২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কবি দিলওয়ার তাঁর কবিতাবিচিত্র

জন্ম : ১ জানুয়ারি ১৯৩৭, মৃত্যু : ১০ অক্টোবর ২০১৩ -

স্বচ্ছ সমাজ বিনির্মাণের একটি দুঃসাহসী প্রতিশ্রুতির নাম কবি দিলওয়ার। প্রকৃত মানবিকতার ডালপালা বিশ্বদেহে ছড়িয়ে পড়ুক। সুসংহত হোক বিশ্বসাম্য- এই তো তাঁর স্বপ্নের বীজতলা। এমন একটি পরম বোধ পুঁজি করে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ঘোষণা করলেন-
তোমায় দিলাম একটি চাবি/মানবতা নামটি যার/এই চাবিতে খুলবে তুমি/সকল কালের সিংহ দ্বার।
গোলক রাজনীতির লণ্ডভণ্ড অবস্থা দেখে আজকাল ঠিকই মনে হয় মানবতার চাবিকাঠি বিশ্বমোড়লবর্গ হারিয়ে ফেলেছেন।
জাতিসঙ্ঘের মতো ক্ষমতাবান সংস্থা থাকা সত্ত্বেও পুরো বিশ্বের দুর্বল দেশগুলো ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ব্যর্থ। এ রকম বীভৎস দৃশ্য কবি মনে সৃষ্টি করে গভীর ক্ষত। তাই ‘জাতিসঙ্ঘ’ কবিতায় কবি বলেন-
চারিদিকে এত কোলাহল কেন কণ্ঠেরা কেন দ্ব্যর্থ
কেন বারবার মানবিকতার শুভ বুদ্ধিরা ব্যর্থ?
প্রকৃত কবিরা উঁচু মাপের কোবিদ হয়। এঁদের চিন্তার প্রাঙ্গণ, ভাবনার ভাঙ্গন, চেতনার ভুবন, বোধের দিগন্ত সম্পূর্ণ আলাদা। দিলওয়ার যখন বলেন -
শোন/সূর্য অস্ত যায় না কখনও/তুমি যাকে সূর্যাস্ত বলো/ এ তোমার ভ্রান্তি জেনো।
পৃথিবীর এক প্রান্তে সূর্যাস্ত মানে তো গোটা ভূ- গোলকের সূর্যাস্ত নয়। এ বোধ কবিকে দান করে সর্বভূগোলচারী বিশ্বময়তা।
সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে খাদ্য গ্রহণ করতেই হয়। এভাবেই সুরুচি ও সৌন্দর্য প্রতিষ্ঠার জন্য করতে হয় শিল্পচর্চা। উদরভর্তি ক্ষুধার কাছে হৃদয়ভর্তি সৃজনক্ষুধা পরাজিত হতে বাধ্য। যদিও নজরুলসহ পৃথিবীর অনেক কবি প্রমাণ করেছেন পেটের ক্ষুধাকে পাত্তা না দিয়েও উচ্চমানের শিল্প-সাহিত্যচর্চা সম্ভব। এমন উপলব্ধিপ্রসূত উচ্চারণে অনন্য কবি দিলওয়ার -
অন্নের অনৈক্যে বন্দী পৃথিবীর সচিত্র ভূগোলে
অন্তরঙ্গ শিল্পকলা তোষের আগুন হয়ে জ্বলে।
মানবজাতির স্বাস্থ্য নিয়মিত সুখ দুখে রচিত। হৃদয়ে দুঃখের আগুন না থাকলে সুখের সূর্যরশ্মির অনুভূতি মানুষের জীবনে এত প্রবল ও আশাপ্রদ হতো না। কবির প্রখর অনুভূতি পাঠকশ্রেণীকে সুপ্রচুর আনন্দ দেয় -
দুঃখের মতো বিশাল আর সুখের মতো ক্ষুদ্র
এই পৃথিবীতে আমার জন্ম।
দেশপ্রেমের কবিতা না লিখে কোন কবির সফল উদ্ভাস ভাবাই যায় না। বাংলা সাহিত্যে অমরত্বের স্মারক হিসেবে কবি দিলওয়ারের যে চরণগুলো চিরদিন আলো ছড়াবে তার মধ্যে-
পদ্মা তোমার যৌবন চাই/যমুনা তোমার প্রেম/সুরমা তোমার কাজল বুকের/পলিতে গলিত হেম/সাগরদুহিতা এই বাংলার নিশিগন্ধার রাতে/উর্মি দোদুল জনক আমার মিছিলে মায়ের সাথে।
বিশ্বপ্রেমিক দিলওয়ারের যে চরণটি সারাদেশব্যাপী মানুষের মুখে মুখে-
পৃথিবী স্বদেশ যার আমি তার সঙ্গী চিরদিন।
যেন রবীন্দ্র উচ্চারণের অধুনা সংস্করণ-
‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’
প্রসঙ্গত কবি ইকবালের দেশপ্রেমের অমূল্য কাব্যবাণী
স্মর্তব্য -
তোমার দেবতা কী আমি জানিনা
আমার দেবতা আমার দেশের প্রতিটি ধূলিকণা।
একজন মহান কবির চিন্তা সাম্রাজ্যে মানবসমাজের একতাবোধের চেতনা থাকাটাই স্বাভাবিক। কবি দিলওয়ারও তার ব্যতিক্রম নন। মানবসমাজের একতাবোধের প্রয়োজন বুঝাতে তিনি উড়ন্ত পাখিভুবনে রাখেন নিবিষ্ট দৃষ্টি। মানুষকে এক হয়ে এগিয়ে যেতে হবে নির্ধারিত লক্ষ্যের দিকে -
ভুল নেই পাখিদের নিজেদের লক্ষ্যে/ উড়ে যায় বহুদূর
প্রগতির ঐক্যে/বন্ধুরা জানো কি?
তাঁর বিশাল সৃজন ভুবনে শুধু কি কবিতা? ছড়ার রাজা দিলওয়ারের শত শত ছড়ার মধ্যে দু-একটি দৃষ্টান্ত দিলে নবীন পাঠকসমাজ উপকৃত হবেন আশা করি।
মলম লাগাস কোথায় রে তুই/আসল ঘা তো ভেতরে/
আগা কেটে গোড়ায় পানি/ঢালতে বলে কে তোরে?
অবিচার ও মিথ্যাচারশাসিত যেকোনো সমাজ বিশুদ্ধকরণে টনিকের কাজ করার মতো উপরোক্ত চরণগুলো উচ্চারণের মধ্য দিয়েই এ লেখার সমাপ্তি টানছি।
কবি দিলওয়ার। বাংলা সাহিত্যের অনুপম সম্পদ। আল্লাহ তাকে জান্নাত নসিব করুন।


আরো সংবাদ



premium cement