২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

কবি জীবনানন্দ দাশ রূপসী বাংলার কবি

-

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা

আমি আজ গর্ব বোধ করছি প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ আমার দেশের, আমার শহর বরিশালের সন্তান। তিনি একজন কবি, শিক্ষাবিদ ছিলেন। তিনি ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের গাঁওপাড়া গ্রামে। তার বাবা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন স্কুলশিক্ষক ও সমাজসেবক। তিনি ব্রহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। মা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন একজন কবি। ১৯৫৪ সালের এই দিনে ২২ অক্টোবর কলকাতায় তার মৃত্যু হয়।
মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে যখন তার জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবিতে পরিণত হয়েছেন।
জীবনানন্দের কবিতায় মুগ্ধ হয়ে বিভিন্ন সময় গুণীজন তাকে বিভিন্ন বিশেষণে ভূষিত করেছেন। বুদ্ধদেব বসু তাকে নির্জনতম কবি বলে আখ্যায়িত করেছেন। আবদুল মান্নান সৈয়দ তাকে শুদ্ধতম কবি বলেছেন। তার লেখার মাঝে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও রূপকথা-পুরাণের কথা ফুটে উঠেছে চিত্ররূপময় আর সেজন্যই তিনি রূপসী বাংলার কবি হিসেবে উপাধি পেয়েছেন। অনেকে তাকে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল-পরবর্তী বাংলাসাহিত্যের প্রধান কবি বলে মনে করেন।
১৯৫৩ সালে নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে তার কাব্যগ্রন্থ ‘বনলতা সেন’ পুরস্কৃত হয়। ১৯৫৫ সালে ভারত সরকারের সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।
তিনি প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন। ১৯৫৪ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি নিভৃতে ২১টি উপন্যাস ও ১০৮টি ছোটগল্প রচনা করেছিলেন যার একটিও তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি।
জীবনানন্দ দাশ দেশ বিভাগের কিছু আগে বিএম কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে কলকাতায় গিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের কিছু পূর্বে সপরিবারে বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেন এবং কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় তার মা কুসুমকুমারী দাশের জীবনাবসান ঘটে। ইতোমধ্যেই তিনি কলকাতার সাহিত্যিক সমাজে নিজস্ব একটি অবস্থান তৈরি করেছিলেন। তিনি সমকালীন সাহিত্যকেন্দ্র নামে একটি সংস্থার সহসভাপতি নির্বাচিত হন এবং এই সংস্থার মুখপত্র দ্বন্দ্ব পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক নিযুক্ত হন। মাঝে তিনি কিছুকাল খড়গপুর কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে তার জনপ্রিয় কবিতার বই ‘বনলতা সেন’ সিগনেট প্রেস কর্তৃক পরিবর্ধিত আকারে প্রকাশিত হয় এবং নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন কর্তৃক ঘোষিত রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার জয় করে।
খুব অল্প বয়সেই জীবনানন্দের কাব্যচর্চার শুরু। ছাত্রাবস্থায় তার প্রথম কবিতা ‘বর্ষ-আবাহন’ ব্রহ্মবাদী পত্রিকায় ১৯১৯ সালে প্রকাশিত হয়। মূলত কবি হলেও তিনি অনেক ছোটগল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে ধূসর পাণ্ডুলিপি ১৯৩৬, বনলতা সেন ১৯৪২, মহাপৃথিবী ১৯৪৪, সাতটি তারার তিমির ১৯৪৮, রূপসী বাংলা রচনাকাল ১৯৩৪, প্রকাশকাল ১৯৫৭, বেলা অবেলা কালবেলা ১৯৬১। এছাড়াও বহু অগ্রন্থিত কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে মাল্যবান, সুতীর্থ, জলপাইহাটি, জীবনপ্রণালী, বাসমতীর উপাখ্যান ইত্যাদি। তার রচিত গল্পের সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। কবিতার কথা ১৯৫৫ নামে তার একটি মননশীল প্রবন্ধগ্রন্থ আছে।
১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর কলকাতায় এক ট্রাম দুর্ঘটনায় গুরুতরভাবে জীবনানন্দ দাশ আহত হন। স্থানীয়রা তাকে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি করেন। অনেক চেষ্টার পরেও চিকিৎসক ব্যর্থ হন জীবন বাঁচাতে। অবশেষে সকলকে কাঁদিয়ে ২২ অক্টোবর ১৯৫৪ সালে রাতে তাঁর মৃত্যু হয়। অবশ্য পরে অনেকেই মনে করেন জীবনানন্দ দাশের আত্মহত্যার স্পৃহাই দুর্ঘটনার মূল কারণ। জীবনানন্দ গবেষক ডা: ভূমেন্দ্র গুহ মনে করেন জাগতিক নিঃসহায়তা কবিকে মানসিকভাবে কাবু করেছিল এবং তাঁর জীবনস্পৃহা শূন্য করে দিয়েছিল। মৃত্যুচিন্তা কবির মাথায় দানা বেঁধেছিল। তিনি প্রায়ই ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা ভাবতেন।
রূপসী বাংলার কবি, বনলতা সেনের কবি জীবনানন্দ দাশের সৃষ্টি সাহিত্য সৃষ্টিতে আমাদেরকে সামনে চলার সাহস ও শক্তি জোগায়। তিনি আমাদের অহঙ্কার, তিনি বাংলার গর্ব, তিনি সাহিত্যের অলঙ্কার। বাংলা সাহিত্যে তার অবদান আমরা প্রাণভরে স্মরণ করছি।


আরো সংবাদ



premium cement