২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মানবিক মুক্তি এবং জীবনের আয়না

-

জগতের শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষ। তার যেমন দেয়া হয়েছে জ্ঞান, তেমন সে অর্জন করে থাকে বিচিত্র জ্ঞান। এ বিশ্ব চরাচর তার নিমিত্তেই সৃষ্টি করা হয়েছে। এ সৃষ্টিরহস্য ভেদ করা কঠিন। কারণ মানুষকে দেয়া হয়েছে পূর্ণতার ওপর প্রতিষ্ঠিত জ্ঞান যা সে জানতো না। জগতের শৃঙ্খলা এবং রহস্য অনুধাবন করা একমাত্র শ্রেষ্ঠ জীবেরই সম্ভব। এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। বিশ্ব হলো জটিল ক্রীড়া ক্ষেত্র। ভবের দশা আর পারলৌকিক বিষয় এক নয়। এই দশা থেকে মুক্তি চিন্তা মানুষের পক্ষে সম্ভব। খেলার প্রথম দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থান অধিকারীরাই পুরস্কার পেয়ে থাকে। কিন্তু যে সামান্য কারণে চতুর্থ রয়ে গেল তার জন্য কি কোনো পুরস্কার থাকবে না। সবচেয়ে কাছের পুরস্কার যে পেয়েছে তাকে জাঁকজমক পূর্ণভাবে অনুষ্ঠান আয়োজন করে তাকে দেয়া হলো পুরস্কার সংবর্ধনা এবং প্রশংসা কিন্তু সামান্য কারণে যে পায়নি সে কি কিছুই পেতে পারে না। তার জন্য কি কিছুই করার নাই। এটা চিন্তাশীল সমাজকে ভাবিয়ে তোলে। আমরা জগতের গোলকধাঁধায় পড়ে সত্য মিথ্যা পার্থক্য করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। মুখোশধারী ব্যক্তিরা আজ বড় হয়ে আমাদের সামনে এসে হাজির হচ্ছে। মিথ্যার পথের পথিক আজ আর বক্র মনে হয় না। তারা আজ হয়েছে প্রশংসার পাত্র। আজ মানবের প্রকৃত রূপ দেখার জন্য আমাদের খোয়াজ খিজিরের চশমাটা দরকার। কিন্তু কোথায় পাব খিজিরের চশমা। আমরা যত জ্ঞান অর্জন করতে থাকব ততই চোখের জ্যোতি বৃদ্ধি পাবে। তবে মিথ্যা জ্ঞান চর্চা নয়। বস্তুবাদ এবং ভোগবাদী শিক্ষায় যদি আমরা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি তাহলে আমাদের চোখের জ্যোতির কিছু ভাটা পড়বে। কারণ এর দ্বারা মানবিক গুণের চেয়ে পাশবিকতা স্থায়ী মনে হয়। আর এই ভোগবাদ থেকে মুক্তি পাওয়া অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। কারণ মানুষের সুকুমার বৃত্তির বিকাশ সাধন এবং কুপ্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য শিক্ষা দরকার। কিন্তু আজ শিক্ষিত সমাজ বেশি প্রবৃত্তির খেয়ালিপনার কাছে নতি স্বীকার করছে। তারা আর আচরণে জ্ঞানের পরিচয় দিতে পারছে না। তার কারণ প্রবৃত্তির স্বেচ্ছাচারিতা। এই প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব সত্য জ্ঞানের মাধ্যমে।
মানুষের জীবনে মুক্তি আসে দুই ভাবে। জাগতিক ও পারলৌকিক। জগতে যন্ত্রণা তাকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে চলেছে। দুঃখ, জ্বরা, ব্যথা, জ্বালা, সে সহ্য করে চলেছে। যা থেকে মুক্তি সম্ভব না। তার যেমন আছে বিরহ, ব্যথা, তেমন প্রিয় বিয়োগ এবং অপ্রিয় সংযোগ তার জ্বালাকে আরো বৃদ্ধি করে চলেছে। এ থেকে নিষ্কৃতির উপায় নিয়ে যেমন গৌতম বুদ্ধ নির্বাণতত্ত্ব প্রচার করেছিলেন তেমন বার্ট্রার্ন্ড রাসেল ঞযব পড়হয়ঁবংঃ ড়ভ ঐধঢ়ঢ়রহবংং গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। কিন্তু তারা এ জ্বালা থেকে পরিপূর্ণ মুক্তির সিদ্ধান্ত দিতে ব্যর্থ হয়েছে। গৌতম বুদ্ধ অষ্টাঙ্গিক মার্গের মাধ্যমে নির্বাণের কথা বলেছেন। ঞযব পড়হয়ঁবংঃ ড়ভ ঐধঢ়ঢ়রহবংং গ্রন্থে বার্ট্রার্ন্ড রাসেল দুঃখের কারণ এবং সুখের কারণ এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে ভোগে সুখ নেই ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। মানুষ আজ স্থূল সুখের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। যার কারণে পানশালা আর ব্যভিচারে পরিণত করেছে বিনোদন ও পর্যটন স্পটগুলো। মানুষের মননশীল দিকগুলো উত্তরণের চেয়ে পাশবিক দিকগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। যার কারণে জগতের সঙ্ঘাত এবং সংঘর্ষ বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের ভিতর হিং¯্রতা ও ধ্বংসাত্মক দিকগুলো ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে চলেছে। আজ মানুষ বস্তুবাদকে স্বাগত জানায়। মনের ও আত্মার জ্যোতি সৃষ্টি করায় তার নেই কোনো পরিকল্পনা। কিন্তু দেহ যেমন গুরুত্বপূর্ণ আত্মাও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আজ মানুষের বস্তুগত বিষয়ের প্রতি যত মনোযোগ তার চেয়ে কম মনোযোগ আত্মিক বিষয়ের প্রতি আমরা আমাদের সমাজব্যবস্থায় এই দুটোকেই সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে চলতে হবে। নয়তো হিংস্রতা ও ধ্বংসকামী মানবসমাজকে
ধ্বংসস্তূপে পরিণত করবে। আজ জাতীয় উন্নয়নের জন্য আমাদের ব্যক্তি উন্নয়ন অপরিহার্য। ব্যক্তি উন্নয়ন না ঘটলে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। আজ বিভ্রান্ত মতাদর্শ ও যান্ত্রিক জীবন মানুষকে কঠিনভাবে বেঁধে রেখেছে। যার কারণে তার জীবন সংশয় হয়ে পড়েছে। আর এ থেকে পরিত্রাণ পেতে পারলে মানুষের জীবনে নেমে আসবে ঘোর অন্ধকার। সত্য জ্ঞানে আছে আলো, আর এ আলো আমাদের জীবনে অন্ধকার দূরীভূত করে আলোর মশাল জ্বালিয়ে থাকে। মানুষ পায় মুক্তি। মানুষের জীবনে মুক্তি আসলে সে শান্তিতে থাকতে পারে না। তার জন্য চাই শিক্ষা। চাই শিল্প-সাহিত্য। চাই সংস্কৃতি বিদ্যা আর জ্ঞান এক নয়। বিদ্যায় প্রাজ্ঞ ব্যক্তির জ্ঞানের জোর নাও থাকতে পারে। জ্ঞানে যে বড় সে আসলে বড়। তার জন্য বড় বড় পোস্ট, পজিশনের দরকার হয় না। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তার জ্ঞানে। সে জ্ঞান তাকে নিয়ে গেছে স্বর্গীয় দূতেরও উপরে। যার কারণে মানুষ হয়েছে মর্যাদার পাত্র। এই মানুষ আবার নি¤œ শ্রেণীর মিথ্যা চর্চার কারণে হয়েছে জগতে সবচেয়ে বঞ্চিত ও নিগৃহীত পাত্র। তাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা হয়ে থাকে। শ্রেষ্ঠ প্রাণীর দশা যাতে এমন না হয় তার জন্য সত্য শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত রাখতে হবে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, রাষ্ট্র, ভাষা তথা স্থান কাল পাত্রভেদে মানুষ একই গ্রহের বাসিন্দা। তাকে হেয়প্রতিপন্ন করা হলে তা হবে তার মূল পরিচয়ের বিপরীত। আজ বিশ্বের বর্ণবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের নিচু দৃষ্টিতে দেখে, ধর্মের মাধ্যমে বিভিন্ন সমাজ সৃষ্টি করা হয়েছে। এক ধর্মের লোক আর এক ধর্মের লোককে হীন এবং নিচু দৃষ্টিতে দেখে। যার মাধ্যমে মানুষ হীনম্মন্যতার পরিচয় দেয়। আজ অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং সঙ্ঘাত বিশ্বশান্তিকে বিপর্যয়ের ভিতর ফেলে দিয়েছে। মানুষের পরিচয় মানুষ হিসেবে দেয়ার পরিবর্তে হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার খেলায় মেতে উঠেছে। যা বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ, আজ এমন মারণাস্ত্র আবিষ্কার হচ্ছে যা বোটমে চাপ দেয়ার মাধ্যমে এক শহরের মানুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মুহূর্তের মধ্যে বিদায় দেয়া সম্ভব। এমন গতি ও সহিংসতার সাথে মানুষের পূর্বে পরিচয় ছিল না। মানুষ যদি নিছক প্রাণী হয় তাহলে তার আর কোনো দায়দায়িত্ব থাকে না। কারণ আরো দশটা প্রাণীর মতো সে একটি প্রাণী। আর যদি মানুষ শ্রেষ্ঠ প্রাণী হয় তাহলে তার দায় দায়িত্ব থাকবে। আবার যদি মানুষ বিবর্তনের মাধ্যমে এমনিতেই সৃষ্টি হয় তাহলে তার কোনো জবাবদিহিতার জায়গা থাকে না। সে হয় নিছক পশুতুল্য প্রাণী। কিন্তু যদি কোনো পরমসত্তা তাকে সৃষ্টি করে থাকে তাহলে তার জবাবদিহিতার একটি জায়গা থাকবে। তার পুরস্কার ও তিরস্কার পাওয়ারও একটি জায়গা থাকবে। যার মাধ্যমে তার আচরণ ও সংশোধন ও পরিমার্জনের সুযোগ থাকে।
বিশ্বের মানুষ আজ শান্তি অন্বেষায় ছুটে চলেছে। কিন্তু কোন পথে আসবে শান্তি তা মানুষ আজ আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হচ্ছে। মানুষের হাতে যে অস্ত্র আছে তার দ্বারা পৃথিবীকে কয়েকবার ধ্বংস করা যায়। সুতরাং নিজে নিজে ধ্বংস হবে না, পরমসত্তার বাঁশির আওয়াজে ধ্বংস হবে তা নিয়ে চিন্তাশীল মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। এই ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচার জন্য বিশ্ববাসী জাতিসঙ্ঘের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু জাতিসঙ্ঘ শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। কারণ জাতি ঊর্ধ্ব সংগঠন যদি তৈরি না হয় এবং ক্ষমতার যদি দুর্বলতা থাকে তাহলে এক জাতির ইশারার ওপর নির্ভর করবে বিশ্বের শান্তি ও স্থিতি। আমরা বিশ্বের মানুষ শান্তির জন্য জাতি ঊর্ধ্ব সংগঠন হিসেবে দেখতে চাই জাতিসঙ্ঘকে।
বিশ্বের মানুষের মানবিক মুক্তির জন্য চাই সত্য জ্ঞানের শিক্ষা। টেক্সটবুক বোর্ড যদি ও নিয়ে ভাবেন তাহলে এটা সহজ হবে। জাতি ঊর্ধ্ব সংগঠন বিশ্বের মানুষ তৈরি করতে পারবে কি না জানি না। তবে জাতির ভিতর যদি মননশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা হয় এবং ভালোবাসার শিক্ষা ঢুকানো যায়, নিজের পরিচয়ের জ্ঞান প্রতিষ্ঠা করা যায় তাহলে তার মন হবে উদার, মহৎ, বৃহৎ এবং সৃজনশীল। যার দ্বারা অশান্তির চিন্তা না পাওয়া যাওয়াই স্বাভাবিক। যার মাধ্যমে বিশ্বের মানুষ এক মোহনায় শান্তির বাঁশি বাজাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
মূলত মানুষকে উদার হতে হলে সাহিত্যের সৌরভে মাখতে হবে। সাহিত্য মানুষকে পরিশীলিত করে। সুশীল করে। চিন্তার জগৎ প্রসারিত করে। কেন না সাহিত্য জীবনের আয়না। সুতরাং জীবনকে দেখতে হলে সাহিত্যের আয়নার সামনে দাঁড়ানো উচিত। হ


আরো সংবাদ



premium cement