কল্যাণব্রতের কবি এবং কিছু স্মৃতি
- নিজাম উদ্দীন সালেহ
- ১৪ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
তখন ১৯৭৪ সাল। ইন্টারমিডিয়েট পড়ি। প্রস্তুতি নিচ্ছি আমার ছোট্ট কবিতার বই ‘এই দেশ এই মাটি’ প্রকাশের। নিশ্চিত হতে পারছি না, এটা প্রকাশের যোগ্য কি না কিংবা কেমন হয়েছে সেটা।
পাণ্ডুলিপি দেখালাম আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক আবুল বশরকে। তিনি শুধু বাংলার শিক্ষকই নন, একজন বিদগ্ধ সাহিত্য সমালোচকও। তিনি পাণ্ডুলিপি রেখে পরদিন আসতে বললেন। পড়ে মন্তব্য করবেন। সারারাত সে কী টেনশন! সাহিত্যজীবনের প্রথম পরীক্ষা যেন, কী জানি কি হয় ফলাফল। তাই উত্তেজনা। গেলাম পরদিন। স্যার বললেন, ঠিক আছে, ছাপতে পারো। আনন্দে অধীর হয়ে, স্যারকে সালাম জানিয়ে চলে এলাম স্যারের বাসা থেকে। সিদ্ধান্ত হয়ে গেল বইটি ছাপা হবে।
যারা বইটি ছাপার ব্যাপারে অর্থের জোগান দিচ্ছিল, তাদের একজন বলল, আমাদের কাছেই তো একজন কবি আছেন, বইপত্র লিখেছেন, তাকে একবার দেখালে কেমন হয়? আমি ঠিক করলাম, শেষমেশ তাকে একবার পাণ্ডুলিপিটি দেখাব।
এক দিন সকালে গেলাম কবির বাসায় সিলেট শহরের শিবগঞ্জের রায়নগর এলাকায়। তখনো তাকে আমি ভালোভাবে চিনি না। তিনি যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক তা-ও জানি না। দেখালাম তাকে বইয়ের পাণ্ডুলিপি। তাৎক্ষণিকভাবে মোটামুটি পড়ে নিয়ে তিনি ‘ভালো হয়েছে বলে মন্তব্য করলেন। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরামর্শও দিলেন। প্রশংসা করলেন আমার লেখার। তখন পর্যন্ত তিনি আমার নাম জিজ্ঞেস করেননি কিংবা আমিও বলিনি। শুধু বলেছি, আমি একজন ছাত্র। লেখালেখির চেষ্টা করছি। একপর্যায়ে তিনি আমার কবিতায় একটি বিশেষ শব্দ প্রয়োগের ব্যাপারে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। আমি এর ব্যাখ্যা দিলাম। পরক্ষণে তিনি বললেন, ওহ্ নামতো জানা হয়নি, নাম কি তোমার?
আমি নাম বললাম। আমি বুঝতে পারলাম, প্রথমে স্যারের মনে সন্দেহ জেগেছিল, আমি মুসলমান না হিন্দু।
সেদিন দীর্ঘক্ষণ আমি স্যারের বাসায় বসেছিলাম। তিনি কবিতা নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন। তিনি আমাকে ইসলামী আদর্শ ও চেতনাসম্পন্ন জাগরণমূলক কবিতা লিখতে উদ্বুদ্ধ করেন। আসার আগে তিনি তার একটি কাব্যগ্রন্থ আমাকে দিয়ে পড়তে বলেন। আমি সালাম জানিয়ে চলে এলাম।
আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে তার রচিত কাব্যগ্রন্থটি পড়ার চেষ্টা করি। পড়তে গিয়ে বেশ জটিল মনে হয়। তার পরও এর ব্যতিক্রমধর্মী স্বাদ আমাকে আকর্ষণ করে। এর কোনো কোনো কবিতা দাগ কাটে মনে আমি ভক্ত হয়ে যাই সেই কাব্যগ্রন্থ ও কবির।
সেই কাব্যগ্রন্থের নাম ‘কল্যাণব্রত’। আর কবির নাম আফজাল চৌধুরী। প্রথমে আমার কবিতার ভাবাদর্শ ছিল বামঘেঁষা। কবি আফজাল চৌধুরীর সংস্পর্শে এসে আমি শেষ পর্যন্ত হয়ে গেলাম ডানপন্থী। পরবর্তীকালে ইসলামী আদর্শভিত্তিক ও জাগরণমূলক আমার কবিতা পড়ে আফজাল চৌধুরী এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। স্পষ্ট কণ্ঠে বলেছিলেন, সালেহ- এটাই তোমার লাইন। এটা ছাড়লে তুমি সফল হতে পারবে না।
১৯৭৭ সালে আমার কাব্যগ্রন্থ ‘সবুজের আগ্নেয় প্রপাত’ প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থের ভূমিকাও লিখেছিলেন এই খ্যাতিমান কবি। এই বইটি সম্পর্কে তার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছিল। বইটি প্রকাশের পরপরই সাড়া জাগিয়েছিল কাব্যামোদী ও পাঠক মহলে। সম্ভবত ‘সবুজের আগ্নেয় প্রপাত’-ই ছিল দেশে কোনো তরুণ কবির লেখা কাব্যগ্রন্থ যেখানে প্রত্যক্ষভাবে ইসলামী আদর্শের কথা বিধৃত হয়েছিল। সচেতন ব্যক্তি মাত্রেই স্মরণ করতে পারবেন। সত্তুরের দশকের তরুণ কবিদের শতকরা নিরান্নব্বই ভাগেরও বেশি ছিল ধর্মনিরপেক্ষ কিংবা বাম মানসিকতার। কেউ কেউ দু-চারটে ইসলামী কবিতা লিখলেও সেগুলো ছিল শবেবরাত, শবে কদর, ঈদে মিলাদুন্নবী এমন ইসলামী বিশেষ দিবস বা অনুষ্ঠানভিত্তিক। এ ছাড়া যাদের অনুসরণ করে তরুণ কবিরা অনুপ্রাণিত হয়ে তখন লিখেছেন, তাদের প্রায় সবাই হয় বামপন্থী, না হয় ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের অনুসারী।
আমার ‘সবুজের আগ্নেয় প্রপাত’ কবিতাগুলোর ধারণকৃত ‘স্পিরিট’ বা উদ্দীপনার অনেকখানি কবি আফজাল চৌধুরীর নিকট থেকে পাওয়া। আজো তার সেই উদ্দীপনা ধারণ করে চলার চেষ্টা করছি আমার কবিতায়। প্রকৃত অর্থেই তিনি আমার গুরু আমার দিকনির্দেশক আলোকবর্তিকা আমার পাঞ্জেরী।
মহান কবি আফজাল চৌধুরী আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। আমার সদ্য প্রকাশিত ‘শাশ্বত প্রত্যয়’ কাব্যগ্রন্থে এই মহান কবিকে নিয়ে একটি কবিতা রয়েছে। আমি তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে এই কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত করলাম-
অন্তিম দরোজা খুলে অনন্তের, হে মহান কবি
প্রবেশ করেছো শেষে ইল্লিনের প্রশান্ত বাগানে
যেখানে মুহূর্তগুলো ভরে থাকে শাশ্বতের গানে
অপার বিস্ময়ে জাগে জান্নাতের অপরূপ ছবি।
এখন সামনে চলা, নেই কোন লৌকিক টান
হৃদয়ে ধারণ করে প্রত্যাশিত আল্লাহর দিদার
তারই দয়ায় যাক খুলে সব রহমতের দ্বার
তোমার ভ্রমণ হোক গৌরবের শিখরে অম্লান।
অন্তিম দরোজা খুলে রহস্যের, চলে গেছো তুমি
রেখে গেছো একরাশ শব্দের উদ্দীপ্ত আবাবিল
তোমার বলিষ্ঠ কণ্ঠে কাঁপে আজো আব্রাহার দিল
ঈমানের ফুলে শস্যে ভরে ওঠে হৃদয়ের ভূমি।
তুমিতো চলেই গেছো পরলোকে ঐশী ইশারায়
তোমার স্পর্শ তবু অমলিন এ নশ্বর পৃথিবীর গায় ॥
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা