চোখ ও কণ্ঠস্বর
- শাদমান শাহিদ
- ০৮ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
আমরা ছিলাম মঞ্চের ঠিক সামনের দিকে। দ্বিতীয় সারির মাঝবেঞ্চে। রাহিল কারাভাব বলছিল, ‘বসার জন্য এটাই উপযুক্ত আসন, বক্তার মুখ স্পষ্ট দেখা যায়, শ্রোতা হিসেবে আমিই ভোঁতা, বক্তার মুখ স্পষ্ট দেখতে না পেলে বক্তব্য সহজে কানে ঢুকে না।’ অবশ্য ফার্ন্দান্দেজের আপত্তি ছিল ওখানেও, ও বলছিল, তৃতীয় বা চতুর্থ সারিতে বসার জন্য। কারণ সামনের বেঞ্চগুলোতে সাধারণত সরকারি আমলারা বসে, ওরা বক্তার প্রতি মনোযোগ তো দেয়ই না, বরং পারস্পরিক কথাবার্তা বলে অনুষ্ঠানের গুরুত্বকে অনেকটা ফালতু করে তোলে।
ফার্ন্দান্দেজের কথা ছিলো আমারো, আমিও অনেক দেখেছি, সামনে যারা বসে তারা বক্তার কথা শোনার চেয়ে নিজেদের মধ্যে কানাকানি করতেই বেশি পছন্দ করে। এরচে’ ভালো হয়, একটু দূরত্ব বজায় রেখে বসা, এতে চোখ-কান দুটোই আরাম পায়। কিন্তু রাহিল কারাকাভ বড় জেদি ও মাথা নাড়িয়ে বলতে লাগল, তা হবে না। এখানে তোমরা নতুন। এসব প্রোগ্রামের মেজাজ সম্পর্কে ধারণা নেই। এখানে যা হচ্ছে, যা দেখতে পাচ্ছো, সবই নিখুঁত ছকে বাঁধা, এর থেকে উনিশ-বিশ হলেই প্রোগ্রামের মেজাজ মুহূর্তে পাল্টে যায়। তখন মাঝখান থেকে বেরিয়ে যাওয়াটা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
দেখলাম, তার যুক্তিও মন্দ নয়। অতএব আমরা দ্বিতীয় সারিতেই মাঝ বরাবর বেঞ্চটাতে বসলাম। এবং শেষ পর্যন্ত দেখলাম, রাহিল কারাকাভের কথাই ঠিক। ইভন রিডলির বক্তব্যের মাঝখানেই সাংবাদিকরা প্রশ্ন শুরু করে দিলো, তখনই বুঝলাম বক্তব্য তাদের মন মতো হচ্ছে না। হয়তো তারা অন্যকিছু চেয়েছিল। হয়তো চেয়েছিল, ইভন রিডলি যেহেতু দীর্ঘ কারাভোগের পর তালেবানের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন, তখন তিনি মিডিয়াবিশ্বের সামনে নিশ্চয়ই এমন কিছু উচ্চারণ করবেন, যা তাদের এতদিনের অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটায়। হয়তো এজন্যই এত ডলার খরচ, এত বড় আয়োজন, বাইরে অভিজাত হোটেলগুলোর এত প্রস্তুতি।
বোধ হয় সব সার্থক হয়ে যেতো ইভন রিডলির একটি মাত্র কথায়, শুধু একটি ইঙ্গিতে। হয়তো চেয়েছিল, রিডলি বিগত দিনে যা ছিলেন, তাই যেনো থাকেন। পালিত বুদ্ধিজীবীগণ যেভাবে আনুগত্য দেখায়, তিনি যেনো এর ব্যতিক্রম না হন।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তিনি তাদের চাওয়া-পাওয়ার ধারে কাছে গেলেন না। বরং তিনি এমন কিছু উচ্চারণ করে ফেললেন, যা আয়োজকদেরকে কেবল আশাহতই করল না, বরং তাদের রুটি-রুজির সমূহ ব্যবস্থাকে এক ঝটকায় লাথি মেরে ছিটকে দিলো।
আমি দেখলাম, মুহূর্তে হলের পরিবেশ অন্যরকম হয়ে গেল। সাংবাদিকরা তাদের জন্য নির্ধারিত আসন ছেড়ে দিয়ে ক্যামেরা কাঁধে পাগলের মতো মঞ্চের ডানে বামে ছোটাছুটি করতে লাগল।
সাংবাদিকদের এত বাড়াবাড়ির মানে কী?
উত্তরটা যদিও আমি আন্দাজ করে নিয়েছিলাম, তারপরও রাহিল কারাকাভের দিকে মুখ ফেরালাম।
ও তখন গলাটাকে একটু চড়িয়ে বলতে লাগল, ছোটাছুটি তো করবেই। কারণ মিডিয়া বাজারেরও বেঁচে থাকার প্রাণভোমরা আয়োজকদের পিঞ্জরায়।
দুই.
এই যখন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের অবস্থা, তখন আমার আর ওখানে বসে থাকতে মন চাইল না। রাহিলকে বললাম, চলো বেরিয়ে পড়ি।
এ সময় ফার্ন্দান্দেজ সটান দাঁড়িয়ে পড়ল। এবং আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল, তালেবানদের মানবিকতার যে পরিচয় ইভন রিডলি দিলেন, এরপর আর আয়োজকদের উৎসাহ থাকতে পারে না। চলো বেরিয়ে পড়ি। এ সময় আরেকটা দৃশ্য চোখে পড়ল, যেসব বুদ্ধিজীবী রিডলির আগে বক্তব্য দিতে গিয়ে আফগানিদের যাচ্ছে তাই বকাবকি করেছিল, দেখলাম, তারাই এখন সবার আগে একে একে নেমে যাচ্ছে।
হ। চলো। উঠে পড়ল রাহিল কারাকাভ।
তিন.
সেমিনার হল থেকে বেরিয়ে আমরা কাছাকাছি কোনো একটা বারের উদ্দেশে হাঁটতে লাগলাম। ঘড়িতে তখন বোধ হয় রাত আটটা কি সাড়ে-আটটা বাজে। দেখলাম, এটুকু রাতেই হোটেল-বার-ক্যাসিনোগুলো ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে ক্ষুধার্ত কঙ্কালসারে পরিণত হয়ে গেল। চোখে পড়ল, কী এক অজ্ঞাত কারণে সিটি করপোরেশন লাইটগুলোও যথেষ্টরকম নিষ্প্রভ। হাত তিনেক দূরের লোকটাকেও স্পষ্ট শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। একটা আলো-আঁধারির ভেতর হাঁটতে গিয়ে আমি অনেকটা পেছনে পড়ে গেলাম। এবং টের পেলাম আমার সাথে পাল্লা দিয়ে যিনি হাঁটছেন, তিনি আমার পরিচিত কেউ নন, অন্য একজন। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম, গাট্টাগোট্টা ধরনের একজন আফ্রিকান ভদ্রলোক, দেখলাম, লোকটা বেশ উত্তেজিত। হাত-পা মুড়িয়ে মুড়িয়ে হাঁটছিল। আমি তার খুশি খুশি ভাব দেখে ফেলেছি বলে, আমার উদ্দেশে বলতে লাগল, ‘ভাই, কী বুঝলেন, দেখলেন তো মানুষের একটা কথা কতটা বিধ্বংসী হতে পারে, অথচ শালাদের আমরা কতই না ভয় পাই, তাই না?’
ততক্ষণে আমরা একটা বারের সামনে চলে এলাম, লোকটাও উত্তরের তোয়াক্কা না করে চলে গেল। তারপর বরাবরের মতোই রাহিল কারাকাভ, ফার্নান্দেজ ওরা খুব ফুর্তি করছিল, কিন্তু কেন যেন আমি পারছিলাম না, মাথার ভেতর কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছিল লোকটার কথাগুলো। কেবলই মনে হচ্ছিল, আসলেই তো, দুদিন আগেও থার্ড কান্ট্রির কোনো ব্যক্তিকে পশ্চিমাদের কোলে বসে এভাবে নড়ে উঠতে দেখিনি। এখন তো সারা পৃথিবীই দেখল, এখনো জমিনের বুকে মানুষের পদচারণা রয়েছে, দানবের হাতের তালু থেকে এখনো কেউ কেউ নেমে যাওয়ার সাহস রাখে এবং সদর্পে নেমে যায়।
আমার বন্ধুরা গলায় পেগের পর পেগ ঢেলে আনন্দ পাচ্ছিল, আর আমি দেখছিলাম আমাকে, যেখানে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে একজন ইভন রিডলি। সজাগ হয়ে উঠছে তার চোখ, কণ্ঠস্বর, গলার জোর।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা