২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অলঙ্করণ : জাহিদ হাসান বেনু

ঘেরাও জীবন
-

- স্যার, ও স্যার কথাডা আমলে নেন। জীবজগতের দুনিয়ায় আইছেন, আনন্দে কাটাইবেন। সংসারের নাই নাই শব্দটা মাইনাস কইরা ফালান। আরে টাকা-পয়সা না থাকলে কি আনন্দ কিনন যায়?
- দেখেন ভাই আপনি আমার ব্যাংকের একজন সম্মানিত গ্রাহক, নিয়মমাফিক যা সুবিধা পাবেন এর বেশি আমার কাছে আশা করবেন না।
- দায়িত্বশীল বলেই আপনাকে অনুরোধ করা- আমি জানি আপনার কাজের একটা গুডউইল আছে। ‘যাহা বলিবেন, যাহা লিখিবেন আপনার কর্তৃপক্ষ সবই মেনে নিবেন’ সুযোগটা নিয়ে নিন স্যার, আপনার ব্যাংকের বোর্ড আমাদের হাতে। দেখেন নাই, আগের প্রস্তাবে আপনারা বললেন এ প্রস্তাবে সুদ মওকুফের নিয়ম নাই। আমার কোম্পানির স্যার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গেলেন ৪৮ ঘণ্টায় নিয়ম বদলে গেল। সম্পূর্ণ ঋণের সুদ মাফ, আসল পরিশোধ হবে ৪০ বছরে। ৪০ বছর! ৪০ বছর একজনের জীবনে কাল-মহাকাল, বোঝেনইতো এ টাকা আর আসে! স্যার, রাজনীতিবিদেরা দেশ চালায় আর আমার স্যার চালায় রাজনীতিবিদদের।
- দেখুন, আমাকে কাজ করতে দিন।
- আমার মালিকের এবারের টার্গেট দুই হাজার কোটি টাকা লোন। সোজাসাপটা কথা স্যার, আপনার জন্য বরাদ্দ দশ কোটি টাকা, এই স্পিডমানি আরকি! প্রপোজালটা পজিটিভ করে দিন বাকি জীবন চাকরির ঘানি টানা লাগবে না। দশ কোটি টাকা! চিন্তা করেন একটা প্রপোজাল সই করলেই পাবেন।
- দেখেন আলম সাহেব, আমাকে এত লোভ দেখাবেন না। আড়াই যুগ আগে এ ব্যাংকে কর্মকর্তা হিসেবে জয়েন করেছি। বাড়িভাড়াসহ বেতন ছিল সাত শত টাকা। হ্যাঁ, সংসার ঠিকমতোই চলছে। এখন এক শ’ গুণের চেয়েও বেশি বেতন-ভাতা পাই, ভালোই চালাচ্ছেন আল্লায়... আমার সংসারে খাই খাই-হায় হায় নেই। আমি এতেই সুখী।
- স্যার, আপনি হিসাবের কথা বলেছেন, সংসারের ভেতরে ঢুকেন, দেখবেন নাই আর নাই। ম্যাডামগো তো চাহিদার শেষ নাই। ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ সূত্র পাল্টেছে স্যার, টাকার গুণে... টাকা গুনে গুনে সংসার সুখী হয়।
- তাহলে শুনুন, পাকিস্তান আমলে আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন, বেতন পেতেন এক শ’ দশ টাকা। অবশ্য দশ টাকায় রেশনে চাল, ডাল, আটা, তেল, চিনি, লাকড়ি- এমনকি ডালডাও পাওয়া যেত। বাবার সংসারে আমরা ছিলাম আটজন। হ্যাঁ, মা ভালোই চালাতেন এ দিয়ে। বাবা মাসের এক তারিখে বেতন পেয়ে একসের জিলাপি কিনে আনতেন বারো আনায়, নতুবা একসের গরুর গোশত আড়াই টাকায়। তাতেই আমরা সুখী ছিলাম। মাস শেষের তারিখটা ছিল শেষ অপেক্ষার আর শুরুর প্রথম তারিখটা ছিল আমাদের পরম আনন্দের। না কোনো কিছুর কমতি হয়নিÑ
- স্যার, শায়েস্তা খাঁর আমলের রেশ টেনে নিজেকে এখন ফাঁকি দিতে পারবেন না। এখন একটা বাথরুম কেউ দশ লাখ বা বেশি টাকা দিয়ে সাজায়- জানি আপনি ধার্মিক, চাকরি জীবনে কালো দাগের আঁচড় লাগাতে চান না। আমার কোম্পানির মালিকের কত কত দাগ- কী হলো তাতে! টাকা বিলিয়ে দেন- সব মুছে যায়। জয় জয় জয়কার তার জীবনে। টাকার কাছে লাল দাগ বলেন, কালো দাগ বলেন, সবই অসাড়। লিখন মোছনীয় কালি আবিষ্কার হয়েছে না, সব ডিলিট করে নতুন করে উদ্ভাসিত হয় জীবন। ফাইলটা ফরোয়ার্ড করে দিন, সেংশন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। অগ্রিম ফিফটি পার্সেন্ট আপনার বৈদেশিক অ্যাকাউন্টে ক্রেডিট হয়ে যাবে, কেউ টের পাবে না। নিশ্চিন্তে থাকুন।
- খুব লোভ দেখাচ্ছেন!
- না স্যার, চান তো কানাডায় হাফ একর জমির ওপর ডুপ্লেক্স বাড়ির দলিলও পেয়ে যাবেন। আরে দুর ভাবছেন কেন! যদি এমন হয় ইনকোয়ারি- টিঙ্কোয়ারি বা তদন্ত কমিটি যা-ই বলেন পাঁচ-দশ বছর চলে যাবে, রেজাল্ট আসবে নেগেটিভ। আরে স্যার, দশ কোটির মধ্যে সবকিছু মিটমাট করার জন্য না হয় দু’কোটি আলাদা রাখুন- যদিও সেরকম কোনো রিস্ক নেই, মানে জিরো পারসেন্ট। মামলা হবে? ধরেন জেলই হলো বিশ বছর! তিন মাস, শুধু তিন মাস থাকবেন ভেতরে। বিশেষ বিবেচনায় সাজা মওকুফ, মামলা মিথ্যে প্রমাণের জন্য তো বিজ্ঞ ব্যারিস্টার রয়েছেন। বেরিয়ে আসবেন গলায় মালা পরে। আইনের যত গিট্টু তত আহসান। এত বছরে কেউকি পেরেছে আমার স্যারের গায়ে আঁচড় কাটতে। যখন যে সরকার- জিন্দাবাদ- সাথে নগদ অর্থ ছোড়াছুুড়ি সেটাও গৌরিসেনের টাকা। ভয় পাবেন না স্যার, আমরা আছি আপনার সাথে।
- ভাববেন না স্যার, মেশিনারিজ এলসি হবে হাজার কোটি টাকার অচল মাল আসবে বিকল্প পঁচিশ লাখ টাকার মানে স্ক্র্যাপ। বাকি টাকা তো বিদেশের বাজারে ঘোরাঘুরি করবে। কাজটা হয়ে গেলে আপনার ফরেন অ্যাকাউন্ট ফেঁপে উঠবে। সিটি ব্যাংক কানাডার অ্যাকাউন্ট ওপেনিং ফর্ম নিয়ে এসেছি। সই করে দিন, হ্যালো, হ্যালো, তারপর থ্যাংকস্ লেটার আসবে।
- আপনি এখন আসুন। কাজ করতে দিন।
- আরেকটা কথা বলে যাই স্যার, আপনার উপর-নিচ সবাই রাজি। জানেন তো আপনার বড় স্যারের এক্সটেনশন হয়েছে আমার স্যারের নগদে তদবিরে। সামনে আপনারও প্রমোশন, হানড্রেড পার্সেন্ট নিশ্চিত থাকতে পারেন। ভেবে দেখবেন স্যার, কাল আসবোÑ

ফাইল দেখতে আজ ভালো লাগছে না। একটা ঘোরটোপের মধ্যে সময়টা যেন আটকে গেছে। ছেলে দু’টা বিদেশে লেখাপড়া করবে গোঁ ধরেছে। ভালো রেজাল্ট হলে নিজেরাই ব্যবস্থা করতে পারত। মেয়ে তো এক পায়ে খাড়া- আমেরিকা যাবে, ওর বান্ধবীরা অনেকেই চলে গেছে। স্ত্রীকে বললাম, বিয়ে দিয়ে দাও। ওর জবাব স্টেটস্Ñ এ না গিয়ে বিয়ে করবে না। স্ত্রী নিজেই পাসপোর্ট বানিয়েছে সার্কভুক্ত দেশগুলো সফরে যাবে।
চেয়ারে হেলান দিয়ে ভাবছি। পিয়ন এসে দু’বার তাগাদা দিলো- স্যার, খাবার দেব? ৩টায় বোর্ড মিটিং শুরু হবে।
স্ত্রীর নতুন বায়না- ফ্ল্যাটের টাইল্স পুরান হয়ে গেছে, বদলাতে হবে। জনপ্রতি একটা বাথরুম জরুরি এবং অত্যাধুনিক। আমেরিকান ফিটিংস-এর গুরুত্ব বেশি আজকাল। স্ত্রীকে বলি, চাকরির বয়স আর পাঁচ বছর। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা আগেই উঠিয়ে নিয়েছি। বেতন থেকে লোনের কিস্তি দিতে হয়। বাড়তি খরচের কোনো উপায় নেই।
ও ক্ষেপে যায়, জীবনভর নাই নাই-এর মধ্যে কাটালাম। কোনোদিন সুখের দেখা পেলাম না এ সংসারেÑ
স্ত্রী আজকাল অন্য সুরেও কথা পাকায়- কমপক্ষে সাড়ে তিন হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট দরকার। দুই হাজার বর্গফুট ফ্ল্যাটে কোনো দিন নাকি পা মেলে ঘুমাতে পারেনি। মনে মনে ভাবলাম, পাঁচ ফুটের এই দেহ দুই হাজার বর্গফুটের মধ্যেও জায়গা হয় না!
নিজে নিজেই ও বলে, ছেলেরা বিয়ে করবে, মেয়ে বিয়ে দিব, নাতি-নাতনীরা ঘরময় ছোটাছুটি করবে। আজকাল ক্রিকেটের যুগ, ওরা একটু বড় হলেই ব্যাটিং বোলিং তো ঘরেই করবে। বাইরে কোথাও কি মাঠ আছে না খেলার জায়গা আছে। নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে ফ্যাতনা থেকে মুক্ত হতে চাইলাম। অন্য দিন রাত ১১টার মধ্যে শুয়ে পড়ি। আজ আর ঘুম আসছে না। ঘরময় পায়চারি করছি।
ডাইনিং-এ পানির জগ-গ্লাস খুঁজতে গেলাম। ছেলেমেয়েদের আলাদা আলাদা রুমে ঢিম ঢিমে জোনাকবাতি। বুঝলাম মোবাইল নেটে ওরা সারা পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছে। ভোরে শুতে যাবে, উঠবে পরদিন দুপুর ১২টায়।
সকালে পত্রিকায় পড়লাম গুগোলের পুঁজির পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। ৫০ হাজার কোটি ডলারে কত টাকা হবে! ক্যালকুলেটার তো নয় কম্পিউটারে হয়তো ডিজিট পাওয়া যাবে। করোনায় সারা পৃথিবীর অর্থনীতিতে ধস নেমেছে আর আমাজান, ফেসবুকের রমরমা ব্যবসা। করোনার আট মাসেই তাদের ব্যবসা শতগুণ বেড়েছে। মানুষ কাজ ছেড়ে সারা পৃথিবী নেটে খুঁজে ফিরছে শান্তি-অশান্তি। ফাঁকতালে ওদের টাকা-ডলার জমা হচ্ছে গুগোলসের মতো বাতাসি কোম্পানিগুলোর অ্যাকাউন্টে। ঘরে চাল নেই, ফেসবুক আছে। দোকানির ছেলে দোকানে বসে চেয়ে আছে মোবাইল স্ক্রিনে। কে এলো, কী চাইল খবর নেই, যেন সংসারে এ ছাড়া আর সবকিছু অপ্রয়োজনীয়।
দু’দিন পর সিডর কোম্পানির ম্যানেজার খুশি খুশি ভাব নিয়ে আমার চেম্বারে ঢুকে। তার হাতব্যাগ থেকে বের করে তিনটি পাসপোর্ট। আমার হাতে দিয়ে বলে আপনার দু’ছেলের কানাডার ভিসা, মেয়ের আমেরিকান ভিসা। আমার ঘাড়ের রগ টনটন করছে, বুঝছি প্রেসার বাড়ছে, বললাম, পাসপোর্ট পেলেন কোথায়? ও মাথা নিচু করে বলে, বললামনা স্যার, সবই সম্ভব। কোনো এক সময় আপনি ওদের কথা বলেছিলেন, মনে ছিল, ভুলি নাই স্যার। ভুলে থাকলে সিডর কোম্পানির ম্যানেজার হতে পারতাম না। ওরা কখন যেতে চায় জানাবেন, টিকিট হয়ে যাবে। স্যার, জীবন একটাই। ছেলেমেয়েদের জীবন উপভোগ করতে দিন। নিরাশায় অন্ধকারে রাখবেন না।
এ পাশ-ও পাশ করছি ঘুমকে বাগে আনতে পারছি না। পাশে স্ত্রী নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে, আজ যেন ও বড় বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জোর করে চোখ বন্ধ করতে চাচ্ছি- কানাডার আধা একরজুড়ে ডুপ্লেক্স বাড়ি যেন হাতছানি দিচ্ছে। প্লটের মাঝখানে সুশোভিত বাড়ি তার চার পাশে আপেলের বাগান। নানান রঙের আপেল দোল খাচ্ছে মৃদু বাতাসে। ছাদে উঠে তাকালে নানান উচ্চতায় টিলা আর মাঝে পাইনগাছের সারি সারি অবস্থান। আরো দূরে পাহাড় শ্রেণী, এক পাশে সাদা বরফ অন্য পাশে আলো-আঁধারি। লনে ক্যাক্টাসের শত শত ঝুড়ি ঝুলছে, নানান রঙের ফুলের মেলা। আশপাশে কোন বাড়ি নেই। একান্তে বসবাসের জীবন-সৌন্দর্য যেন ঘিরে রয়েছে। দরজা খোলা রেখে ঘুরে বেড়াও কেউ ঘরে ঢুকবে না। জরুরি প্রয়োজনে তিন ডিজিটের ফোন নম্বর টিপে দাও উড়ে আসবে হেলপলাইন। আহা কত সুখের জীবন সম্ভার।

দশ কোটি টাকা কম নয়, দরাদরি করলে দুই-তিন কোটি টাকা বাড়ানো যাবে। তন্দ্রা ছুটে যায়, ও নিয়ে যাবে এক হাজার নয় শ’ নব্বই কোটি টাকা! আগের দেনা দুই হাজার কোটি টাকা! এ দায় কে নেবে হতভাগ্য জাতির? আবার আজকাল দায়িত্বশীল কেউ কেউ বলেন, তিন-চার হাজার কোটি টাকা- টাকা হলো! এ দেশতো স্বর্গরাজ্যে পৌঁছে গেছে।
মাঝরাতে আবার টয়লেটে যেতে হলো। বাতি জ্বালাতেই মনে হলো কেমন নোংরা পরিবেশে বাস করছি। টাইলসের রঙ ফিকে হয়ে গেছে, বাথরুম ফিটিংস যেন আদ্দিকালের রঙজ্বলা কলকব্জা। একটা ঘেন্না ঘেন্নাভাবে গা রি রি করছে কমোড দেখে। এর মধ্যে স্ত্রী জেগে বসে আছে, আমাকে দেখে বললো, কই গেছিলা এত রাইতে? বেডরুমের বাতিটা জ্বালিয়ে দিলাম। উস্কোখুস্কো চুলে অবাক দৃষ্টিতে বসে আছেন তিনি। বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। জবাব না পেয়ে ও বললো, কি ডায়াবেটিস বেড়েছে?
ঘড়ির দিকে তাকালাম রাত তিনটে বিশ মিনিট। মনে মনে ভাবলাম, বুড়ি হয়েছ টের পাওনি! পাসপোর্টে ভিসা লাগিয়ে দেশ-বিদেশে ঘুরতে চাও! আবার ভাবি, সে সুযোগ তো আমিই করে দেইনি নানান অজুহাতে। আবার উঠে ডবল ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়লাম। সকালে উঠতে একটু দেরি হলো। মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম আজ একটা হেস্তনেস্ত হবে। দেখি সময়টা কী বলে। দু’দিন পর প্রমোশনের ইন্টারভিউ। ঘরে প্রস্তুতি নেয়ার সময় নেই, অফিসেই ফাঁকে ফাঁকে দেখে নেব ফাইলপত্র।
ফাইল-কেবিনেট টান দিলাম, নথিপত্রের নিচে আমার আদ্দিকালের ডায়েরি। পাতা ওল্টাতেই চোখে পড়লো, চাকরিতে জয়েন করার পর ফাউন্ডেশন ট্রেনিং-এ পরিচালক মাহতাবউদ্দিন স্যার বলেছিলেন, ব্যাংকে চাকরি করতে এসেছেন লাখ লাখ টাকা হাতড়াবেন, কোটি কোটি টাকা থাকবে ভল্টে আপনার তত্ত্বাবধানে। কোনো দিন ভাববেন না একটা টাকাও আপনার পকেটের। তাহলে শপথ ভঙ্গ হবে; আর শপথ ভঙ্গ হলে জীবনটাই হয়ে যাবে অর্থহীন।


আরো সংবাদ



premium cement