২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভাত

-

সুবহে সাদেকের আকাশ জানান দেয়, ভোরের আলো ফুটতে আর বেশি দেরি নেই। নদীর ওপারে অস্পষ্ট গ্রামটির দিকে তাকিয়ে হাঁক দিয়ে ওঠে জামাল। শ্যামলা বরণ চল্লিশোর্ধ এই জামাল জেলে। চিৎকার দিয়ে ছেলেকে ডাক দেয়,
-কিরে আবদুল এহনো তোর ঘুম ভাঙতিছে না! গাঙে জোয়ার লাইগে গেল জাল পাতবানে কোন সুমায়। তাড়াতাড়ি ওঠ হারামজাদা। খালি শুয়ে শুয়ে গতর বাড়াতিছিস!
কথাগুলো বলেই নিশিন্দা গাছের ডাল ভেঙে দাত ঘষতে থাকে সে। নিশিন্দার ভাঙা ডাল আর পাতাগুলো ফেলে দেয় উঠানের কোণে ময়লার স্তূপের ওপর।
বাবার চিৎকার শুনে ধড়ফড় করে লাফিয়ে ওঠে আবদুল। ঝুপড়ি ঘরের বারান্দায় ওর থাকার জায়গা। সারারাত নদীর জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসা বাতাস লাগে ওখানটায়। খুব ভালো ঘুম হয় রাতে। মশারি খাটানোর দরকার হয় না। একটা বেতি মাদুরের ওপর শুয়ে থাকে সে। কালো চামড়ায় বেতি মাদুরের দাগগুলো দেখা যায় পষ্ট। ঘরের কোণে চালে গুঁজে রাখা এক টুকরো কয়লা হাতে নেয়। মুখে কামড় বসিয়ে একটা আঙুল দিয়ে সজোরে ঘষা দেয় এদিকে-ওদিকে। ঘরের সাথে লাগোয়া পুকুরের পানিতে কুলি করে নেয় দ্রুত। গামছা কোমরে বেঁধে সোজা গিয়ে উঠে পড়ে নৌকায়। আবদুলের বয়স এবার চৌদ্দ বছর। ইশকুল ছেড়েছে সেই কয়েক বছর আগে।
কাজীবাছা নদীর পশ্চিম তীরে জামালের ঘর। মাটির দেয়ালে ঘর। উপরে হেঁতাল আর বাঁশের কাবারির চালা দেয়া। চালার উপর নাড়ার ছাউনি। এবার নাড়া পাল্টানো হয়নি। কোথাও কোথাও পানি পড়ে, তখন আবদুলের মা ঠিলা-গামলা পেতে রাখে। ওয়াপদা বাঁধের বাইরের এই খাস জমিতে প্রায় ২২ বছর ধরে বসবাস করছে সে। মাঝে মধ্যে জোয়ারের পানি ভরলেই উঠান তলিয়ে যায়। আশা এইটুকু, এপারে ভাঙার ভয় নেই। এপারের চর বাড়ছে দিনকে দিন। ভাঙছে তো ওপার, শিয়ালীডাঙা ও বুজবুনিয়া পারের গ্রাম। একেবারে ভেঙে সয়লাব। তিন মেয়ের পর ছেলে আবদুলের জন্ম। জামালের ঘরে আবদুল এসেছে আশার আলো হয়ে। আবদুল। ভোরের হেসে ওঠা আলোর মতো, জামালের এই মাটির ঘরটায়।
নৌকার দুই মাথায় দু’জন। বৈঠা হাতে জামাল। একটান দিয়ে একটি বাঁশের চোঙ ফেলে পানিতে, ওপাশ থেকে আবদুল ফেলে পোড়ামাটির চাড়া। পানিতে তলিয়ে যায় চাড়া, ভেসে থাকে বাঁশের চোঙ। মাঝখানে ইলিশ ধরা জাল। নৌকার পাটাতন থেকে সব জাল পানিতে ফেলে আনন্দের ঢেঁকুর তোলে জামাল। কোমরে গিট দেয়া লুঙ্গির ভাঁজ থেকে গোপাল বিড়ির প্যাকেটটি বের করে সে। একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে বিড়ির মাথায় আগুন দিয়ে দেয়। মুখের সব শক্তি দিয়ে জোরে জোরে কয়েক টান দিতেই বিড়ির আগুনে পূর্ণতা পায়। একটি সুখটান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে দেয়। গাঢ় ধোঁয়ার কুণ্ডলী ধীরে ধীরে বাতাসে মিলিয়ে যায়। নৌকার আরেক মাথা থেকে বলে ওঠে আবদুল,
-বাজান, বিয়ানে কিছু খাতি অবে না?
-হ, খাতি অবে। তোর মা’রে জাউ রানতি কয়ে আইছি। এতক্ষণ মনে অয় রান্দা অয়ে গেছে। তোরে নামায় দিচ্ছি যা, জাউ খায়ে আমার দুন্নি নিয়ে আসিসকানে।
-ঠিক আছে বাজান।
আবদুলকে চরে নামিয়ে দেয় জামাল। নৌকা থেকে নিজেদের ঘরটা বেশি দূরে নয়। চরের কাদা ভেঙে ডাঙায় উঠে যায়। চিকন বেড়ি বেয়ে হাঁটতে থাকে সে। হঠাৎ পেছন থেকে আবার ডাক দেয় জামাল।
-আবদুল শোন।
আবার ফিরে দাঁড়ায় আবদুল।
- আসার সময় বেশি করে পান সুবরি নিয়াসিস কিন্তুক। তামুকও নিয়ে আসিস।
আবার হটহট করে হেঁটে যায় আবদুল।
ক্ষুধার্ত পেটে ঘরে ফিরে এক থালা জাউভাত খেয়ে নেয় আবদুল। একটা গামলায় তেঁতুলমাখা গুড়সহ খাবার গুছিয়ে দেয় আবদুলের মা। পান সুপারি তামাক সবকিছু ঠিকঠাক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নৌকার উদ্দেশ্যে। বলিষ্ঠ গড়ন আর সুঠাম দেহের আবদুল। বাবার ইলিশ মাছ ধরার একজন পূর্ণাঙ্গ সহযোগী। ইশকুল ছাড়ার পর থেকেই বাবার সাথে আছে সে। এখন তো পুরোদস্তুর মাছ শিকারি।
সকালের নাস্তা পানি, পান সুপারি ও তামাক নিয়ে নৌকায় পৌঁছে আবদুল। পায়ের কাদা ছাড়িয়ে উঠে বসে নৌকার গলুইয়ে। কাপড়ের পুঁটলি থেকে নাস্তা বের করে খেতে বসে জামাল। বৈঠা হাতে হাল ধরে আবদুল। জোয়ারের শেষ, এখনো ভাটা শুরু হয়নি। জোয়ার-ভাটার স্রোত নেই। এমন সময়ে থমথমে থাকে নদী। এখন কি ইলিশ মাছেরা ছুটে বেড়াচ্ছে? চিকন সুতায় ইলিশ আটকে পড়ার অপেক্ষায় থাকে বাপ ও ছেলে। জামালের খাওয়া শেষ হলেই জাল টানা শুরু করবে ওরা। আশায় থাকে আবদুল, ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে একঝাঁক ইলিশ উঠতে পারে জালে! এবার ঈদে নতুন একজোড়া চামড়ার স্যান্ডেল কিনতে হবে তার। একটা বাটা স্যান্ডেল। শহরের কাঁচ লাগানো দোকানগুলোর ভেতরে কত সুন্দর সুন্দর স্যান্ডেল দেখা যায়! ভেতরে ঢুকতে তার যেন সাহসে কুলায় না। অনেক আশা নিয়ে কাজীবাছা নদীর বুকে তাকিয়ে থাকে আবদুল। পানিতে থাকা ভাসমান বাঁশের চোঙ হাবুডুবু খায়। যেন ওখানেই হাবুডুবু খেতে থাকে আবদুলের দিবাস্বপ্ন।
বাপ-বেটার জাল টানা শুরু হয়। যেভাবে ছন্দ মেনে পানিতে জাল ফেলেছিল, সেভাবেই আবার নৌকায় ওঠে জাল। থরে থরে সাজিয়ে রাখে চাড়া ও বাঁশের চোঙ। মাছের দেখা মেলে না। একটি তপিস্যা মাছ আটকা পড়েছে ওর কপাল দোষে। ওটা ছাড়িয়ে নৌকার খোলে রাখে জামাল। ধীরে ধীরে জামালের মুখটা যেন আষাঢ়ের হঠাৎ ধেয়ে আসা কালো মেঘের মতো হয়ে আসে। একটু আগের ভাবনার বিষয়ে কিছুই মনে নেই আবদুলের। নৌকায় জাল উঠলে দ্রুত ঘরে ফেরা যাবে। অমন জাউভাত বেশিক্ষণ পেটে থাকে না আবদুলের। দুই থালা ভাত ছাড়া দুপুরের খাবারের কথা ভাবতে পারে না সে।
কয়েকটি চোঙ উঠাতে বাকি। না। কোনো ইলিশ ওঠেনি জালে। এমনই সময় হাতের জালে একটি টান অনুভব করে জামাল। হ্যাঁ, ঠিক। একটা বড় আকারের রূপালি ইলিশ জালের সাথে উঠে আসে নৌকায়। খুশিতে চিৎকার দিয়ে ওঠে আবদুল।
-বাজান, কত্ত বড় ইলিশ! মনে হয় দ্যাড় কেজি অবেনে।
-হ, দ্যাড় কেজির মতো অবেনে।
-বাজান, মাছটা কিন্তুক বেচা যাবে না। খাতি অবে। মেলা দিন ইলিশ মাছ খাইনে। মাগোরে কবানে কয়কান মাছ নুন দিয়ে থুতি। শুক্কুর বারে তো বুগো আসপেনে!
ইলিশের নাচন দেখে চোখেমুখে হাসির রেখা ফুটে উঠেছিল বাপ ও ছেলের। মুহূর্তেই আবার মিলিয়ে যায় জামালের উজ্জ্বল মুখ। ছটফট করতে থাকা ইলিশ মাছটিকে দ্রুত চাপা দেয় অবশিষ্ট জাল দিয়ে। হাত চালিয়ে নৌকা বেয়ে এসে পৌঁছে যায় কাতিয়ানাংলার ঘাটে। ঘাটে নৌকা ভিড়তেই শওকত মেম্বার হাঁক ছাড়ে,
-কিরে জামাল, মাছটা কততে বেচপি?
কাতিয়ানাংলা খেয়াঘাট কখনো জনশূন্য হয় না। বেশ কিছু ছাপড়া চায়ের দোকান এখানে। পিঁপড়ার সারির মতো লোকে এখানে আসে আর যায়। কাজ না থাকা লোকেরা হা হয়ে বসে থাকে রঙিন টিভির দিকে। ওরা খুব বাংলা সিনেমা দেখে। ওদের চোখে তখন রাজ্যের সুখ খেলা করে। ঘাটে বাইক থামিয়ে মেয়ে জামাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল শওকত আলম। তখন তার চোখ গিয়ে পড়ে জামালের নৌকায়।
শওকত মেম্বারের মাছ কেনার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে পারে না জামাল। মাছের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে সে,
-ব্যাচপো মেম্বার সাপ। ব্যাচার লাইগেই তো ঘাটে আইছি।
-ক, কত দাম নিবি।
- একদাম,পাঁচশো টাহা কেজি দেবেন। ওজনে যা হয়।
একটু কমে নিতে চাইল শওকত মেম্বর। রাজি হয়নি জামাল। মাছের দিকে তখনো চেয়ে আছে আবদুল। মাছটি ওজন করে কানসার ভিতরে টোন সুতা দিয়ে বেঁধে বাইকে ঝুলিয়ে রাখে শওকত। মানিব্যাগ খুলে সাতশত টাকা দেয় জামালের হাতে। বৈঠা হাতে নিয়ে বটতলার দিকে এগিয়ে যায় জামাল। পেছন পেছন ছয় ইঞ্চি তপিস্যা মাছটি হাতে ঝুলিয়ে হাঁটতে থাকে আবদুল।
বটতলায় ছোয়েদের দোকানে এসে থামে জামাল। ভীতু চোখ নিয়ে দোকানের সামনে দাঁড়ায় জামাল। বুঝতে পারে সোয়েদ আলী। বাকির খাতায় হাত দেয় না সে। ওখানে প্রায় হাজার টাকা বাকি পড়ে আছে জামালের নামে। ১০ কেজি চাল, কিছু ডাল, তেল ও লবণ নিয়ে নেয় সে। সাতশত টাকা দিয়ে ফেরত পায় মাত্র বিশ টাকা। ওটাই এখন অনেক! ব্যাগ মাথায় নিয়ে বাড়ির দিকে হেঁটে যায় আবদুল। ২০ টাকা মাজায় গুঁজে জামাল ঢুকে পড়ে রণজিতের চায়ের দোকানে।
মিনিট দুয়েক হাঁটলেই ওয়াপদা পাশের বাড়িটা দেখা যায়। মাটির দেয়ালে বাড়িটাই জামালের। যাওয়ার পথে কয়েকবার মনে হলো ইলিশ মাছটির কথা। খুব অভিমান হলো বাবার ওপর। আজ মাছটি না বেচলেই হতো! এমন বড় সাইজের মাছ কালেভদ্রে জালে ধরা পড়ে কাজীবাছার বুকে। বাবারও কি এমন মাছ খেতে ইচ্ছে হয় না! বাড়ি পৌঁছে যায় আবদুল। হাতের তপিস্যা মাছটি ফেলে রাখে মাটির বারান্দায়। মাথার চাউল ও সদয়পাতি নামিয়ে রাখে কাঠের টুলের ওপর।
কন্ডেন্সমিল্কের মুখ কেটে তৈরি করা একটি পাত্র। পাত্রটি দিয়ে মেপেমেপে কয়েক কৌটা চাউল নিয়ে যায় আবদুলের মা। চাউলগুলো ধুয়ে ভাত রান্নায় বসিয়ে দেয়। বারান্দার একটি খুঁটিতে হেলান দিয়ে তখনো জিরোতে থাকে আবদুল। একটু পর ঘরের চাউল রাখা নীল ড্রামটা নিয়ে আসে আবদুলের মা। চাউলের প্যাকেটটি উঁচু করে ঢেলে দেয় নীল ড্রামে। ঝপাৎ করে শব্দ হয়। শূন্য ড্রামে চাউল রাখার শব্দ। শূন্যতার শব্দ। ড্রামে একটি চাউলও ছিল না! মুহূর্তেই বুকের মাঝ থেকে জমানো অভিমানটি সরে যায় আবদুলের। বাবার মাছ বিক্রির সিদ্ধান্ত পুরোটাই ঠিক। কোনো ভুল নেই। ইলিশ মাছটি বিক্রি না করলে আজ হয়তো ভাত জুটত না। ভাত ছাড়া পেটের ক্ষুধা নিবারণ হয় না আবদুলের। ঘর থেকে খেপলা জাল বের করে আবদুল। পুকুরে কয়েক খেপ দিলেই বেশ কিছু হরিণা চিংড়ি পাওয়া যাবে। লোনা পানির চিংড়ি মাছের স্বাদ! ওর কাছে মনে হয়, ওটা একেবারেই কম নয়। হ


আরো সংবাদ



premium cement