কী লিখছি কী পড়ছি
- সোলায়মান আহসান কবি, ঔপন্যাসিক, শিশু সাহিত্যিক
- ২৯ অক্টোবর ২০২১, ০০:০৫, আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২১, ২৩:৩০
পঠন-পাঠন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বটে। সেই কৈশোর বয়সে পাবলিক লাইব্রেরিতে ঢুকে বই পড়ার অভ্যাসটাকে আজতক সামান্য ছাড়তে পারিনি। চোখের স্বাস্থ্য অবশ্য ভালো নয়। বেশি পাঠের সামর্থ্য রাখে না। তবু পড়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারি না।
বইয়ের আকর্ষণে কালে কালে নিজের সংগ্রহে রাখা বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। আগে সৌজন্য হিসেবে কিছু মিলত। এখনও পাই। কখনও লেখক, কখনও প্রকাশকের তরফ থেকে। এই তো সে দিন, একজন স্নেহভাজন প্রকাশক এক বাক্স বই সৌজন্য পাঠিয়ে দিলেন। এসব সৌজন্যপ্রাপ্ত বইয়ের একটা দাবি থাকে- পাঠ করা এবং ভালো-মন্দ কিছু লেখা। অথচ এসব পাঠের জন্য আমার সময় থাকে না হাতে। মনও সায় দেয় না।
লেখালেখির বিষয় এতটা বাড়িয়ে ফেলেছি পড়ার বিষয়ও তেমনি অনেক। ফলে সবসময় টানাপড়েনে পড়তে হয়। নিজের মতো করে পাঠ হয়ে ওঠে না। যে কারণে পূর্বনির্ধারিত পাঠক্রমে থাকা হয় না।
গদ্য লেখার জ্বালা আরো। শুধু সাহিত্য সম্পর্কিত নয়, নানা বিষয়ে মাথা গলানো আমার বদভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ফলে, নানা বিষয়ে লেখার ফরমায়েশ আসতে থাকে। মুখের ওপর কপাট লাগাতে পারি না। বলতে পারি না, আগের মতো এখন আর লিখতে পারি না। বরং লেখা দেবার কথা দিয়ে ফেলি। এতে আমার সমস্যা আরো বাড়ে। শারীরিক কিংবা নানা বাধায় যেমন লিখে উঠতে পারি না, পারি না ফরমায়েশ মোতাবেক লেখা দিতে- অপর দিকে নিজের পরিকল্পনা অনুসারে পড়ায় ছেদ পড়ে।
ইদানীং দায়বদ্ধতা আমাকে কুরে কুরে চিত্তের প্রশান্তি ধ্বংস করছে। মনে হয় অনেক পূর্বসূরি এবং সমকালীন লেখক আছেন যাদের সৃষ্টিশীলতা নিয়ে তেমন চর্চা হয়নি, এঁদের নিয়ে দু’কলম লেখা উচিত বৈকি। এঁদের অনেকে আছেন কিংবদন্তিতুল্য (?) প্রতিভাবান লেখক। কিন্তু এঁরা নানা কারণে আমাদের সাহিত্যালোচনায় অনুপস্থিত। এঁদের নিয়ে হয় না চর্চা। হয় না এঁদের সৃষ্টি নিয়ে মূল্যায়নধর্মী লেখালেখি। তখন নিজেকে অপরাধী মনে হয়। ইচ্ছে করে এঁদের নিয়ে দু’কলম লিখি। ইচ্ছে করলেই তো হলো না। এঁদের বই পাঠ করতে হবে। এমন দায়বদ্ধতা থেকেও পাঠের বিষয় কোনো সময় পূর্বসূরি চর্চায় পর্যবসিত হয়। তা ছাড়া আমি আমাদের পরবর্তী সময়ের কবি-সাহিত্যিকদের লেখা মনোযোগ দিয়ে পাঠ করি। একেবারে নবীন লেখকদের ব্যাপারেও আমার উৎসাহ আছে। কে কিভাবে লিখছেন, বিষয়-ভাবনা কতটুকু এগোলো এসব ব্যাপারে আমার পর্যবেক্ষণ থাকে।
আমাদের সমকাল এমনিতে সুস্থ, স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর নয়। আমি নিজে দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রতি দৃষ্টি রাখতে আগ্রহী। একসময় পত্রিকায় আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে লেখালেখি করতাম। লেখার দিগন্তকে ছোট করার প্রয়াসে ওই বিষয়ে লেখা থেকে নিজেকে জোর করে সরিয়ে এনেছি। অন্য আরেকটি গুপ্ত কারণও আছে। কিন্তু লেখালেখি বাদ দিলেও প্রায় ৫০ বছরের অভ্যাস তো ( শৈশব থেকেই আন্তর্জাতিক বিষয়ে আগ্রহ) আর যায় না; তাই দৃষ্টিটা প্রতিদিন পৃথিবীর মানচিত্রে ঘোরাঘুরি করে। প্রয়োজন মতো ফাইলিং চলে।
আজকাল প্রযুক্তি আমাদের জন্য সুযোগ এনে দিয়েছে নৈমিত্তিক ওয়াকিবহাল হওয়ার। ইচ্ছে হলে খুব কম সময়ে দশ দিগন্তের খবর নেয়া সম্ভব। তবে তথ্যপ্রবাহ যতটা সহজ হয়েছে তথ্য পাওয়া ততটা সহজসাধ্য নয়। এর কারণ গোটা বিশ্বের তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণমুক্ত নয়। উদাহরণ হিসেবে বলছি : মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে আমেরিকা ‘এমবডিড জার্নালিস্ট’ নামে সিএনএন ও সিআইএ কর্তৃক প্রশিক্ষণ ও পারিতোষিকপ্রাপ্ত একধরনের মস্তিষ্ক বিক্রি করা সাংবাদিকদের নিয়োগ দিয়েছিল যুদ্ধের খবর কভার করার জন্য। তারা গোটা বিশ্বকে প্রকৃত যুদ্ধের পরিস্থিতি জানা থেকে অন্ধকারে রেখে ইরাকের মারাত্মক পতন ঘটায়। এমন মস্তিষ্ক বিক্রি করা সাংবাদিক রয়েছে এখন দেশে দেশে। আর যারা মস্তিষ্ক বিক্রি করতে একেবারে রাজি হয় না, সত্য কথা বলে ফেলে, তাদের পরিণতি হয় আদনান, খাশোগি, মাহমুদুর রহমান গয়রহর মতো।
বলছিলাম প্রযুক্তি আমাদের চোখের সামনের পর্দা সরাতে পারলেও মনের পর্দার আড়ালে আমরা অজানা বিশ্বের অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছি। তবু চেষ্টাচরিত করে তথ্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ করা চলে। মানুষের স্বার্থে সরাসরি আঘাত আসে না এমন অনেক তথ্য পরিবেশন করা হয়। যেমন মহাকাশ অভিযান, মঙ্গল গ্রহ নিয়ে এখন প্রতিদিন তথ্য পাচ্ছি পার্সিভিয়ারেন্স ও ঝুরং নামে পাঠানো যুক্তরাষ্ট্র (নাসা) ও চীনের দুই রোবটের মঙ্গল গ্রহে পদার্পণের মাধ্যমে।
পড়ার বিষয় যেমন বাঁধাধরা নেই। অনেক পুরনো বই (যা আগে পাঠ করেছি) চোখের সামনে এলে লোভ হয় পড়ি। আলমিরা থেকে নামিয়ে পাতা উল্টালে মনে হয় আগে বুঝি পড়িনি অথবা পড়েছি ঠিকঠাক বুঝতে পারিনি। বইটা পড়া উচিত আবার। এভাবে শিথানের পেছনে খাটের যে তাক রয়েছে সেখানে ভরে ওঠে বই। অর্ধভুক এসব বইয়ের মধ্যে রবীন্দ্র-সাহিত্যের একনিষ্ঠ বিশ্লেষক আবু সয়ীদ আইউবের (পথের শেষ কোথায়/পান্থজনের সখা/আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ), আব্দুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত নজরুল স্মারকগ্রন্থ (জন্মশতবার্ষিকী), কিছু বিদেশী কবির কবিতা (সিলভিয়া প্লাথ/ভাতসারোভ/ চেসোয়াভ মিউশ/ল্যু শ্যুন/নাজিম হিকমত প্রমুখ) ইত্যাদি। তালিকাটা অনেক বড়, তাই ক্ষান্ত থাকাই উচিত।
আগেই বলেছি, আমার পাঠক্রম ছন্নছাড়া কখন কী পাঠ করি তার কোনো ধারাবাহিকতা নেই। যেভাবে লেখালেখির ব্যাপারটাও লাগামহীন। ফলে নানা ধরনের লেখার দৌড়াদৌড়িতে ক্লান্তি যখন নেমে আসে, তখন গান আমার হয় প্রিয়সঙ্গী। হ্যাঁ, আমি সঙ্গীতপ্রেমিক লোক।
একটা কথা বলা দরকার, আমি যেকোনো বিষয়ে লেখার আগে দীর্ঘ দিন সে বিষয় নিয়ে ভাবি। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করি, অভিনিবেশসহকারে অধ্যয়ন করি। আমি একটা গল্প লেখার জন্য দীর্ঘ দু’বছর স্টাডি করেছিলাম। সেটি ছিল কাশ্মির নিয়ে। যেহেতু আমি সরেজমিন ওই দেশটা দেখিনি, সেহেতু আমি ইন্টারনেট এবং পত্রপত্রিকা ও গ্রন্থের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করেছি সেই ভূখণ্ড সম্পর্কে আদ্যপান্ত।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, লেখার চেয়ে পড়া হতে হবে বহুগুণ বেশি। আর একজন লেখককে হতে হবে সবসময় আপ টু ডেট জগতের সব খবর তার জানা থাকবে। সেটি হোক খেলাধুলা, হোক সিনেমা-নাটক, হোক রান্নাবান্না, মহাকাশের নানা অভিযান- অর্থাৎ সব বিষয়ে লেখককে হতে হবে পারদর্শী। তবেই তিনি প্রবেশ করতে পারবেন নতুন নতুন জগতে। পাঠকও সেই নতুন জগতের প্রত্যাশায় থাকে।
সমারসেট মমের একটা কথা দিয়ে শেষ করতে চাই। সমারসেট মমকে নাকি এক পাঠক বলেছিলেন আপনার বই পড়তে আমার একবারও অভিধান দেখতে হয়নি। মম এ মন্তব্যকে তার লেখার প্রতি সবচেয়ে বড় কমপ্লিমেন্ট মনে করতেন। তাই, লেখা অবশ্যই সহজবোধ্য হওয়া উচিত। রবীন্দ্রনাথ কিংবা শরৎচন্দ্রকে পড়তেও আমাদের অভিধানের আশ্রয় নিতে হয় না। কিন্তু সুধীন দত্তের বেলায় হাতের কাছে অভিধান রাখতে হয়। আমার নিজের ক্ষেত্রে এ বিষয়টা মনে রাখি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা