। কেউ কেউ নায়ক-নায়িকার জুটিবদ্ধ নাম দেন। যেমন বর্ষণ (নায়ক) ও বৃষ্টি (নায়িকা) শ্রাবণ (নায়ক) ও মেঘলা (নায়িকা)। এ রকম থিমেটিক জুটিবদ্ধ নাম দিলে মনে হতে পারে, জন্মের সময়ই তাদের ভাগ্যে লেখা ছিল যে ভবিষ্যতে তাদের দেখা হবে এবং প্রেম হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা তো কমই হয়। সুতরাং গল্পকে বাস্তবমুখী রাখতে হলে এ ধরনের থিমেটিক জুটিবদ্ধ নাম পরিহার করা উচিত হবে। গল্পকে বিশ্বাসযোগ্য করার লক্ষ্যে খুব সাধারণ নাম বেছে নেয়া উচিত। গল্পের বিষয়বস্তুর প্রতি সঙ্গতিপূর্ণ নাম ব্যবহার করা যেতে পারে। চরিত্রের পুরো নাম প্রথমে দেয়া যেতে পারে যেমন আসাদ চৌধুরী, এরপর শুধু আসাদ লেখা উচিত। লেখকের নিজের নাম দেবেন না। লেখকের নিজের নাম অলিখিত থাকলে গল্পটি আরো সর্বজনীন হতে পারে। গল্পের চরিত্রগুলোর বয়স সম্পর্কে পাঠকের একটা আচ করা যেন সম্ভব হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সন, তারিখ, সময় এবং বার লিখতে হবে। পরোক্ষভাবেও বয়স বোঝানো যেতে পারে, যেমন, তখন সে ক্লাস এইটে পড়ত। ত্রিশোর্ধ ম্যানেজার সাহেব, অথবা মধ্যত্রিশ বয়সী ম্যানেজার সাহেব। কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির জন্ম ও মৃত্যু তারিখ এবং বয়স উদ্ধৃত করলে সেটা অবশ্যই চেক ও রি-চেক করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে ভুল তথ্য দিলে লেখক অজ্ঞরূপে প্রমাণিত হবেন এবং তার লেখা বিশ্বাসযোগ্য হবে না।
আমরা দৈনন্দিন কথা বলার সময় সহজ ভাষায় বললেও, কেউ কেউ লেখার সময় কিছুটা কঠিন ভাষা প্রয়োগ করেন। যেমন- অনেক দিন অতিবাহিত হয়ে গেল এর বদলে সহজভাবে লিখুন। অনেক দিন কেটে গেল। অথবা অনেক দিন চলে গেল। ডায়ালগ বা সংলাপ আকর্ষণীয়, বুদ্ধিদীপ্ত এবং গল্পকে টেনে নেয়ার গুণসম্পন্ন হতে হবে। কেউ কেউ ডায়ালগকে সুদীর্ঘ এবং তাৎপর্যবিহীন করে শুধু পাতা ভরাট করেন। এ ধরনের তাৎপর্যহীন সংলাপ পরিহার করুন। স্রেফ চা খাওয়া নিয়ে লাইনের পর লাইন লিখে পৃষ্ঠা বাড়ানোর দরকার নেই। বারবার মিনু বললো, দীপু বলল, লেখার দরকার নেই। প্রথমেই প্রতিষ্ঠা করুন কথাগুলো। কে বলছে। তৃতীয় অথবা চতুর্থ লাইনের পর থেকে নাম দেয়ার দরকার নেই। তবে সংলাপের কোনো পর্যায়ে খেই হারিয়ে না ফেলে সেজন্য সংলাপে আবার চরিত্রদের নাম উল্লেখ করতে হবে। কেউ কেউ তাদের গল্পে গ্রামীণ সংলাপ ব্যবহার করেন। সম্ভবত তারা মনে করেন এর ফলে গল্পটা বাস্তবমুখী হয়। কিন্তু এ ধারণা ভুল। গ্রামীণ চরিত্র সৃষ্টি করতে হলে গল্পে গ্রামীণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সংলাপের মধ্যে গ্রামীণ শব্দ দু-একটি ব্যবহার করা যেতে পারে। দু-একটি লাইন গ্রামীণ শব্দে লেখা যেতে পারে। কিন্তু বাদবাকি সব লিখতে হবে ডিকশন বা অভিধানে যে শব্দ আছে, সে ভাষায়। রিয়ালিজম প্রতিষ্ঠার জন্য আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগের দরকার নেই।
কোটেশন বা উদ্বৃতি গল্পে ব্যবহার না করাই উচিত প্রেমের গল্প লিখতে গিয়ে অনেকে রবি ঠাকুরের কবিতা অথবা অন্য কারো গানের কিছু কলি ব্যবহার করেন। কেউ কেউ সুনীল গঙ্গোপ্যাধ্যায়ের গদ্য সাহিত্যের কিছু লাইন কোট করেন। লেখকের উচিত নিজের গুণে গুণান্বিত হওয়া অপরের লেখা ধার করা উচিত নয়। তবে আবহ সৃষ্টির জন্য কিছু বিখ্যাত কলি, পঙ্ক্তি বা লাইন ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু কোটেশন ব্যবহার করলে সেটা বর্ণে বর্ণে সঠিক হতে হবে। ক্লিশে বা বহুল ব্যবহৃত বাক্য কম লিখা উচিত। যেমন সুডৌল স্তন। স্তন হলেই কি সুডৌল লিখতে হবে ? মুক্তার মতো হাসি, পরীর মতো সুন্দর, হরিণীর মতো চোখ, এসব বহুল ব্যবহৃত বর্ণনা দেয়া উচিত হবে না। নতুন ধরনের বর্ণনা দিতে হবে অথবা লিখুন সে খুব সুন্দর ছিল। অনেকে লেখেন, সে অসম্ভব সুন্দর ছিল। অসম্ভব শব্দটির প্রয়োগ ভুল। অসম্ভবই যদি হবে তাহলে মেয়েটি সুন্দর হলো কী করে ? আধুনিক রূপক এবং নতুন ধরনের সব বিশ্লেষণ ও বাক্য বিন্যাস করতে হবে।
কেউ কেউ গল্প সুন্দরভাবে শুরু করে শেষাংশে গিয়ে নায়ক বা নায়িকার আচমকা মৃত্যু দিয়ে গল্পটির সমাপ্তি টানেন। এ ফর্মূলা বিশ্বাসযোগ্য নয়- গ্রহণযোগ্যও নয়। গল্পে কারো মৃত্যু ঘটাতে হলে আগে থেকেই তার জন্য একটা আবহ বা পটভূমিকা সৃষ্টি করতে হবে। তার মৃত্যু ঘটলে তার কিছু পারিপার্শ্বিক বর্ণনা দিতে হবে। গল্পের সমাপ্তি কীভাবে টানবেন, সেটা গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে। শুরুতেই স্থির করতে হবে কোন টেন্সে লিখবেন। পাস্ট টেন্সে লিখলে সহজতর হবে। যে টেন্সে প্রয়োগ করুন না কেন- সেটা গল্পজুড়ে একই রাখতে হবে। শুরুতেই স্থির করতে হবে প্রথম পুরুষে লিখবেন না, তৃতীয় পুরুষে লিখবেন? যে ধারাতেই লেখা স্থির করবেন পুরো গল্পজুড়ে সেই ধারা অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। অনেকের মতে তৃতীয় পুরুষে লেখা সহজতর।
মনে রাখতে হবে নিজের মধ্যে যদি কিছু না থাকে, তাহলে পরকে আমি কী দেব? নিজের অভিজ্ঞতা অর্জনের সামর্থ, সময় বা সুযোগ না থাকলে অন্যের অভিজ্ঞতার সাহায্য নিতে হবে। সেটা সম্ভব হতে পারে বই পড়ে। সুতরাং বই ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আর একটা কথা মনে রাখা দরকার গল্পে লেখার ক্ষেত্রে টেকনিক একাই যথেষ্ট নয়। আবেগও থাকতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement