২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

হুমায়ূন আহমেদের স্পষ্টবাদিতা

-

স্পষ্টবাদী মানুষ যারা, তাদের মিত্রের সংখ্যা কি খুব বেশি হয়? না। কখনোই না। আমাদের সমাজের দুর্ভাগ্য, স্পষ্টবাদী মানুষের সংখ্যা বড়ই কম। জননন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন একজন স্পষ্ট বক্তা। মামুলি ধরনের না। বিশেষ গ্রেডের। ঠোঁটকাটা শব্দটি ব্যবহার করতে কেন যেন রুচি হচ্ছে না। উচিত কথা মুখের ওপর বলার দুঃসাহস তাঁর ছিল। কোনো কিছুর তোয়াক্কা করতেন না বিশেষ। নিজের ক্ষতি হতে পারে, হবেইÑ এটা জেনেবুঝেও এই বিপজ্জনক ও বন্ধুর পথে হাঁটতেন তিনি। যেন বেপরোয়া মনোভাব। এ জন্য ঝুটঝামেলায় কম পড়তে হয়নি তাঁকে। কথায়ই বলে, উচিত কথায় মুরশিদ বেজার।
আপাতদৃষ্টে নরমসরম মৃদুভাষী মানুষটিকে দেখে তাঁর চারিত্রিক কাঠিন্য বোঝা যেত না। কিন্তু সাধারণত নিজের মতের/ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অনড়ই থাকতেন। ভেতরে ভেতরে তিনি ছিলেন অসম্ভব জেদি ও দৃঢ়, সেটা বাইরে থেকে বোঝা ছিল কঠিন। তাঁর অনমনীয় এই দৃঢ়তা সবসময়ই যে ইতিবাচক ছিল, এমন কথা অবশ্য বলা যাবে না। তাঁর সাথে যাঁরা ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁরা এই ব্যাপারটি বেশ ভালো করেই জানেন। এটুকুও বলা চলে যে, হাড়ে হাড়ে তাঁরা চিনতেন ব্যতিক্রমী এই মানুষটিকে।
হুমায়ূন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘকাল ধরে শিক্ষকতা করেছেন। শিক্ষক হিসেবে ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয়। ফুল প্রফেসর ছিলেন রসায়ন বিভাগে। কৃতী ছাত্রও ছিলেন একই বিভাগের। হঠাৎই পাট চুকিয়ে দিলেন শিক্ষকতা পেশার। স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে হইহই করে নেমে পড়লেন চলচ্চিত্র ও নাটক নির্মাণে। যতদূর মনে পড়ে, একাধিকবার নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। জাতীয় নির্বাচন না। বিশ্ববিদ্যালয়ে। একবার পাস করেন। আরেকবার কী ঘটল? সে কথা বলার আগে স্মরণ করে নিই বিখ্যাত লেখকদের নির্বাচনী কপাল বা অভিজ্ঞতা কেমন হয়? তিক্ত না মধুর? আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। সেটা ছিল পরাধীন ব্রিটিশ ভারতের সময়কাল। রাজনীতিক হিসেবে নজরুল সফল হতে পারেননি। ভোটে ডাহা ফেল করলেন। ওই একবারই। ন্যাড়া আর দ্বিতীয়বার বেলতলায় যায়নি। এই তো নিকট অতীতে কবি নির্মলেন্দু গুণ এমপি হতে চেয়েছিলেন। ভোট-ময়দানে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। মার্কাটা কী? কুমির। রেজাল্ট? কী আর? শোচনীয় পরাজয়। হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ!
হুমায়ূন আহমেদ একবার পাস, একবার ফেল। কেন ফেল? পরাজয়ের হেতু কী? ওই একটাই, তাঁর স্পষ্ট কথা। একটু খোলাসা করা প্রয়োজন প্রসঙ্গটি। হুমায়ূন আহমেদ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে শিক্ষক প্রতিনিধি পদের জন্য। ধারণা করা হয়, তাঁর লেখা একটি টিভি নাটকের চাঁছাছোলা সংলাপ তাঁর ওই মর্মান্তিক পরাজয় ডেকে আনে। অনিবার্য নিয়তির মতোই বুঝি বা! নাটকের সিকোয়েন্সটি ছিল এরকমÑ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সম্পর্কে কথা হচ্ছিল। একজন বললেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তো কী হয়েছে? লোকটা তো ছাগল।’ অবশ্য তিনি নিজেও তখন শিক্ষকতা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ব্যস, যায় কোথায়? এই সংলাপ দারুণ তোলপাড় তুলল। ফাটাফাটি বিতর্ক। তুমুল হইচই হলো এ নিয়ে। দুর্দান্ত জনপ্রিয় ছিল তাঁর একেকটি টিভি নাটক। ওই সময়ে টিভি চ্যানেল ছিল একটিই। আজকালের মত গণ্ডায় গণ্ডায় চ্যানেল তখন ছিল না। সবেধন নীলমণি বাংলাদেশ টেলিভিশন। সবাই একটি চ্যানেলই দেখত। মানে দেখতে বাধ্য ছিল। রিমোটের জারিজুরির তেলেসমাতি তখনকার কালে ছিল না। নাটকের ওই তেরিয়া তির্যক সংলাপ দেশজুড়ে মহা আলোচিত হয়। সঙ্গত কারণেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যারা ভোটার, ক্ষুব্ধ হয়ে তারা গোপন ব্যালটে আচ্ছামতো বদলা নিলেন। টিট ফর ট্যাট। যাহা তাহা বদলা না, বলা যায় এক প্রকার মোক্ষম প্রতিশোধ। হুমায়ূন আহমেদের অবশ্য তাতে কিসসু আসে যায় না। কিছু আসেনি, যায়ওনি। তিনি তাঁর বক্তব্যে অনড়, অটল।
জমিয়ে আড্ডা দিতে হুমায়ূন আহমেদের জুড়ি ছিল না। আড্ডার মধ্যমণি থাকতেন তিনিই। কথায় রস চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ত। নিজেকেও ছাড়তেন না। বলেছি, ওই সাহস। কখনো কখনো তা যে হঠকারিতায় পর্যবসিত হয়নি, তা নয়। সাংবাদিকরা তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে ভালোবাসতেন। পাঠকের চাহিদার কারণেই মূলত। সেসব সাক্ষাৎকারে তিনি মজার মজার কথা বলতেন। তাতেও থাকত স্পষ্ট কথা। সাহসী বক্তব্য। যা সচরাচর আমাদের স্বনামধন্য লেখক-বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে আমরা পাই না। কারণ কী? সবাই জানেন কমবেশি। লোকজনকে চটাতে চান না কেউ। চটে গেলে নিজের সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে যে! হুমায়ূন আহমেদের নির্বাচিত ১২টি সাক্ষাৎকার নিয়ে আমার সম্পাদনায় একটি গ্রন্থ বেরিয়েছে ২০১৪ সালের একুশে বইমেলায়। ২০৮ পৃষ্ঠার এই বইটি বের করেছে সময় প্রকাশন। এ বইয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছিল নন্দিত কথাশিল্পীর জীবদ্দশায়ই। তাঁর সাগ্রহ অনুমোদন ছিল এই পরিকল্পনায়। ওইসব সাক্ষাৎকারের দু’-একটি প্রসঙ্গ উত্থাপন করছি।
ওই গ্রন্থভুক্ত একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন আজকের খ্যাতিমান অভিনেতা মাহফুজ আহমেদ। মাহফুজ তখন সাংবাদিকতা করতেন। একটি পূর্ণাঙ্গ বই-ই আছে ওর, সে বইটির নাম হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদ ঘরে-বাইরে হাজার প্রশ্ন। সেখান থেকে একটি প্রশ্ন-উত্তর এখানে তুলে দিচ্ছি। প্রশ্নটি ছিলÑ এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? হুমায়ূন আহমেদের সাবলীল উত্তরÑ ‘আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজে যাঁরা আছেন, তাদের কার্যক্রম খুব একটা পরিষ্কার। এরা কেন জানি ইসলাম ধর্মকে খুব ছোট করে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।
হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান অন্য যেকোনো ধর্মের প্রায় সব উৎসবে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা উপস্থিত থাকেনÑ বক্তৃতা করেন, বাণী দেন, কিন্তু ইসলামী কোনো জলসায় কেউ উপস্থিত থেকেছেন বলে শোনা যায় না। তাদের মতে, ইসলামী জলসায় কেউ উপস্থিত থাকা মানে তার বুদ্ধিবৃত্তিও নি¤œমানের। সে একজন প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক লোক। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কাছে হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টানদের কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার অর্থ মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা, প্রগতির চর্চা করা, সংস্কারমুক্ত হওয়া ইত্যাদি। প্রফেসর সালাম ঢাকায় এসে যখন বক্তৃতার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বললেন, তখন আমাদের বুদ্ধিজীবীরা হকচকিয়ে গেলেন। কারণ তাদের কাছে প্রগতিশীল হওয়া, বুদ্ধিজীবী হওয়া, মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা মানেই ইসলামবিরোধী হতে হবে। তাদের কাছে রামকৃষ্ণের বাণী, যিশুর বাণী সবই গ্রহণীয়, এসব তারা উদাহরণ হিসেবেও ব্যবহার করেন, কিন্তু হজরত মোহাম্মদের বাণী কখনো তাদের মুখ থেকে শোনা যায় না। তাদের কাছে হজরত মোহাম্মদের বাণী গ্রহণযোগ্য নয়।
আমার মতে, পৃথিবীর তাবৎ ঔপন্যাসিক যাঁর কোটের পকেট থেকে বেরিয়ে এসেছেন, তার নাম দস্তয়ভস্কি। আরেকজন আছেন মহামতি টলস্টয়। এক রেলস্টেশনে যখন টলস্টয় মারা গেলেন, তখন তাঁর ওভারকোটের পকেটে একটি বই পাওয়া গেছে, তার নাম ঝধুরহমং ড়ভ চৎড়ঢ়যবঃ। বইটি ছিল টলস্টয়ের খুব প্রিয়। সবসময় সাথে রাখতেন। সময় পেলেই পড়তেন।
বইটিতে হজরত মোহাম্মদ সা:-এর বিভিন্ন সময়ে বলা ইন্টারেস্টিং কথাগুলো গ্রন্থিত। আমি বিনয়ের সাথে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কাছে জানতে চাইছি, আপনাদের ক’জন বইটি পড়েছেন? টলস্টয় যে বইটি পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, সেই বই আমাদের প্রত্যেকের একবার কি পড়া উচিত নয়? আমার মতে, প্রতিটি শিক্ষিত ছেলেমেয়ের বইটি পড়া উচিত।’
আমার নিজের নেয়া একটি সাক্ষাৎকারের একটি প্রশ্নোত্তর এখানে উদ্ধৃত করেই ইতি টানছি এই লেখার। ওই সাক্ষাৎকার বেরিয়েছিল দৈনিক আমার দেশ-এ, ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর। হুমায়ূন আহমেদকে করা প্রশ্নটি (স্পর্শকাতর প্রশ্ন বৈকি!) ছিল, ‘বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে আপনার কী অবজারভেশন?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘জাতি হিসেবে আমরা খুবই অস্থির প্রকৃতির। একটি দল ক্ষমতায় এলো। তাদের অঙ্গসংগঠনগুলো যে লাফঝাঁপ শুরু করল, তা বলার মতো নয়। আমাদের নেত্রকোনার ভাষায় বলে ‘উজাইয়া উঠছে’। অন্য একটি দলও যখন ক্ষমতায় আসবে, তাদের লোকরাও একই রকম ‘উজাইয়া’ উঠবে। ছাত্র রাজনীতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। বহুবার আমি এ কথা বলেছি, লিখেছি। পৃথিবীর অনেক দেশে আমি গেছি। থেকেছি, পড়াশোনা করেছি। কিন্তু কোথাও ছাত্র রাজনীতি দেখিনি।
আমাদের রাজনীতিকরা মনে করেন, নিজেদের স্বার্থেই এদের (ছাত্রদের) হাতে রাখা দরকার। আমার ধারণা, তারা বুঝতে পারছেন যে, কাজটা ঠিক হচ্ছে না। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে। অবশ্যই দেশকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে এই ছাত্র রাজনীতি। বিষবৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি। কার লেখায় যেন পড়লাম এরই মধ্যে যে, এই ছাত্র নেতারা অ্যাপ্লাই করলেই বয়স্ক ভাতা পেতে পারবে। তারা অ্যাপ্লাই করছে না, এই যা। অর্থাৎ তারা এতই বুড়া হয়ে গেছে আর কী!’ হ

v


আরো সংবাদ



premium cement
জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থাকে আবার অর্থায়ন শুরু করবে জাপান শেখ হাসিনার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি বিএনপিকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে : ওবায়দুল কাদের রাশিয়া সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টে ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে সিরিয়ায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৩৬ সেনা সদস্য দৌলতদিয়া ঘাটে পন্টুন থেকে নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু অ্যানেসথেসিয়ার পুরনো ওষুধ বাতিল করে কেন নতুনের জন্য বিজ্ঞপ্তি! বাইডেনের মেয়াদে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতির কোনো আশা নেই : রুশ রাষ্ট্রদূত ডিএমপির অভিযানে গ্রেফতার ৪০ নিউইয়র্কে মঙ্গোলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ফ্ল্যাট জব্দ করবে যুক্তরাষ্ট্র! টাঙ্গাইলে লরি-কাভার্ডভ্যান সংঘর্ষে নিহত ১ জিম্বাবুয়ে সিরিজে অনিশ্চিত সৌম্য

সকল