২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ফেলে আসা শীতের ভোর

ফেলে আসা শীতের ভোর -

হলদে মাখা শরষে তে
কুয়াশা ভেজা ঘাস
শ্যামল মাঠের মিষ্টি মায়ায়
আমার ছিল বাস।
হ্যাঁ, আমি গ্রামেরই মেয়ে। আমার বাস ছিল সবুজে ভরা ছায়ঘেরা গ্রামে। সৃষ্টির নরনাভিরাম শ্যামল শোভায় সীমাহীন সুন্দরের শামিয়ানার নিচে প্রকৃতির জলসাঘরে দাঁড়িয়ে আমি সত্যিই অভিভূত। আজ নয়, সেই শৈশব থেকেই।
হারিয়ে গেছে আমার জীবনের সুন্দরতম সময়-আমার শৈশব। হারিয়ে গেছে কুয়াশাভেজা শীতের ভোর। ভেজা দূর্রাঘাস। লাল সূর্য ওঠা মিষ্টি রোদ। হ্যাঁ ছেড়ে এসেছি শৈশব আর সেই মিষ্টি শীতের ভোর।
গাছের ঝরা পাতার নূপুর বাজিয়ে শীতের আগমন আর বসন্তের নতুন পাতা জাগিয়ে তার অন্তর্ধান। তখন প্রকৃতির এক ভিন্ন রূপ যা সম্পূর্ণভাবে ধারণ করে শীতের সকাল গাম্ভীর্যময় এক মহিমা নিয়ে।
ছোট বেলায় সেই গ্রামীণ জীবনে গৃহত্যাগী বিভিন্ন পশু পাখির নিস্তেজ ডাকাডাকি আর কৃষাণের ব্যস্ত আনাগোনায় শুরু হতো শীতের সকাল। আমাদের পাড়ার রহিম চাচার কাঁধে খেজুরের মিষ্টি রসের হাঁড়ি সেই সকালকে করে তুলত মোহনীয়। উত্তর দিকের হিম-শীতল রাতের দীর্ঘশ্বাস শিরশির করে বয়ে যেত গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে। কেঁপে উঠত শীতল পত্র পল্লব। আহা টুপটাপ শিশিরের শব্দ আর রুপোর দানার মতো শিশির কণা মনের মধ্যে ছবি হয়ে আছে। সিক্ত মেঠোপথ, কুয়াশাভেজা ঘাস আজো আমায় পিছু ডাকে। হলদে মাখা সরষেতে আর ভেজা মটর লতা সেই ছোটবেলায়ই আমাকে কবিতা লিখতে বাধ্য করেছিল। সেদিনের সেই খেজুর গাছের রসের হাঁড়ি আর বাতাসে ভেসে আসা সেই মিষ্টি গন্ধ আজকের গ্রামের ছেলেমেয়েরাও উপভোগ করতে পারে না। পাতা ঝরার সেই দিন, সেই কচি সবুজ চারার দোলন, পূর্বাকাশে কুয়াশার চাদর চিরে লাল সূযের্র মিষ্টি আভা-আহা কতই না শোভাময় ছিল সেইক্ষণ, সেই ফেলে আসা শীতের ভোর। তবে শীতের সকাল আলস্য আর উৎসবের আমেজে উপভোগ্য হলেও দারিদ্র্যের জন্য তা খুব কষ্টের। সূর্য কিরণের তীব্রতা বাড়লে ফুরিয়ে যায় শীতের সকালের আমেজ। তবু শীতের সকাল প্রকৃতিকে নিরাবরণ করে এক পবিত্র সৌন্দর্য সৃষ্টি করে যা ছড়িয়ে থাকে সারাবেলা।
শীতের আগমনী একটু হলেও অনুভব করছি। তাই মনে পড়ছে কত কথা। স্মৃতিঘেরা সেই ফেলে আসা শীত ভোরের কথা। আমরা ছিলাম গ্রামের ছেলেমেয়ে। খুব সকালেই ঘুম থেকে উঠতাম। ফজরের সময় দূর মসজিদ থেকে ভেসে আসত আজানের ধ্বনি। আমার আব্বা আম্মা ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়তেন। আমাদেরও ডাকতেন। উঠতে চাইতাম না। কনকনে শীতে গরম বিছানার লেপের উম থেকে একদম উঠতে ইচ্ছে হতো না। চুপ মেরে শুয়ে থাকতাম আরো কিছুক্ষণ। আম্মা আবার ডাকতেন, বকুনি দিতেন। তখন নিরুপায় হয়ে উঠে বাইরে যেতাম। কুয়াশায় ঢাকা হালকা অন্ধকার চারিদিক। টিউবওয়েলটা ছিল গেটের বাইরে, ওখানে গিয়েই অজু করতে হতো। বাইরে বের হতেই সামনেই ছিল একটি শিউলি ফুল গাছ। শীতকালেও পড়ে থাকতো দু একটা শিউলি ফুল। আবছা আঁধারিতেও দেখা যেত শিউলি ফুলের কমলা রঙের বৃন্ত। আমায় নিয়ে যেত এক মোহনীয় কল্প জগতে। আমি অন্যমনস্ক হয়ে যেতাম। প্রকৃতির এক অপূর্ব নীরবতা আর সুভ্রতায় আমি মুগ্ধ হতাম। দূরের গ্রামগুলো দেখা যেত না। কিন্তু আবছায়ার মধ্যে মনে হতো দূরে কি যেন নড়াচড়া করে। আর কেমন যেন শব্দও হয়। আমি কয়েক দিন খেয়াল করে একদিন আবিষ্কার করলাম নড়াচড়া করা বস্তুগুলো আসলে মানুষ আর গরু। খুব ভোরে আমাদের গ্রামের কৃষক চাচারা মাঠে গরু নিয়ে হালচাষ করত। হাল বাইতে গিয়ে মুখে কিছু শব্দতো উচ্চারণ করতে হতো।
সেদিনের সেই শীতের ভোরের সুভ্রতার ছবি অমলিন হয়ে আছে আমার হৃদয়পটে।
তারপর ধীরে ধীরে লাল সূর্যের মিষ্টি রোদে উঠোন ভরে যাওয়া। সেকি মজা উপভোগ করার বিয়ষ তা কেবল লিখে বা বলে বুঝানো সম্ভব নয়।
শীতের দিনে সম্ভবত মাঠে গমের বীজ ছড়ানো হতো। আমাদের পাড়ার ছেলেমেয়েরা ক্ষেতের এক কোণে মাদুর পেতে বসে ছোট্ট ঝুড়িতে করে মুড়ি খেত আর বাঁশের কঞ্চি হাতে নিয়ে কাক, বাবুই, শালিক তাড়াত। আর মুখে বলত, হ্যারো- -দুরো-। শব্দগুলো শুনতে আমার বেশ লাগত। আমরাও আমাদের বাড়ির উঠোনে মাদুর পেতে শীতের রোদে ভাইবোন মিলে পড়তে বসতাম। সাথে পেয়ালায় নিতাম মুড়ি আর সন্দেশ। একটু একটু করে খেতাম আর বইয়ের পাতা উল্টাতাম।
আমাদের বাড়িতে বেশ কিছু খেজুর গাছ ছিল। বিকেলবেলা আমাদের পাড়ার একজন এসে খেজুর গাছে ছোট ছোট হাঁড়ি বেঁধে দিয়ে যেত। পরের দিন সকালে রসে ভরা হাঁড়ি গাছ থেকে নামিয়ে অর্ধেকটা রস আমাদের দিয়ে যেত আর অর্ধেকটা নিয়ে যেত। আমরা গ্লাসে ঢেলে ঠাণ্ডা রস খেতাম। বাকিটা আম্মা জ্বাল দিয়ে মজাদার গুড় বানাতেন।
আমাদের বাড়িতে গণি মিঞা নামে একজন থাকত। আমরা তাকে গণি কাকা বলে ডাকতাম। সে আমাদের বাড়ির কাজ করত। সে শীতের মৌসুমে আমাদের বাড়ির আঙিনায় নানা রকমের সবজির চাষ করত। বীজ থেকে ছোট্ট চাড়া গাছ আর তাদের বেড়ে ওঠা, সব উপভোগ করতাম। জানি না কেন চাড়াগাছ আর তাদের বেড়ে ওঠার যে সৌন্দর্য তা আমার কাছে এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য বলে মনে হয়। কতটা উপলব্ধি করেছি, কেমন করে উপলব্ধি করেছি তা বুঝাতে পারব না। সেই ছোটবেলা থেকেই গাছের প্রতি আমার কেমন যেন একটা মায়া, যেন ঐশ্বরিক টান। যা হোক গণি কাকা নিয়ম করে সবজি চাড়ার যত্ন নিত। দুবেলা পানি দিত। আমিও তার সাথে গাছে পানি দিতাম। আমিও পরিচর্যা করতাম। আমি গাছের কাছে কাছেই থাকতাম। খুব ভালো লাগত আমার। মাঝে মাঝে গণি কাকা বিরক্ত হতো। আজো নতুন সবজি চাড়া আমার খুব আদরের।
আমাদের সেই শীত সকালে রকমারি খাবার তৈরি হতো। গাঁয়ের প্রতিটি ঘরে পিঠা তৈরির ধুম লেগে যেত। শীতের সকালে নরম রোদে বসে ভাপা পিঠে খাওয়ার আনন্দ আজকের ছেলেমেয়েরা কখনো উপভোগ করতে পারবে না। রস পিঠা, তেলের পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, ভাপাপুলিসহ আরো নানা রকমের শীতের পিঠা তৈরি হতো আমাদের বাড়িতে। শীতের দিনে সকালবেলা আমার দাদাবুজি আমাদের সবাইকে মাদুর পেতে একসাথে বসিয়ে দুধের পিঠ বা দুধ চিতই নিজে হাতে বেড়ে খাওয়াতেন।
লালশাক, পালংশাক, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ইত্যাদি সবজিতে ভরে উঠত আমাদের বাড়ির পাশ। বাগানে ফুটত গাঁদা, চন্দ্রমলিকা, সূর্যমুুখী। আমার আম্মা নিজ হাতে ফুলগাছ লাগাতেন। যত্ন করতেন।
শহরের ইটের পর ইট প্রকৃতিকে উপভোগ করতে দেয় না। এখানে উত্তরের শীতল বাতাস ঠাণ্ডা বয়ে আনে। কিন্তু তার সাথে খেজুরের রস কিংবা খেজুরের নতুন গুড়ের মনমাতানো গন্ধে পরিবেশ আমোদিত করে না। শহরের শীতের সকাল কেবল দু চারটি কাকের ডাক, কলের শব্দ, ডিজেল পেট্রলের গন্ধ এবং বাস ট্রাকের কষ্টদায়ক শব্দ। প্রকৃতির রূপ আর সুষমা কঠিন আর ব্যস্ত শহর জীবনে উপভোগ করার সময়ও কারো নেই। শহরের কৃত্রিমতার নিদারুণ চাপে শীতের সকাল তার নিজস্বরূপে প্রকাশ হতে পারে না। এখানে গ্রামের মতো কুয়াশার স্নিগ্ধ জৌলুস নেই। ফেলে আসা গ্রামেই ছিল শীতের সকাল আর তার সৌন্দর্যের মাধুর্যের অনবদ্য পসরা।
এখনো গ্রাম আছে, শীতও আসে সেখানে। কিন্তু আজকের দিনে সেখানে চলছে ডিজিটাল দেশ আর নাগরিক জীবন গড়ার জোর প্রচেষ্টা। তাই সেখানে নেই কোনো খেজুরের রস। যা দু একটি খেজুরের গাছ আছে কিন্তু মানুষ নেই খেজুর গাছে উঠে গাছ কেটে রস বের করার।
নেই লাঙল আর হালের গরুও। আছে চাষের আধুনিক যন্ত্র। এখন সেখানে লাঙল কাঁধে কৃষাণ মাঠে যায় না। এখন কর্কশ শব্দ তুলে ধোঁয়া উড়িয়ে ট্রাক্টর নিয়ে মাঠে যায় কৃষাণ। রাখাল ছেলে বাজায় না বাঁশি। সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের মেঠোপথের বাঁকে বাঁকে গ্রামের মানুষ আগুন জ্বালিয়ে জড়ো হয়ে আর গল্প করে না। তারা এখন সন্ধ্যাবেলায় সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত।


আরো সংবাদ



premium cement