২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

মুস্তফা হাবীবের বৈষয়িক ভ্রমণ

-

দশক গণনার হিসেবে প্রতি দশকই কবিতার বিষয় ও আঙ্গিক বিশেষ করে প্রতি দশকের লক্ষণগুলো পূর্ববতী দশক থেকে আলাদা হতে দেখা যায়। ভাষা বদল ও আঙ্গিক বিন্যাসের কারণ প্রবণতাগুলোও পৃথক হতে দেখি। কবিতায় দশকওয়ারি বিবেচনা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও অসংখ্য কবিকে শনাক্ত করা, তাদের কবিতার কাব্য বিচার-সর্বোপরি একটি দশকের সময়কালের বিশ্লেষণ এ পদ্ধতিতে হয়ে ওঠে সহজসাধ্য।
পরিবর্তনশীল সমাজকাঠামোর মধ্যেই মানুষের জীবন-মান, তার দৃষ্টিভঙ্গি, তার শ্রেয়চেতনার ক্ষতি-বৃদ্ধি যেমন হয়েছে তেমনি সব কবির কবিতার প্রবণতা কখনোই এককেন্দ্রিক থাকেনি। প্রযুক্তির বিকাশে নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই এ সময় কবিরা অতিমাত্রায় যুক্ত হয়েছেন নতুন দুনিয়ার ভার্চুয়াল জগতে। নিজর মতো করেই অনেক কবিতা লিখেছেন, পড়েছেন এবং ফেসবুকের মাধ্যমে অন্যকে পড়তে দিয়েছেন।
একটু ফিরে তাকাই...। কবিতায় ছন্দ ব্যবহারের অনাসক্তি গত শতকের আশির দশক থেকে শুরু হয় পরবর্তী দশকগুলোতে ক্রমেই বাড়ছে। শূন্য ও প্রথম দশক এই অনাসক্তি বহুগুণ বাড়ছে। অর্থাৎ ‘ছন্দমুক্তি’র বিষয়টি এক বৃহৎ অংশের কবির কবিতায় আমরা লক্ষ করি। যুক্ত হয়েছে বিষয়হীনতা। কেউ কেউ বলেন, কবিতায় কোনো বিষয়েরই প্রয়োজন নেই। বিষয়ই যদি না থাকে তা হলে শুধু আঙ্গিকসর্বস্ব শব্দরাজি পাঠকের চিন্তার মধ্যে কিভাবে প্রবেশ করবে? এর বিপক্ষে খুব লম্বা ফিরিস্তি দেয়া যায় কি? লিখতে বসছি কবি মুস্তফা হাবীবের কবিতা নিয়ে।
মুস্তাফা হাবীবের জন্ম ১৯৬৫ সালর ১ জানুয়ারি। সেই হিসাবে আমরা কবি মুস্তফা হাবীবকে আশির দশকের কবি বলে বিবেচনা করতে পারি। উপর্যুক্ত আলাচনায় মুস্তফা হাবীবের কবিতা কোনো কাঠামোয় আমরা ফেলতে পারি? আমার কাছে এ মুহূর্ত তার তিনটি কাব্য রয়েছে। বই তিনটির নাম, এক মুঠা স্বর্ণকমল (২০১৫); নন্দিতার সেই চিঠি (২০১৭) এবং যে ঠাঁটে বসন্তের সৌরভ (২০১৯)। এর আগে তার আরো তিনটি কাব্য বেরিয়েছে যথাক্রমে- স্বপ্নের মুখোমুখি জীবন, একটু দাঁড়াও সুমিত্রা ও নিসর্গ রমণী নামে।
আপাদমস্তক প্রেমের কবি মুস্তফা হাবীব। কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘আমি কখনো বৃদ্ধ হবো না’। তার তিনটি কাব্যেই আমরা চিরাচরিত এই আবেগটিকে লক্ষ করি। এ কারণে কাব্য তিনটির প্রায় কবিতার মধ্যেই বড় বেশি তুমি, তুমি শব্দটি ঘুরে ফিরে এসেছে। যেহতু প্রেমই তার আরাধ্য, এ জন্য কবিতায় তিনি প্রেমের ঐশ্বর্যকে নানা নামে অভিসিক্ত করেছেন। সেই প্রমিকা কখনো সুমিত্রা নাম কখনো বা অরুণিমা, নন্দিতা, বীণা, শবনম, মনিকা, পারমিতা, ছন্দা, সুনয়না, মৃদুলা, সুপ্রভা ও অনিন্দিতা নামে কবিতার চরিত্র হয়েছে।
মুস্তফা হাবীব কবিতায় কিছু পুরনো শব্দ ব্যবহার করলেও ভাষার সাবলীলতায় তা মন্দ লাগে না। ঐতিহ্যের প্রচলিত ধারায় তিনি কবিতা রচনা করেন। সহজ শব্দে রচিত কবিতাগুলো এ কারণেই সরলতাপূর্ণ। তিনি আবরণ পছন্দ করেন না। সাদাসাপ্টা ভাব হৃদয়ের আকুলতা ও ব্যাকুলতাকে তিনি প্রকাশ করেন নান্দনিকতায়। প্রবহমান ছন্দ লিখেছেন বেশির ভাগ কবিতা।
উপর্যুক্ত কথাগুলো লিখতে আমাকে তার তিনটি কাব্যই পড়তে হয়েছে। তিনটি কাব্যের কবিতা থেকে একটি হীরকখণ্ড খুঁজে পেয়েছি। আমরা জানি, একটি বা দু’টি সার্থক পঙ্ক্তিই কবিকে বাঁচিয়ে রাখে যুগ থেকে যুগান্তরে। ‘আমাদর দেশ হবে সেই ছেল কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে কিংবা, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই অথবা আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে, এ রকম পঙ্ক্তির কবি কালকে অতিক্রম করে টিকে রয়েছেন। মুস্তফা হাবীবের তিনটি কাব্য পড়ে আট পঙ্ক্তির একটি হীরকখণ্ডের দেখা মিলছে। প্রথমত কবিতাটি আমরা পাঠ করি-
“বৈষয়িক ভ্রমণ
কয়েক মুহূর্ত বিশ্ব ভ্রমণ থেকে
এইমাত্র ফিরে এলাম নিজের দেশে
তাবৎ মৃত্তিকার ঘ্রাণ নিয়ে দেখলাম
সারা পৃথিবীতে দু’জন মানুষই শ্রেষ্ঠ
একজন আমি, আর একজন
যে আমার সম্মুখ এসে
দীপ্ত উদ্ভাসে দাঁড়ায়
আমাকে ছাড়িয়ে যায়।”
প্রথম পঙ্িক্ত পাঠ করে মনে হয়েছে কবিতাটি বুঝি মৃত্যুচিন্তাবিষয়ক। পরক্ষণেই ভুল ভেঙে যায়। আত্মমর্য়াদশীল এক কবির সমুন্নত পঙ্ক্তিগুচ্ছের এই কবিতা। আমরা সবাই পৃথিবী ভ্রমণেই আসি। যার যার মেয়াদ শেষে ফিরে যাই প্রকৃতির কাছে। কবিও ভ্রমণে এসেছেন। দেখেছেন প্রকৃতি ও মানুষকে। এই ছোট কবিতাটি পড়ে মনে হলো ‘মানুষ’ নিয়ে তার অভিজ্ঞতা অপরিসীম। তিনি আত্মমর্যাদা নিয়েই নিজেকে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করেছেন। তার বিবেচনায় আর আছে আর একজন যিনি তাকে ছাড়িয়ে তার সম্মুখে এসে দাঁড়াবেন। তিনি কে আমরা জানি না। কবির অনুভূতির মধ্যেই রয়েছেন তিনি। হালকাভাবে মনে হয় তিনি কি সুমিত্রা নাকি মণিকা অথবা অন্য কেউ যিনি তার কবিতার মধ্যেই উদ্ভাসিত। যিনি তাকে ছাড়িয়ে অনন্য হয়ে উঠবেন তারই কাছে। যেহেতু কবিতার নাম ‘বৈষয়িক ভ্রমণ’ এ কারণে ব্যক্তিগত চরিত্রই প্রধান হয়ে উঠেছে কবির কাছে।
কবিতাটি হীরকখণ্ডই বটে!


আরো সংবাদ



premium cement

সকল