কথাশিল্পী ফরিদা হোসেনকে নিয়ে কথা
- আল মুজাহিদী
- ২১ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
ফরিদা হোসেনের সাথে আমার পরিচয় সে দীর্ঘকালের। তার হৃদ্যিক অন্তরঙ্গ প্রীতি-সম্প্রীতিময় সম্পর্কের কথা আমি কখনো ভুলতে পারব না। ফরিদা হোসেন নিঃসন্দেহে একজন সজ্জন মানুষ। অমায়িক ও হরিৎ হৃদয়ের মানুষ। তাকে বিভিন্ন দিক থেকে দেখা যেতে পারে। তিনি যতটা না নিভৃতচারিণী- বলা যায় আত্মচারিণী। আপন সত্তাকে জাগিয়ে তোলার জন্য তিনি সতত সচেষ্ট। যেমনটি নিজস্ব সত্তায় জাগরণের ক্ষেত্রে খাটে, তেমনি সমাজ সত্তার জাগরণের জন্য তিনি একনিষ্ঠ ও অন্বিষ্টও বটে।
ফরিদা হোসেনের ‘শ্রেষ্ঠ গল্পসম্ভার’ পড়তে গিয়ে আমার এসব কথা মনে হয়েছে। এটি ২৮টি গল্পের সুন্দর-সৌকর্যমণ্ডিত একটি সঙ্কলন। ‘অনুশোচনা’, ‘নতুন করে চেনা’, ‘অনুভব’, ‘বৃষ্টি’, ‘আশীর্বাদ’, ‘অবগাহন’, ‘কিংবদন্তি’, ‘ইতিকথা’, ‘বনলতা’, ‘শাড়ি’, ‘চিত্রকথা এবং সেই মেয়েটি’, ‘যোগাযোগ’, ‘পরাজয়’, ‘ঘুম’, ‘একটি শীতল মৃত্যু’, ‘একটি অসমাপ্ত কাব্য’, ‘মানুষ’, ‘দুখাই’, ‘একজন কাজলীর কথা’, ‘নায়িকা’, ‘শুভাশীষ’, ‘চরিত্র বদল’, ‘মুখোশ’, ‘প্রত্যাবর্তন’, ‘নির্বাসন’, ‘ভালোবাসার আলো’, ‘হিমালয়ের দেশে’, ‘আমাকে নিয়ে’, এসব সুন্দর-সরস গল্প এই সঙ্কলনে স্থান পেয়েছে। আর এসব গল্পের রচনাকাল ১৯৬০ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। শিশুসাহিত্য, কবিতা, গান, গল্প, নাটক, গীতিআলেখ্য সাহিত্যের অনেক ক্ষেত্রেই তার প্রাণবন্ত বিচরণ। ফরিদা হোসেন একজন কথাসাহিত্যের শিল্পী।
সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি ফরিদা হোসেন একাধারে রচনা, পরিচালনা ও নির্মাণ করেছেন টিভি-সিরিয়াল, টেলিফিল্ম। আন্তর্জাতিক মানের শিশুতোষ টেলিফিল্মও তিনি রচনা করেছেন। তিনি দেশীয় ও কয়েকটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন।
আমরা অনেকেই অবহিত ও অবগত যে ফরিদা হোসেনের স্বামী মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন একজন বিশিষ্ট রাজনীতিক এবং ফেনী-৩ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য। ফারাহ, ফারজানা ও ফারহানা তাদের মেয়ে। ফরিদা হোসেন কথাশিল্পী। তিনি তার সাহিত্যকৃতির জন্য ২০০৪ সালে তিনি সাহিত্যে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘একুশে পদকে’ ভূষিত হন। ফরিদা হোসেন একাধারে একজন ছোটগল্প লেখক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, নাট্যপরিচালক, গীতিকার, সুরকার, আবৃত্তিকার ও শিশুসাহিত্যিক। তার জন্ম কলকাতায় ১৯ জানুয়ারি।
মানবজীবনের মুখপটে সারা সময়ই নানা পরিবর্তনের ঝঞ্ঝাবার্তা এসে লাগে। দিনবদল হয়, যুগ বদল হয়। শৈশব, কৈশোর কাটে একভাবে আর যৌবনের প্রারম্ভেই শুরু হয় নানা ধরনের ঝড়-ঝাপটা। সংগ্রামমুখরতা মানুষকে বারবার তার জীবনে আস্থা ও বিশ্বাসকে ক্রমাগত সুদৃঢ় করে তুলতে থাকে। যারা প্রগতির যাত্রিক তাদের ভাঙতে হয় দীর্ঘ পথ। মানুষ তার প্রকীর্ণ জীবনের বিভিন্ন দিকপ্রান্ত অতিক্রম করে যেতে থাকে সংগ্রামশীলতার মধ্য দিয়ে। যেখানে জীবন সেখানেই সংগ্রামের প্রখর শিখা জ্বলে ওঠে। আর জীবনের মঞ্চে যেখানে সংগ্রাম ঝলসে না ওঠে সে জীবনের কোনো শক্তিবত্তা লক্ষ করা যায় না। সে জীবন শ্রদ্ধাশীলও হয়ে উঠতে পারে না।
আমি সংগ্রামমুখর জীবনের সপক্ষেই সতত দাঁড়াতে চাই। উজ্জ্বল, উন্মোচিত, আলোকিত জীবনসৃষ্টি হয় সংগ্রামের ভেতর দিয়েই; এটিই আমার বিশ্বাস। কেবল জীবন সংস্থানের জন্য লড়াই করে যাওয়াটাই জীবন। সামগ্রিক আঙ্গিকে দেখতে হবে জীবনকে। ব্যক্তির সংগ্রাম ব্যক্তিকে বিকশিত করে। আর সবার সম্মিলিত সংগ্রাম আমজনতার শক্তি ও সম্ভাবনাকে বিকশিত করে।
জীবনকে জগতকে উদযাপন করতে চাইলে বড়সড় উদ্যোগ আয়োজনের ব্যবস্থাই করতে হয়। অপ্রয়োজনীয় পুনরাবৃত্তিকে বাদ রেখে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের ব্রতযাত্রায় অংশ নিতে হয়। একজন লেখককে জীবনে ও নন্দনে সংগ্রাম এবং সংলগ্নতা অনুভব করতে হয় সারাক্ষণ। এই দায় মেটাতে চাইতে হবে লেখকের জীবনের সততা, নিষ্ঠা, গভীর মগ্নতার উৎসায় থেকে। এ যুগের চৈতন্য লেখককে বহন করে যেতে হবে ওযুগের চৈতন্যের কথা ভেবে।
সৃজনশীলতার প্রখরসময় ও মুহূর্তকে ভবিষৎগামী করে তোলা প্রত্যেক শিল্পীর প্রধান অন্বিষ্ট। স্বমৃত্তিকা, স্বদেশকে সম্ভাবনার সোনালি দিগন্তে পৌঁছে দেয়ার কাজটি যেন লেখককে আচ্ছন্ন করে রাখতে পারে, এই মৌল বিশ্বাসটুকু তার থাকাই চাই। সংসার ও পরিবার মানবজীবনে অবশ্যই একটি বড় ব্যাপার। পরিবার ও সংসারকে অবজ্ঞা করে মানুষের জীবন চলে না। উপমহাদেশের প্রখ্যাত কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ বলেছেন-
‘যেহেতু আমরা বেঁচে থাকতে চাই সে জন্য আমরা শ্রম করি এবং বাঁচার জন্য উপযুক্ত উপকরণ সংগ্রহ করি। এই মানুষই যখন লেখক হিসেবে পরিচিত হয় তখন তার বিশেষ একটি দায়িত্ববোধ জাগে। সে জীবনের কথা লিখতে চায়, জীবনের পরিচয় উদঘাটন করতে চায়; সামাজিক চাঞ্চল্য এবং গৃহগত বিশ্বাসের চিত্র অঙ্কিত করতে চায়। মানুষের সাথে পৃথিবীর একটি সম্পর্ক আছে। আদিমকাল থেকে সে সম্পর্কের উজ্জীবন ঘটছে। মানুষ সর্বমুহূর্তে সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ চায় এবং আড়ষ্টতা থেকে মুক্তি চায়।’
একজন লেখকের কাছে তার ব্যক্তিক ও সামাজিক দায়িত্বই বড় মানুষই কেবল এ সামাজিক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে পা বাড়ায়। তাই আমি বলব, মহত্তর কিছু লিখতে হলে মহত্বের ঐশ্বর্যগুলো এক এক করে অর্জন করে আপন সংগ্রহশালাটিকে সমৃদ্ধশালী করে নিতে হয়। আর সেই ঐশ্বর্যের আলোক শিখার বিচ্ছুরণ ঘটাতে হয় লেখকের সব জীবনক্রমে। ভালো লেখা ক্রমাগত লিখে যেতে হয়- এক দিন, দুই দিনেই সেটি শেষ হয়ে যায়। আর যেটা জীবনভর লিখে যেতে হয় সেও এক মহান জীবন সাধনা।
রবীন্দ্রনাথ তো বলেছেন-ই :
‘লেখা হবে সারবান
অতিশয় ধারবান।’
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর /‘শীতে ও বসন্তে’, চিত্রা)
লেখক হিসেবে আমি মনে করি সমাজের সব স্তর থেকে ছোট-বড়, ক্ষুদ্র-বৃহৎ, সামান্য-অসামান্য সব কিছুকেই দেখে নিতে হবে, জানতে হবে। আর সেখান থেকেই জীবনের নুড়িগুলো, পাথরের কুচিগুলো তুলে আনতে হবে; অর্থাৎ জীবন-সোনা জাগিয়ে তুলতে হবে। যেখানে ভালো-মন্দ, সুন্দর-অসুন্দর সব কিছুই থাকবে।
ফরিদা হোসেনের ‘শ্রেষ্ঠ গল্পসম্ভার’ বই থেকে কিছু গল্পের উদ্ধৃতি এখানে দেবো।
হারুন মামা বলেন, কবিতা নামটি শুধুই ওর জন্য।
কিন্তু একরোখা বাবা বলেন,
হারুনের সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি।
তবে কবিতার অত্যন্ত প্রিয়জন আর অকৃত্রিম বন্ধু হচ্ছে এই
মামা হারুনুর রশীদ।
সেই শৈশব থেকে এখন পর্যন্ত কবিতার সব কিছুতেই আছে
যার উদার সমর্থন। (একটি অসমাপ্ত কাব্য : পৃষ্ঠা-১৩২)
‘একটি অসমাপ্ত কাব্য’ শীর্ষক গল্পটিতে যে বাক্যবন্ধ, শব্দের বুনুনি আর গ্রন্থনায় একধরনের সারল্য লক্ষ করা যায় চরিত্র চিত্রণে স্বাচ্ছন্দ্যময় ভাষাভঙ্গির স্বাক্ষর। এ গল্পের অপর অংশে লেখকের সেই স্বভাবজ সহৃদয়তা পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে।
বাড়ির সামনের মাঠটা বিকেল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত যখন ব্যস্ত থাকে গোল্লাছুট, ছুঁইবুড়ি আর কানামাছির গুঞ্জনে, কবিতা নামের ভাবুক মেয়েটা তখন বিরাট দালানের সিঁড়িতে বসে অপেক্ষা করে পড়ন্ত বেলার। কখন দালানের ছায়া এসে পড়বে উঠোনের খানিকটায় আর এককা দোককার ছককাটা ঘরে কখন সে খেলবে আপন মনে। (একটি অসমাপ্ত কাব্য : পৃষ্ঠা-১৩৩)
ফরিদা হোসেনের গল্পের ভাষায় সাবললিতা ও মুন্সিয়ানা লক্ষ করা যায়। যেমন- জীবনের চলার পথে কত মানুষ এসেছে গেছে। চুলে পাক ধরেছে। আজ এই অবেলায় কেন চিত্তের এই অস্থিরতা। যদিও কামরানের সমাধিস্থ বুকের ভেতরটা একেবারেই স্থবির বহু বছর ধরে। এখন আর দক্ষিণা হাওয়া খুলে দেয় না আচমকা ভোরের দুয়ার। সংযত পরিমিত আর মার্জিত জীবনযাপন ও কর্মজগতের সুখ্যাতি কামরান হোসেনের জন্য তৈরি করেছেন এক বিশেষ সম্মানিত আসন। সাংবাদিকতা জগতে যা সত্যি বিরল। দেশ-বিদেশের রেডিও টিভিতেও আছে যার একটি আলাদা পরিচিতি। (নির্বাসন : পৃষ্ঠা-২৩৮)
মানবজীবন পরিবর্তনশীল, ক্রমাগত রূপান্তরশীল। সেই পরিবর্তন ও রূপান্তরের আনন্দঘন কথামালাই হচ্ছে সাহিত্য। বিশেষ করে কথাসাহিত্য সেই বিচিত্র আনন্দমাত্রাকে নির্ণয় করে কথাশিল্পী ফরিদা হোসেন তার গল্পে সেই আনন্দ বৈচিত্র্য উপস্থাপন করতে প্রয়াস পান। ‘নির্বাসন’ গল্পটির আরো একটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি-
অন্ধকার আকাশে আলো ফুটি ফুটি করছে একটু একটু করে।
ভোরের ভেজা ঠাণ্ডা হাওয়ায় চোখের পাতা আর অবিন্যস্ত
চুলগুলো কেমন ভেজা ভেজা।
অভিমানী।
কামরানের মনে হলো শেষ রাতের জোছনা চুইয়ে শিশির স্নাত
হয়েছে হয়তো- বা কতক্ষণ?
অনেকক্ষণ একাকী আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।
কোথাও কেউ নেই, চারিদিকে মহাশূন্যতা ছাড়া।
‘আমাকে নিয়ে’ গল্পটির ভেতর দিয়ে এক ধরনের নস্টালজিক, রোমান্টিক গীতল আবহ লক্ষ করা যায়; যা লেখকের হৃদয় থেকে উৎসারিত।
মাত্র আর কিছু দিন আগেও যদি এই হাতের স্পর্শ পেতাম
এমনি করে যদি পাশে এসে একটু বসতো ও...
তা হলে হয়তো কোনো দিনই আমাকে অন্তত হাওয়া বদলের
জন্য দেশের বাইরে আসতে হতো না।
কাঠমুণ্ডুু থেকে পুখরা চড়াই উৎরাই করে প্রায় সাত ঘণ্টার পথ। এই সাত ঘণ্টায় আমার দুটি চোখ আর মনের সংরক্ষণশালায় ধরে রাখার চেষ্টা করেছি- তা যেন কোনো মহাকাব্য হয়ে যাওয়ার স্পর্ধা রাখে। (আমাকে নিয়ে : পৃষ্ঠা-২৮৭)
ফরিদা হোসেন তার গল্পগুলোতে তার সমাজেরই নিজস্ব মানুষদের মানসলোককে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। বিশেষ করে সমাজের মধ্যবিত্ত ও ওপর তলার মানুষদেরকে সম্যক দৃষ্টি ফেলে তাদের মনোজগতটাকেই উন্মোচন করতে চেয়েছেন। গল্পের পটভূমিজুড়ে বিশ্বস্ত চরিত্ররা ভিড় করে আছে। তার গল্পের বিষয়বস্তু খুবই জীবনঘেঁষা, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তার গল্পের কাহিনীর ভেতর রহস্যের চমকভরা চরিত্রাভাস আছে। আছে সমাজের বারবেলার অভিঘাতগুলো। জীবনের নিবিড়, গভীর, অন্তর্নিহিত সত্য অন্বেষণ করতে গিয়ে জীবনকে সহজভাবে তুলে ধরার প্রয়াসই ফরিদা হোসেন করেছেন বারবার।
নর-নারীর অন্তর্দেশের স্পর্শকাতর প্রেমানুভূতির প্রকাশও ফরিদা হোসেনের গল্পকে, গল্পের কাহিনীকে মর্মবিহ্বল করে তোলে। এখানেই একজন গল্পকারের গল্পের সার্থকতা। ফরিদা হোসেনের দীর্ঘজীবন কামনা করছি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা