২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘আমার দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাবে’ সৈয়দ শামসুল হক

-

আমি জন্মেছি বাংলায় আমি বাংলায় কথা বলি
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর চলি।
কবি সৈয়দ শামসুল হক তার নিজের পরিচয় দিলেন চিরহরিৎ বাংলার ইতিহাস টেনে। কবিরা এমনই। জন্ম আর সৃষ্টি কবিদের পরিচয় বহন করে। কবিদের একটা নিজস্ব সত্তা থাকে। সে সত্তায় স্বীয় আলোয় আলোকিত হন সৃষ্টির পাতায় পাতায়। তাই মনে পড়ে গেল আবদুল মান্নান সৈয়দের কথাটি- ‘মানুষের সব চেয়ে বড় ক্ষমতা বৃদ্ধি নয়, হৃদয় নয়-কল্পনা। কবিতা এত শক্তিশালী হয়ে ওঠে এই জন্য যে, কল্পনা তার পিছনে সবচেয়ে প্রধানভাবে সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে কাজ করে যায়।’ আমাদের মনে রাখতে হবে কবিদের কল্পনা শক্তির সাথে বের হয়ে আসে চিত্রকল্পের জিনিসটিও। কবি জীবনানন্দ দাশও কবিতায় ‘কল্পনা’ শক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কবি যখন কল্পনার চিত্র রূপায়ণ করেন তার গ্রাম বাংলার সারল্য মৃত্তিকার কথা তখন সে চিত্র ভেসে ওঠে আমাদের সামনে। কবির ভাষায়-
কতবার গেছি আমি গেরামের শ্যাম সীমানায়
আদাড় বাদাড় দিয়া অতি ঘোর গহিন ভিতরে,
কত না গাছের পাতা কতবার দিয়াছি জিহ্বায়
এমন তো পড়ে নাই পানি এই পরানে, শিকড়ে।
(পরানের গহিন ভেতর-০৩)
কবিরা সাধারণত নষ্টালজিয়ায় ডুবে কবিতা লিখে পাঠককে আনন্দ দিতে ভালোবাসেন। কবি ভাবেন এক, পাঠক ভাবেন আরেক। তখন কবিতার চিত্রের রূপ আর পাঠকের চিত্রের দোল খেতে থাকে। মাঝে মাঝে এমনও হয় পাঠক ও কবিকে ফোন/পত্রের মাধ্যমে জেনে নিতে চায় কবিতার চিত্রের ধরন। কবির ভাষায়-
আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় কেন
ক্যান এত তপ্ত কথা, ক্যান পাশ ফিরা শোয়,
ঘরের বিছান নিয়া ক্যান অন্যধান খ্যাত রোয়?
অথচ বিয়ার আগে আমি তার আছিলাম ধ্যান।
কবি যেমন গ্রাম্য সারল্যতায় ভেসে ভেসে চিত্রকল্পে হাত পাকিয়েছেন তেমনি প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠ অন্তস্থ করে নিজের ভাষায় প্রকাশ করেন তার নিজস্ব ভঙ্গিমা। কবি ‘বালিকা’ কবিতায় বলেন-
বালিকা সেদিন গেলো জলের কিনারে
ছলকিয়ে ওঠে জল, বলে ওঠে- আরে!
আমি কি আয়না নাকি! আমি এক বুক
ঐদি তার দেহ ডোবে আমাতে ডুবুক।
(আমার সমাধিকালের প্রসাধন-৩৫)
কবিতার কবি আর দেশাত্ববোধের কবির মধ্যে পার্থক্য এক জায়গায়। তা হলো শব্দে তার দ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে বাস্তবতার মুখোশ হাতে নিয়ে। কেউ হবে সত্যের, কেউ হবে ইতিহাসের। কেউ হবে সময়ের, কেউ হবে অনাদিকালের। সৈয়দ শামসুল হককে আমরা পেয়েছি অনাদিকালের। পরিচয় কবিতা থেকে কবির ভাষায়-
পরিচয়ে আমি বাঙ্গালী, আমার আছে ইতিহাস গর্বের
কখনোই ভয় করি না কো উদ্যত খড়গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি স্বপ্নের সাথে বাস
অস্ত্রেও শান দিয়েছি, যেমন শস্য করেছি চাষ।
একজন সৃজনশীল স্রষ্টার কাজ হচ্ছে সৃষ্টি করে যাওয়া। মূল্যায়ন হতে পারে, না ও হতে পারে। অকৃতজ্ঞ জাতিগোষ্ঠী হলে যা হওয়ার তাই হবে। তবে আমাদের এই কবির সব্যসাচী স্বীকৃতি নিয়ে কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেন, ‘তাকে সব্যসাচী লেখক বলা হতো। মহাভারতের বীর অর্জুন সব্যসাচী নাম পেয়েছিলেন। তার কারণ তিনি বাম হাত এবং ডান হাত, দুই হাতেই সমানভাবে ধনুকের জ্যাঁ আকর্ষণ করতে পারতেন। আমাদের বাংলা ভাষাতে ঠিক এই রকম আর একজন লেখক পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না, যার কলম অর্জুনের ধনুকের মতোই ক্ষুরধার এবং অনর্গল সৃৃষ্টির এমনটা দ্বিতীয় আর কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি।’ আসলে তাই। এই কবি সমানতালে সাহিত্যের সব জায়গায় সফলভাবে ঢুঁ মারতে সক্ষম হয়েছেন।
সৈয়দ শামসুল হকের সৃষ্ট নাট্যকাব্য বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। এ কথা নিঃসন্দেহে নির্দ্বিধায় বলা যায়। তার কাব্যনাট্য নিয়ে আলোচনা যেমন সমালোচনাও আছে তেমন। তবে আলোচনা তথা ভালো ও আস্থার এবং বিশ্বাসের অংশটুক গ্রহণ করা যেতে পারে। অনেকে আমার সাথে একমত নাও হতে পারেন। তারও কারণ আছে। যেমন ‘মৃত্যুকে সমুখে রেখে’ কবিতায় আস্থা ও বিশ্বাসের সাথে বৈপরীত্য থাকতেই পারে। এটাই স্বাভাবিক। কবির লেখায়-
মৃৃত্যুদূতের নানা বিভীষিকা দেখে উঠেছি
কখনো সেই বিভীষিকা আমার কাছে এসেছে।
ডুবুরিদের মতো সর্বাঙ্গে কঠিন আঁটো কালো জামা পরে,
কখনো বুকের ওপরে বিশাল রোখ
ও তার নিচেই গজালের মতো দাঁতের পাটি নিয়ে;
নগ্ন নারী মূর্তি ধরেও তারা দেখা দিয়েছে।
শরীরে তাদের ভোগ কামনার সব কিছুই সুচারু ও সুগোল,
কেবল হাতের আঙ্গুলগুলো শানানো ক্ষুরের মতো তীব্র ধারালো।
(আমার সমাধিকালের প্রসাধন)
কবিতার মতো কাব্যনাট্যেও কিছুটা সমস্যা ছাড়া বেশির ভাগ সৃষ্টি গ্রহণ করার মতো। তাঁর ‘পরিচয়’ কবিতাটি এবং ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকটি তাকে বাঁচিয়ে রাখবে যোজন যোজন কাল। কবি সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাট্য সম্পর্কে নাট্যকার আতাউর রহমান বলেন, রবীন্দ্র-উত্তর বাংলা সাহিত্য নির্মাণের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধদেব বসু এবং আমাদের দেশের সৈয়দ শামসুল হক বিচিত্রবর্ণে পল্লবিত করেছেন আমাদের সাহিত্যভাণ্ডারকে। সৈয়দ শামসুল হক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যথার্থই উত্তরসাধক।
বাংলা সাহিত্যে গোষ্ঠীবাদিতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং প্রগতিবাদিতা এসব যুথবদ্ধতার বদ্ধ নিরিখে কেউ কেউ রয়ে যান আলো আঁধারীর মাঝপথে। এমন অনেক বিদগ্ধ সাহিত্যিক আছেন যাদের নিয়ে এ জাতির উত্তরসূরিরা কাজ করেননি। এই জায়গায় সৈয়দ শামসুল হকও ব্যতিক্রম নন। আমরা চাইব সঠিক মূল্যায়ন এবং সৃষ্টির উল্লাস। কাজ করার ক্ষেত্র। আবার এমনও দেখা যায়, পদক এবং বিশেষণে বিশেষায়িত করে ব্যক্তিকে বসিয়ে দেয়া হয় জানালাহীন বদ্ধ ঘরে। এমনটিও আমরা প্রজন্ম চাইব না।
সময়ের এক কাঠিন্যতায় কবি আল মাহমুদ বলেন, ‘পঞ্চাশের কবি হিসেবে শহীদ কাদরী, শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ এই তিনজন এক সাথে থাকার প্রসঙ্গ বহুল উচ্চারিত হলেও আসলে আমরা ছিলাম সংখ্যায় আরো অধিক। এদের প্রত্যেকেই শক্তিমান লেখক হিসেবে পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠা পান, সৈয়দ শামসুল হক বয়সে এক বছরের বড় ছিলেন। ফলে তাকে আমি হক ভাই বলেই সম্মোধন করতাম। আমরা যেহেতু এ শহরে এসেছিলাম কবিতাকে জীবনের অংশ বলে প্রতিষ্ঠা করতে। ফলে আমাদের সে আড্ডার মূল ছিল কবিতা অর্থাৎ সাহিত্য।’ অগ্রজ কবিদের ক্ষেত্রে আল মাহমুদই সৈয়দকে দৃঢ়চিত্তে স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করেননি। কে স্বীকৃতি দিলো বা না দিলো তাতেইবা কি! সৃষ্টির প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও আস্থাই নিয়ে যাবে সৃষ্টাকে বহুদূর।
এ স্বীকৃতির আম্রতায় সৈয়দ হকের ‘এপিটাফ’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতি টেনে শেষ করছি আজকের আলোচনা-
আমি কে তা নাই বা জানলে
আমাকে মনে রাখবার দরকার কি আছে?
আমাকে মনে রাখবার?
বরং মনে রেখো সব দাঁতের পাটি,
সন্ধ্যার চলচ্চিত্র আর জন্মহর জেলি।
আমি এসেছি, দেখেছি, কিন্তু জয় করতে পারিনি।
যেকোন কাকতাড়–য়ার আন্দোলনে,
পথিক, বাংলায় যদি জন্ম তোমার,
আমার দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাবে।
একেই বুঝি মানুষ বলে
নষ্টজলে পা ধুয়ে দেয় এখন উপায় কি?


আরো সংবাদ



premium cement
মধুখালীর ঘটনায় সঠিক তদন্ত দাবি হেফাজতের ফর্মে ফিরলেন শান্ত জামায়াতের ৫ নেতাকর্মীকে পুলিশে সোপর্দ যুবলীগ কর্মীদের, নিন্দা গোলাম পরওয়ারের চায়ের সাথে চেতনানাশক খাইয়ে স্বর্ণালঙ্কার চুরি ঈশ্বরগঞ্জে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি ব্যারিস্টার ফারজানাকে সংবর্ধনা যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে‘ভিত্তিহীন' তথ্য ব্যবহারের অভিযোগ বাংলাদেশ সরকারের মোদির মুসলিমবিরোধী মন্তব্যের প্রতিবাদ করায় সংখ্যালঘু নেতাকে বহিষ্কার ফ্লোরিডায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটের নতুন কনসাল জেনারেল সেহেলী সাবরীন চান্দিনায় পানিতে ডুবে একই পরিবারের দুই শিশু মৃত্যু কেএনএফ সম্পৃক্ততা : গ্রেফতার ছাত্রলীগ নেতা সম্পর্কে যা জানা গেছে দেশে টিআইএনধারীর সংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ

সকল