২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শিল্পীর শিল্প, কবির কাব্য ও সাহিত্যিকের জীবন চিত্র

-

সমাজ-মনস্তত্ব, বিজ্ঞানমনস্কতা, সচেতনতা, রাজনৈতিক-চেতনা, মানবতাবাদ এবং গভীর অন্তরবোধ ইত্যাদির অভাব থাকলে যেমন প্রকৃত লেখক বা শিল্পী হওয়া যায় না, যায় না দায়িত্বপূর্ণ সংস্কৃতিকর্মীর দায়িত্ব পালন করা। সমাজের প্রতি লেখক শিল্পীর দায় রয়েছে। আর সে দায় সৃষ্টিতে অতিন্দ্রীয়তাবাদ, ভোগবাদ, পরাবাদ, ভাববাদ দ্বারা পরিশোধিত হয় না। বরং তাদের লড়াকু মনোবৃত্তিকে সঙ্কুুচিত করে পোষা জন্তুতে পরিণত করে এবং ধীরে ধীরে আজ্ঞাবহ অনুগত ভৃত্যের জীবনটি পোক্ত করে। তেমনি সাধারণ এবং পাঠকদেরও ধীরে ধীরে এ সবের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে সঙ্গীত, নাটক, কাব্য-শিল্প-সাহিত্যের আনন্দ আস্বাদনে অগ্রগামী হওয়া দরকার। শিল্পীকে কবিকে সাহিত্যিককে যেমন জানতে হয় চিনতে হয় তার সমাজ, মানুষ, মানুষের মন এবং সামাজিক রীতিনীতি মনস্তত্ব, পাঠকের অগ্রগামীতায়, তেমনি পাঠককেও এগিয়ে আসতে হয় সমষ্টির মুক্তির একীভবনের শর্তগুলোর প্রতি নেকনজর নিয়ে। চলমান সমাজকে ঘৃণা বা হীনম্মন্যতায় দেখে কখনো বড় শিল্পী বা বড় কবি হওয়া যায় না। শিল্পী-কবিকে অবশ্যই মনে রাখতে হয়, সে এই সমাজের একজন মানুষ এবং তার কর্মে সমাজই পক্ষান্তরে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। কারণ তার সৃষ্টির প্রকৃত ভোক্তা তার সমাজ-মানুষ। সমাজ মানুষের চাহিদা না থাকলে অচিরেই তার সৃষ্টিতে স্থবিরতা এসে যাবে। উৎসাহহীনতায় ফুরিয়ে যাবে আবেগ। প্রকৃত সমাজমনস্কতার দৃষ্টিভঙ্গিহীন লেখক শিল্পীর নন্দন, সমাজ মানুষের কাজে লাগে না, তাকে অনুপ্রাণিতও করে না। তার বেদনা বোধকে শক্তিতে রূপান্তরিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করে না। ভাসা ভাসা বোধ দ্বারা ধোঁয়াশার যে সৃষ্টি, তা বাস্তবে মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং সেই শ্রেণীকে পোষকতা দেয় যাদের দ্বারা নিত্য জনগণ নিগৃহীত হচ্ছে। যদিও পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থা মানুষকে মানুষ থেকে সমাজ সম্পর্ক থেকে ও সমাজে মানুষের সম-বিচরণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে সেই বোধেরই জন্ম দিতে চায় যা তাকে সমাজে অপরিচিতই করে তুলবে।
০২.
শিল্পীর শিল্প, কবির কাব্য, সাহিত্যিকের জীবনচিত্র যদি এই ভাষাকে আয়ত্ত না করে এবং উন্নাসিকতায় আচ্ছন্ন হয় তা হলে তার সৃষ্টি যতই নান্দনিকতার দাবিদার হোক, তা মূলত কেবল অনাসৃষ্টির অন্তর বিস্তার এবং পক্ষান্তরে সেই শক্তিকেই উসকে দেয় যে তাকে ক্রমে অন্ধ করে মোহাবিষ্ট করে, দৃকপাতহীন করে নব্য ক্রীতদাসে রূপান্তরিত করেছে। কোনো রাষ্ট্রনায়ক যখন নিজেকে অভ্রান্ত মনে করেন ও জনগণকে অন্ধের মতো অনুসরণ করতে নিয়মকানুন রীতি রিস্তাকে তার মতো করে সাজাতে চান, তার দৃষ্টিভঙ্গিকে উন্নয়ন বলে চালিয়ে রাখতে জনগণের সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার করেন, তারই ওপর দায়দেনা চাপিয়ে দেন, তখন সমাজের সামগ্রিকতায় তার প্রভাব পড়ে এবং ধীরে ধীরে সমাজ মানুষের একাগ্রতায় ব্যক্তিস্বার্থ প্রবল হয়ে লুট, হরিলুট, কুক্ষিগত করার প্রবণতা তীব্র হয়ে উঠলে সংস্কৃতিতে বিভ্রাট দেখা দেয়। মূল্যবোধগুলো হারিয়ে যায় সমাজ জীবনচারণ থেকে। ধর্মবেত্তারাও নানা বেশাতি নিয়ে সংস্কৃতির অঙ্গনে প্রবেশ করেন এবং ধর্মের মর্মবাণীকে হেয় খেল বিকৃত করে নিজ স্বার্থপূরণের হাতিয়ার করে কারণ বা অকারণ যুক্ত করে ধর্মগুরু সেজে কোটিপতি বনে যান। ফলে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার প্রয়োজনীয়তা ক্ষীয়মান হতে থাকে, সংস্কৃতি তীব্র আগ্রাসনের মুখে পড়ে, জাতিকে ক্রমে অমঙ্গলের সড়কে উপনীত করে। শিল্পীকে তাই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ সচেতন হয়েই তার চর্চায় ও সৃষ্টিতে মগ্নতা দেয়া দরকার। মনে রাখতে হয় শিল্পী কবি সাহিত্যিকের হাতিয়ারটি কেবল তার সৃষ্টি। নিছক আনন্দ জীবন জড়াকে প্রশমিত করতে পারে না। বরং সমাজ নিরীক্ষণের মধ্য দিয়েই উপলব্ধি করতে হয় সত্যের স্বরূপ। এই সত্যটা সর্বাগ্রে উপলব্ধিতে নেয়ার আয়োজনটি করতে হয় নিজেরই সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে, কারণ তিনি বহিরাগত নন।
০৩.
আমাদের সমাজে ভাঙন তীব্র হয়ে উঠেছে। চারিদিকে তার আলামত নানাভাবে বিস্তার নিচ্ছে। ধর্ম তার শাশ্বত কর্মধারাকে পরিহার করে পরকাল ভোগ আর পরাজীবন নিয়ে মেতে উঠেছে। তথাকথিত জ্ঞানীরা টকশো করছেন, কী বলছেন কী বলছেন না তার সমন্বয় করলে মূলহীনতার দিকেই নিক্তি ঝুঁঁকে যাবে। কবি-সাহিত্যিক, শিল্পীরা যা আঁকছেন, লিখছেন, বয়ান বিবৃত করছেন, তাতে তাদের লোভ চোখতারায় যে চক চক করছে, লেখার দিকে তাকালে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর মূল কারণ সমাজ বিচ্ছিন্নতা, এই বিচ্ছিন্নতা রাষ্ট্রব্যবস্থারই সৃষ্টি আর লড়াইটা সেখানেই। তাই মানুষের সংগ্রামকে যেমন সূত্রবদ্ধ করতে হবে সৃষ্টির মাধ্যমে এবং মনোজগতে স্পষ্ট আলোর ঝলক ফেলতে হবে তার লেখায়-আঁকায়, সুরে-কণ্ঠে, অভিনয়ে। লোকাচারের বিষয়কে সংশ্লেষিত করে নতুন জীবনের উপযুক্ত উপাত্ত করে তাদের জীবন সংগ্রামের সম্পৃক্ত করতে হবে সৃষ্টির মাধ্যমে। তাই আজ সর্বগ্রাসী ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে পড়ে মানুষ তার শিক্ষা, সুন্দরের উপলব্ধি, জীবনের নবতর আয়োজন বোধ ইত্যাদি থেকে দূরবর্তী হয়ে পড়ছে। লেখক শিল্পীরাও বুঝি আজ তার নির্মম শিকার। পরিহাসের বিষয়, তারাও মোহাবিষ্ট আধোঘুম আর জাগরণে সৃষ্টি করে চলেছেন সেই কাব্য সেই শিল্প সেই জীবনরীতিচিত্র, যা পুরনো, সামন্তীয়, অনাধুনিক, অনগ্রসর, যা সময়ের সাথে যুঝে নতুন উপলব্ধিতে আজ সৃজনে অপারঙ্গম।
০৪.
নিউ ক্লিয়ার অটোমেশনের যুগে মানুষের প্রত্যাশায় পরিবর্তন এসেছে। স্বভাবে রুচিতে বদল ঘটে গেছে, পদার্থবিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার, টেকনোলজির অভূতপূর্ব বিকাশ শিল্পী-সাহিত্যিকদের শক্তপোক্ত আসন থেকে সরিয়ে বিজ্ঞানীকে লোকমানসে নতুন আসন দিতে হচ্ছে। পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে সম্পর্কের, রীতিনীতির, বিশ^াস ও অভ্যাসের। গণ-আচরণে এসবের নতুন এক রূপ ফুটে উঠছে যার প্রতিফলন সামাজিক জীবনেও। ফলে আনন্দ উপভোগের মাত্রায় এসেছে ভিন্নতা, অনেক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও বিলুপ্ত হয়ে মানুষ বর্তমান সময়ের মাধ্যমগুলোকে শ্রেয়তর করে নিচ্ছে। বাস্তবে উপযুক্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, পরিকল্পনা ও পরিপক্ব নেতৃত্ব ছাড়া সমাজ মানুষের পক্ষে অগ্রগমন সম্ভব হয় না। নানা প্রতিকূলতা তার ওপর চাকচিক্যময় পুঁজিবাদী প্রতারণার কৌশলগুলো তাদের আটকে রাখে পথিমধ্যে এবং জাদুপরীর মোহজালে জড়িয়ে আপন অস্তিত্ব চিন্তায় বিভ্রান্তিতে ফেলে নকলে মোহাবিষ্ট করে এবং তারা অচেতনে ভেসে থাকে; যাকে বলে মোহ-তন্দ্রা। লেখক শিল্পীরা সেই রাজনীতিবিদকে মূল সংস্কৃতির স্রোতধারাটি চিনিয়ে তৈরি করেন ঘুমিয়ে পড়া জনগণের জাগৃতির জন্য। সচেতন করেন এবং সমাজের বাস্তব চিত্রটির সাথে জনগণকে পরিচিত করান চরিত্র চিত্রন বা শিল্পশরীর নির্মাণের মধ্য দিয়ে। আধুনিকতা সামগ্রিক, রাষ্ট্র থেকে জীবনযাপন, বিজ্ঞান, দর্শন ও নির্মাণের, তাকে বিশুদ্ধির দিকে নিতে পারে সচেতন রাজনৈতিক কর্মপন্থা। সংস্কৃতি বিশুদ্ধির মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে যৌক্তিক ন্যায়বোধ এবং ধীরে ধীরে শোধিত হয় নৈতিকতা। তখনই কেবল উন্নয়ন টেকসই এবং জনকল্যাণমুখী হয়ে উঠতে পারে। ব্যক্তি কখনো তার সময়কে এককভাবে বদলাতে পারে না। ব্যক্তিকে ব্যাস্টিতে রূপান্তরিত করার পথ দেখায় মানুষের সামগ্রিক চেতনা; যা লেখক শিল্পীরা তাদের সৃষ্টির মাধ্যমে সৃষ্টি করেন। আর তখনই তা হয়ে ওঠে সামগ্রিক শক্তি।
বিখ্যাত হওয়া এবং ভালো লেখা দু’টি ভিন্ন জিনিস। যে লেখা ভূমিলগ্ন মানুষের সুদীর্ঘ সময়ের মূল্যবোধের সাথে জড়িত, [সে প্রতীকীও হতে পারে] এবং ক্ষয়ষ্ণু মনোবৃত্তিকে পরিহারে নতুনের যাত্রায় আগাম ইঙ্গিতবাহী সেই লেখা টিকবার শক্তি রাখে, কিন্তু চলমান ডামাডোল, রথযাত্রায় যা হইহুল্লোড়ে মত্ত যা চেতনার অগ্রবর্তী নয়, তা ট্রাস। সত্য এই যে, কিছুসংখ্যক লোক কিছুদিন অনেক মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারলেও, জনমানুষের শেষ সর্বনাশ করতে পারে না।
কখনো কোনো একসময় আদর্শবাদীরাও অতি আদর্শবাদিতায় রূপান্তরিত হলে তার ভেতর আর আদর্শ থাকে না। সব কিছু অস্বীকারের মধ্য দিয়ে প্রবল হয়ে ফোটে বিবেচনাহীনতা। ভালোগুলোও আক্রমণের লক্ষবস্তু হয় এবং বিশৃঙ্খল মনোবৈকল্যের জন্ম দেয়, সত্য হয়ে ওঠে সঙ্কীর্ণতা। এই সঙ্কীর্ণতা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে এবং দেবত্ব পেয়ে যায়। [যদিও এর পেছনে একদল চাটাবাজ সক্রিয় থাকে, আর জনগণ অসচেতনতার কারণে এর সাথে সাময়িক হলেও যুক্ত হয়ে পড়ে] কিন্তু একটা সময় আসে সে হলো ইতিহাসের রায়, সেই রায়ে ওই সব সঙ্কীর্ণ ভাব-ভাবনা যা আদর্শ বলে মাথা তুলেছিল তা আগাছা হয়ে পড়ে এবং সামান্যতেই ভূমিতে গড়ায়। বিপ্লবীরাও এই সঙ্কীর্ণতার শিকার হয়, যারা মানুষকে মুক্ত করবে বলে যে প্রতিশ্রুতিতে একদিন কাঁপিয়ে ছিল, তা হয়ে যায় স্মৃতি। তখন দেখা যায় সোভিয়েত হয়ে যায় কেবল রাশিয়া, স্টালিনের মাথা নেই, দড়ি দিয়ে টানছে, হোনেকা সরে গেছে, চশেস্কু গুলিতে ঝাঝরা, পলপটরা পলাতক বা কারান্তরালে, চীন ধনবাদী চর্চায় যুদ্ধবাজ মাওসেতুং বাস্তবে মৃত আর তাদের অনুপস্থিতির কালে সব নির্মাণ বরফচূর্ণির মতো ঝরে যাচ্ছে গেছে, কেউ রক্ষায় এগিয়ে আসে না। অথচ ওই মানুষগুলোই একদিন জীবন বাজি রেখেছিল। লেখকরাও আজ তার শিকার, নিগৃহীত আত্মবিক্রিত, আত্মবন্দী। খুনও হয়। তবু আধুনিকতা নিয়ে যে চলমান কথাবার্তা রয়েছে তা উচ্চ শ্রেণীর স্বার্থের। তারা বলছে আধুনিকতা শেষ হয়ে গেছে, যদিও এখনো পশ্চাদপদতাই সমাজজীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে রেখেছে। এখনো আমাদের সমাজ আধুনিকতার উজ্জ্বল বিন্দুতে তার যাত্রা শেষ করতে পারেনি, তার মধ্যেই নানা মতবাদ, তর্ক ইত্যাদি শূন্য দোলার মধ্যে বাবুই পাখির ঝুলন্ত বাসা করে ফেলতে চাইছে। আধুনিকতার উৎকর্ষতায় যে অবকাঠামো লাগে এবং সেই টেকসই অবকাঠামো গড়তে যে শক্তিশালী সংস্কৃতির বাঁধন লাগে সেই কথাটা এ তার্কিকরা ভুলে বসে আছে। মানুষের প্রকৃত মুক্তি রয়েছে সবার সাথে যোগযুক্ত হওয়ার মধ্যে। মানুষকে বিভ্রান্ত করার অধিকার কোনো লেখক কবির নেই, সে অতিন্দ্রীয় বাদই হোক আর পরাজীবনবাদই হোক, বরং তার বাস্তবতা তুলে এনে তাকে এই দাসত্ব চিনিয়ে দেয়ার দায়িত্ব লেখক শিল্পীর সামগ্রিক মানুষদের সাথে মিশে তাদের অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে। আসলে শিল্প মানবকল্যাণ দর্শনের প্রতিফলন, চৈতন্য বাস্তবের স্র্রষ্টাও। সে টুকুকে যথাযথ মূল্যায়ন দিয়ে নতুনের দিকে ফিরবার পথ আলোকিত করতে হবে সংস্কৃতিকর্মী, লেখক, শিল্পী, কবি, আঁকিয়ে, বাজিয়ে ও গাইয়েদের। আর উৎপীড়িত শ্রেণী একবার জাগরণ ডাক পেলে সিংহ, নয়তো মুসিক, এক নির্জীব ঘুম-ঘোরের যাত্রী।


আরো সংবাদ



premium cement