২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মানুষ

-

লাহুড়িয়া বাজারের বেশ পুরনো ডাক্তার ওবায়দুর। গ্রামের মানুষ বিপদে আপদে তার কাছে ছোটে। সেও ছোটে । ছোটাছুটিতে দিনরাতের ব্যবধান নেই। গভীর রাতে প্যাশেন্ট ফোন দিলেও তিনি ছুটে যান। সুলতানা তার স্ত্রীর ঘোরতর আপত্তি। এই যে রাত ১২টায় আলম চাচার বাড়ি থেকে ফোন। যাবে না! সুলতানা শুনেই জ্বলে ওঠে। ফোন দিলেই ছুটতে হবে? রাত কত গভীর হয়েছে! ওবায়দুর হাসে। রাতের আবার গভীরতা! শত না হাজার? ফুট না কিলোমিটার? সুলতানা আরো রেগে যায়। মাঝখানে একবার যে বাইক নিয়ে ড্রেনের ভেতর পড়ে গিয়েছিলে তাতেও শিক্ষা নেই!
Ñ ভাগ্যে যা আছে তা হবে। ভাগ্যে যদি দশবার ড্রেনে পড়া থাকে আমি দশবার পড়ব। ড্রেনের ভেতর চুবনি খাব, সাঁতার কাটব। তুমি ঠেকাতে পারবে?
Ñ আর যাচ্ছি ঠেকাতে। সারারাত কাউ কাউ করলেও যাব না। মোবাইল বন্ধ করে রাখব। দরকার পড়লে মোবাইল ফ্রিজে রেখে দেবো, চুলায় ভাজি করব। চুবনি খাওয়া মানুষ আসলে তার খাবার দরকার হবে...। সুলতানা কথার ঝড় তোলে। কথার ঝড় আছে কিন্তু কথা ঝড়ের সঙ্কেত নেই! থাকলে বলা যেত দশ নাম্বার মহাবিপদ সঙ্কেত। ঝড় চলুক, থেমে যাক তা নিয়ে ওবায়দুরের চিন্তা নেই। সে জানে এসব রাগের কথা। রাগের সময় মানুষ অনেক কথা বলে। মাঝে মাঝে ভাবে মানুষ কী! ওবায়দুর তার মহান কাজে বেরিয়ে যায়। আলম চাচা বয়স্ক মানুষ। সারাদিন সুস্থ। সন্ধ্যা নামার আগেও ঝুম বৃষ্টিতে মাছ ধরেছে। বর্ষা বিদায়ের আগে মাঝে মধ্যে এমন বৃষ্টি হয়। কাছা মেরে মাছ ধরতে দেখে বলে, কী খবর চাচা?
Ñ আর কইয়ো না বাপ। মাছ না একটা আস্তো ছাগল পাইছি। গরিব মানুষ। এইডে দিয়েই মাস চালায় দিবানি।
Ñ কী বলেন! ড্রেনের পানিতে ছাগল?
Ñ হয়। এক প্রকার ছাগলই । দেখে যাও মিয়া।
ওবায়দুর এগিয়ে যায়। বড় প্লাস্টিকের বালতির ভেতর পাঁচ সাত কেজি ওজনের রুই মাছ। আলম চাচা উচ্ছ্বসিত গলায় বলেন, ‘বর্ষা তো চইলা গেল। তোমার জন্যি রাখবানি। কাল আইসো। মাছ খাবা মাছ।’ এমন ভাবে বলেন যেন পৃথিবীর মানুষ মাছ জাতীয় জিনিস এর আগে দেখেনি। খায়নি।
ওবায়দুর ঘাড়, মাথা, হাত-পা সবকিছু একসাথে নাড়ে। মাছ খাবে মাছ। ঠিক আছে আসব।
রাতের বেলা সে মানুষটার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছে। বৃষ্টিতে অনেকেই মাছ ধরে, সবার কি জ্বর আসে! রোগব্যাধির কিছু সময় থাকে। সিজন থাকে। ডায়রিয়ার সময় ডায়রিয়া। জ্বরের সময় জ্বর। করোনাকালে শুধু করোনা। সিজনে ব্যাধি ছড়ায় ঘরে ঘরে। এক বাড়ি পাঁচজন মানুষ থাকলে তিনজন অসুস্থ। দু’জন সুস্থ কেন! নিজে নিজেই উত্তর বের করে। একজন রান্নার আরেকজন ওষুধ কেনার জন্য! আপন মনে আবার ফিক করে হেসে ওঠে। আলম চাচার বাড়ি দেড় কিলোমিটার দূর। বাইক নিয়ে পৌঁছতে খুব একটা সময় লাগে না। মিনিট পাঁচেকের ভেতর পৌঁছে যায়। বেচারা মলিন মুখে বিছানায় পড়ে আছে। একটু পরপর মৃদু শব্দের কথা। বিড়বিড় করছেন। ওবায়দুর কপালে হাত দিয়ে দেখে। বেশ গরম। কী হয়েছে চাচা?
Ñ কে? পিটপিট করে তাকায়।
Ñ আমি। ওবায়দুর।
Ñ কিসের ওবায়দুর! ওবায়দুর! বহুদূর..... আমি এখানে থাকব না। মাছ ধরিনি মাছেই আমাকে ধরেছে। আলম চাচার ছোট মেয়েটা বাবার অবস্থা দেখে আড়ালে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। ওবায়দুর একটা ইঞ্জেকশন পুশ করে বলে, জ্বর পড়ে যাবে। কিছু ওষুধ দেয়। এগুলো খাওয়ান ঠিক হয়ে যাবে। ভয়ের কিছু নেই।
বাড়ি এসে দেখে ঝড় থামেনি। মানবতা, মহানুভবতা, মানবসেবা, মানবিক, মন ওয়ালা, মহান, মহীয়সী...। ওরে বাবা ঘরের খবর নাই পরের জন্য দরদ বৃষ্টির মতো আছড়ে পড়ে। বউয়ের বিরামহীম চিৎকার।
Ñ রাত কতো হলো সে খেয়াল আছে?
Ñ নাহ, আপনার খুব খেয়াল আছে। সকাল হতে তো খুব বেশি বাকি নেই। দেখেন আর দুয়েকটা প্যাশেন্ট ফোন দেয় কিনা।
কথা শেষ হয় না মোবাইলটা বেজে ওঠে। ছোট সুমুন্দির ফোন। বকুল। কিছুটা পাগলাটে স্বভাবের মানুষ। কবি কবি ভাব নিয়ে চলে। তার নাম বকুল না হয়ে কবি, গল্প, উপন্যাস ধরনের হলে ভালো হতো। রাত ৩টা! এতো রাতে! সুলতানা ক্ষেপে ওঠে, এই তো চলে এসেছে। যাও যাও।
Ñ না আর মানবতা দেখাব না। নাও মোবাইলটা তুমি রেখে দাও। সুলতানা রাগের সাথে মোবাইল হাতে নেয়। আবার রিংটোন বাজে। মোবাইলটা আছাড় মেরে ভেঙে ফেলতে পারলে তার মনের আগুন কিছুটা কমতো। স্ক্রিনে চোখ যেতেই কেঁপে ওঠে। ছোট ভাই!
Ñ হ্যালো।
Ñ হ্যালো ট্যালো বাদ দে। ওবায়দুর কই? কাঁপা কাঁপা গলায় কথা বলে বকুল।
Ñ কী হয়েছে?
Ñ আরে ওবায়দুর কে দে। কিছু সমস্যা বুঝতে পেরে সুলতানা দেরি করে না।’ ছোট ভাইয়া কী বলবে একটু শোন তো।’
ওবায়দুর হাসি ছড়িয়ে মোবাইল নেয়, বলেন ভাইজান ।
Ñ বলার মতো না তবু বলি। যায়েদ দুই তিন দিন খুচরো খুচরো বাথরুম করে। চাপিয়ে রাখছে।
Ñ কষা হয়েছে হয়তো। বেশি সমস্যা হলে গ্লিসাপ ঢুস দিয়েন । ক্লিয়ার হয়ে যাবে।
Ñ দিলাম তো। কিন্তু গ্লিসাপের বদলে ক্লোফেনাক ফিফটি দিয়ে ফেলেছি। ব্যস্ততায় গুলিয়ে গেছে।
ওবায়দুর চমকে উঠে। দুই বছরের শিশু। বুড়োদের যখন অনেক জ্বর হয়। সাধারণ ট্যাবলেটে কাজ হয় না তখন সাধারণত ক্লোফেনাক ঢুস দেয়া হয়। দ্রুত তাপ নেমে যায়।
Ñ করেছেন কী!
Ñ করেছি তো। ফ্রিজে ছিল ভুলক্রমে একটার বদলে আরেকটা হয়ে গেছে।
Ñ কতক্ষণ আগে দিয়েছেন?
Ñ এই তো মাত্র দিলাম।
Ñ দ্রুত আঙুল ঢুকিয়ে বের করুন। না পারলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। ফোনটা কেটে দেয় বকুল। সুলতানা টেনশনে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। একের পর এক কল দেয়। ওপ্রান্তে সাড়া মেলে না। মিনিট পাঁচেক পর কল আসে, ওবায়দুর ফোন ধরে। কী অবস্থা? বকুল কবি বেশ উতফুল্ল। পেরেছি। পুরো বের করে ফেলেছি। সব মালিকের দয়া।
Ñ জি।
ছোট এক ঘুমে রাত পেরিয়ে যায়। সকালবেলা হালকা শীতল স্নিগ্ধ বাতাসে ঘুরে ফিরে বাড়ির পথ ধরে। বাড়ি ফিরতে প্রথম নজর কাড়ে কষ্ট করে সাজানো মেহগনি বাগান। পরিবেশ বাঁচাতে গাছ লাগানোর বিকল্প নেই। ডাক্তার হিসেবে গাছ লাগিয়ে তিনি তার মহান দায়িত্ব পালন করেছেন। অবশ্য মেহগনি বাগানের গাছগুলো যেভাবে বেড়ে ওঠার কথা সেভাবে বেড়ে উঠছে না। বহু সার-টার দিয়েও কাজ হয়নি। এ ব্যাপারে তার ধারণা নেই। গাছ যদি মানুষ হতো কিছু ভিটামিন, ইঞ্জেকশন, ট্যাবলেট খাইয়ে ভালো মতো চেষ্টা করা যেত। গাছ মানুষ না। গাছের গাল নেই, দাঁত নেই। হাঁ করে না! একটা আক্ষেপ বুকের ভেতর একটা প্রশ্ন মাথায়Ñ মানুষ কী?
বাবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওয়াকি দেখেই দৌড়ে আসে। পাঁচ বছর বয়স। ছেলেটাকে দারুণ লাগে। এসেই বাবাকে জড়িয়ে ধরে। জড়িয়ে ধরেই আর ১০টা ছেলের মতো ক্ষ্যান্ত থাকে না। কয়েকটা মোচড় দেয়। এগুলো শিখেছে ওর ছোট মামা বকুলের কাছ থেকে।
Ñ আব্বু তুমি কত দিন টাকা দাও না এক হাজার টাকা দাও।
Ñ বলে কী! এক হাজার টাকা?
Ñ হ্যাঁ। না হলে দুই হাজার ।
Ñ ছোট মানুষ এত টাকা দিয়ে কী করবে?
Ñ ওই যে আমার বন্ধু আছে না। শামীম... হ্যাঁ।
Ñ ওরা না খুব গরিব। ওর বাবা অসুস্থ। জানো ভাত খেতে পারে না। আমি ওকে বলেছি তোমার বাবার ওষুধ কিনে দেব। কিছু খাবার কিনে দেব। ওবায়দুর ওয়াকির দিকে তাকায়। ছেলেটা মানুষ হচ্ছে। আচ্ছা আজ চেম্বারে বসব না। দু’জন মিলে ঘুরব। খাবার কিনব, ওষুধ কিনব।
ওয়াকির মুখে খুশির আভা। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমার অনেক ভালো আব্বু। কথা শেষ করেই ছুট। যাই বলে আসি। ওবায়দুর বড় বড় চোখে ওয়াকির চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। আপন ছেলেটার কথা, আচরণ এটা ওবায়দুরের নতুন এক প্রাপ্তি। খুশি। মনে মনে ভাবে ছেলেটা কী মানুষ হচ্ছে? আবার ভাবনায় একটা প্রশ্ন এসে দোলা দেয়, মানুষ কী! হ


আরো সংবাদ



premium cement
জবিতে ভর্তি পরীক্ষায় আসন বেড়েছে ৫০টি বিএনপি ক্ষমতায় আসতে মরিয়া হয়ে উঠেছে : ওবায়দুল কাদের মাটির নিচে পাওয়া গ্রেনেড মাইন মর্টার শেল নিষ্ক্রিয় করল সেনাবাহিনী অনির্দিষ্টকালের জন্য অনলাইন ক্লাসে যাচ্ছে জবি, বন্ধ থাকবে পরীক্ষা কুড়িগ্রামে রেলের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদ ক্রিকেট খেলতে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে দেওয়ানগঞ্জের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী শিহাব কিশোরগঞ্জে বৃষ্টির জন্য বিশেষ নামাজ সাতক্ষীরা বৈদ্যুতিক খুটিতে ধাক্কা লেগে মোটরসাইকেলআরোহী নিহত বার্সেলোনাতেই থাকছেন জাভি চতুর্থ দফা ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি : এবারের তাপদাহ শেষেই বৃষ্টিপাতের আশা ফরিদপুরে বৃষ্টির জন্য নামাজে হাজারো মুসুল্লির কান্না

সকল