২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কবিতার যাত্রাপথে কবির প্রস্তুতি

-

কবিতার প্রাণ আছে। কবিতা প্রাণস্পর্শী। হৃদয়ঙ্গম শিল্প। অনুধাবন সঞ্জাত বোধন-প্রজ্ঞাত শিল্প। কবিতা একটি আদর্শ শিল্প। মানুষ কবিতা লেখে। মানুষ কবিতা পাঠ করে। কবি লেখে, পাঠক পাঠ করে। কবি যা বলে পাঠক তা অনুধাবন করে। কবি কল্পনায় কাব্যদরিয়ায় ঢেউ তোলে পাঠক তাতে সাঁতার কাটে। কবির সৃষ্টনদী যদি ছান্দিক ঢেউ তুলতে না পারে সাঁতারু সেখানে ডুবে মরে। পাঠকের মৃত্যু হয়। কবিতা তখন ব্যর্থ হয়। কবিতার রস আস্বাদনে পাঠক কবিতাবিমুখ হয়। সেই কারণে কবিতানির্মাতাকে খুবই সাবধানী হতে হয়। ইমারত নির্মাতার মতো কবিকে নকশাবিদ হতে হয়। কল্পনাশক্তির মহাকাশে কবি বিচরণ করে। কল্পিত পৃথিবীর চিত্র কবির মানসপটে ছায়াবিস্তার করে কবিতায় প্রতিস্থাপিত হয়। এ সময় কবি শক্তির মাহাত্ম্য দিয়ে পাঠকের হৃদয়ে সেই চিত্রকল্পকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে কবি সার্থক, কবিতা সার্থক। একটি সার্থক কবিতার জন্ম হয়। কবিতায় প্রাণ দিতে পারলেই পাঠকমনে সেই প্রাণের সঞ্চার হয়। পাঠক আন্দোলিত হয়। মনের মজলিশে আনন্দের জলসা বসে। তখন কবি পাঠকের প্রিয়কবি হয়ে ওঠে।
কবি কবিতা লিখবে এটা কোনো সিলেবাসে পড়ানো হয় না। পৃথিবীতে কবিতার কোনো শিক্ষক নেই। কোনো শিক্ষক ছাত্রকে বলতে পারে না ‘তুমি কবি হও’। কবির নিজস্ব ভালো লাগা থেকেই কবিতায় মনোযোগী হয়। কবিতাকে ভালোবাসে। কবিতাকে নিবিড় মনে আলিঙ্গন করেন। কবিতার নিবিষ্ট পাঠক ধীরে ধীরে কবিতার বর্ণমালা আয়ত্ত করেন। এক সময় নিজের ভেতরে একটা কাব্যিক প্রেরণা অনুভব করেন। ডায়েরির পাতায় লিখতে থাকেন কাঁচা চিন্তার কচিপাতার মতোন নরম শব্দের কথকতা। ভাবতে থাকেন কবিতা সংরাগের রঙিন দুনিয়া। ভাবেন কবিতা। সব ভাবনা ডায়েরির পাতায় লেখা যায় না। শব্দের অভাব অনুভব করেন। ভাবের অভাব বুঝতে পারেন। বিষয়-আশয় নিয়ে খেলা করেন। আত্মমগ্নতায় কবি বিমগ্ন হন। মাঝে মধ্যে দিশেহারা হয়ে পড়েন। মনের ভেতরে মোচড়ানো শুরু হয়। অস্থির হয়ে ওঠে মনের নদী। কবিতা কবিকে আন্দোলিত করে। কবি কবিতায় মুখর হয়ে ওঠেন। ডায়েরিবদ্ধ ভাব নিয়ে কবি আসেন পাঠক মহলে। প্রচারপত্রে কবিতা নিয়ে হাজির হন কবি।
নিজের চেষ্টায় একজন কবি নিজের মনের পরিমণ্ডলে নিজেকে কবি ভাবতে শুরু করেন। ব্যক্তিভাবনাকে কবি শতজনের ভাবনায় পরিণত করেন। কবির প্রাথমিক জীবনে উৎকৃষ্ট কবিতা নাও লিখতে পারেন। উৎকৃষ্ট কবিতার জন্য কবিকে অনুসন্ধিৎসা মন নিয়ে এগিয়ে আসতে হয়। একজন নবীন কবির প্রাথমিক শিক্ষক অগ্রজ কবিদের রচিত গ্রন্থ। সেই গ্রন্থ পাঠে কবিকে মনোযোগী হতে হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক দিনে তৈরি হননি। বিদ্যালয়বিমুখ রবীন্দ্রনাথ লাইব্রেরিতে মনোযোগী হয়ে নিজেকে আবিষ্কার করেন। মহাকবি কালিদাস রায়ের ‘মেঘদূত’ রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যিক শিক্ষক। ‘মেঘদূত’ পড়েই তিনি কবিতার প্রেমে পড়েন। বুঝতে পারেন এ রকম তিনিও লিখতে পারেন। লিখে ফেলেন ভানুসিংহের পদাবলি। গ্রন্থ পাঠেই রবীন্দ্রনাথ নিজেকে তৈরি করেন। পাশ্চাত্যের সাহিত্যে প্রবেশ করে রবীন্দ্রনাথ গল্পকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক। লালনশাহ অধ্যয়নের কারণে রবীন্দ্রনাথ অমর গানের জনক। সাহিত্যাধ্যয়ন ছাড়া পৃথিবীতে অমর সাহিত্য রচিত হয়েছে এ রকম ঘটনা খুবই বিরল। তাই পড়তে হবে। বই পড়ার বিকল্প নেই। যতই পড়বে ততই ভাবনার সৃষ্টি হবে। তাতেই একজন নবীন লেখক প্রজ্ঞার লাবণ্যে পরিমার্জিত লেখক হতে পারেন।
কবির প্রাথমিক জীবনে কবিতার মৌলিক কিছু বিষয় জানতে হবে। কবিতা অপরিহার্য শব্দের মেলবন্ধন। উৎকৃষ্ট শব্দের জন্য কবিকে নিজের জ্ঞান-সীমায় অজস্র শব্দের ভাণ্ডার তৈরি করা লাগবে। খোলাদৃষ্টি দিয়ে শব্দ খুঁজে জ্ঞানের পকেট ভারি করতে হবে। কোনো কবি পরিপুষ্ট শব্দের পূর্ণাঙ্গ মালিক হলে ইচ্ছামাফিক, নিজের মর্জিমত কবিতায় শব্দ ব্যবহার করতে পারেন। শব্দ ব্যবহার করলেই কবিতা পূর্ণাঙ্গ হবে কি না প্রশ্ন থেকে যায়। শব্দকে পরিমিত ব্যবহার করা জানতে হবে। তার জন্য দরকার ছন্দ। বহুবিধ ছন্দের ভেতর থেকে নবীন কবি হিসেবে ছন্দজ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়া অতীব জরুরি। ছন্দের ব্যবহার না জানলে শব্দের সুষম-ব্যবহার কঠিন হবে। বাক্য নির্মাণ করলেই কবিতা হয় না। বাক্যের ভেতরে অনেক মশলা দিয়ে বাক্যকে সুস্বাদু করতে হবে। তার জন্য চাই অলঙ্কারের ব্যবহার। শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কারের মর্যাদা অক্ষুণœ রেখে কবিতাকে বাক্সময় করে তুলতে হবে। উপমা-প্রতিউপমা, উৎপ্রেক্ষার ব্যবহারবিধি জানাও অপরিহার্য। চিত্রকল্প কবিতার একটি প্রধানতম অঙ্গ। চিত্রকল্পের মাধ্যমে কবি পাঠককে নিয়ে কল্পনার জগতে ভেসে বেড়াতে হবে। কবির কল্পনাশক্তি এখানে বিশাল বড় একটি বিষয়। কবির কল্পনাশক্তিকে প্রখর করাও জরুরি। সহজ কোনো বিষয়কে ভাবগাম্ভীর্যে মেঘের মতো ভারী করে কবিতার বৃষ্টিতে অবগাহন করতে হবে। এ সব কিছু একটা শিক্ষা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। তার জন্য ব্যাপক অনুশীলন করাই এর শেষ কথা। অনুশীলন-অধ্যয়ন-অনুশীলন তারপর প্রক্ষেপণ। যে কবি নিজেকে সবচেয়ে বেশি তৈরি করতে পেরেছেন তার কবিতাই অমর হয়েছে।
কবিতার প্রস্তুতি নিয়ে কেউ কাব্যজগতে আসে না। বরং কাব্যদুনিয়ায় পা দিলে কবি ভাবরসে নিমজ্জিত হন। আত্মজিজ্ঞাসার দুয়ার খুলে যায়। সমাজ-বাস্তবতা, প্রকৃতির নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও আত্মোপলব্ধি কবিতায় প্রবিষ্ট হলে যুগ-সচেতন কবি হিসেবে বিকশিত হবেন। তা তা মর্মে মর্মে অর্জন করা যায়। পেটে ক্ষুধা লাগলে প্রাণিকুল যেমন খাদ্য খোঁজে তেমনি কবিও শব্দ-ভাব-বিষয়বুভুক্ষু। চিন্তার সচেতনতায় কবি উপলব্ধি করতে পারেন কবিতার বিষয়। কবি সমাজের একজন সাধারণ মানুষ নন। তিনি অসাধারণ। তার চিন্তাও অসাধারণ। সাধারণ ভাবনাকে অসাধারণ করে তৈরি করাই কবির শ্রেষ্ঠত্ব। বিষয়কে প্রাধান্য না দিয়ে ভাবকে প্রাধান্য দিলে কবিতার অর্থবিচারের চেয়ে ভাববিচার মুখ্য হয়ে দেখা দেবে। সাধারণের কাছে এখন একটা কথা খুব প্রচলিত হয়ে আছে। কবিতা বোঝেন না। কবিতা আসলে বোঝার বিষয় নয়। অনুধাবনের বিষয়। বোধিসত্তা জাগ্রত থাকলে অনুভবে কেবল ভালো লাগার বিষয়টি কবিতায় খুঁজতে হবে। কবিতা কখনো ধর্ম প্রচারের হাতিয়ার নয়। আদর্শের মানদণ্ডে কবিতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করা সমীচীন নয়। কবিতা আনন্দের অনুষঙ্গমাত্র। এই আনন্দের ভেতর দিয়ে কবি পাঠককে কবির অন্তরাত্মার গভীর আনন্দ-বেদনা, স্বপ্ন-বাস্তবতার নিগূঢ় সত্যকে উপলব্ধির আকরে পৌঁছে দেবেন। একটা মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে হৃদয়ের কথা হৃদয়ে পৌঁছে দেবেন। তাই কবিতা একটি সংযোগশিল্প।
কবিতা লেখলেই কবিতা হয় না। কবিতা এক অন্যরকম শিল্প। শিল্পের সবচেয়ে কঠিনতম মাধ্যম। গীতশিল্প, চিত্রশিল্প, তালশিল্প, বাকশিল্প, অঙ্কনশিল্প, চিন্তাশিল্প এককথায় সবশিল্পের যোগফল কবিতা। সবশিল্পকে কবি একত্রিত করে শব্দ-সেলাইয়ের মাধ্যমে কবিতা গাঁথেন। তাই এ শিল্পকে কখনো খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বরং এর গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে ভাবতে হবে। কবিতা নদীর স্রোতের মতো গতিপ্রবণ। নদীর গতির সমাপ্তি আছে। কবিতার শেষ নেই। বরং কবিতা কেবল বাঁক পরিবর্তন করে। নদী চলতে চলতে তার পথপরিক্রমা সরু থেকে সরু হয় কবিতা সম্প্রসারিত হয়। নদীর পথ হ্রস্য হয় কবিতার দীর্ঘ হয়। নদী মরে যায় কবিতা মরে না। নদী ক্ষণকালের, কবিতা চিরকালের। তাই কবিতা-সাধককে সুদূরপ্রসারী চিন্তক হতে হয়। কবিতাকে অমর করার দায়িত্ব প্রথমে কবির নিজস্ব দায়িত্ব তারপর সামাজিক দায়িত্বে আসে। সর্বাঙ্গ সুন্দর কবিতা একদিন তার বর খুঁজে পাবে। কালে-মহাকালে এই কবিতা কথা বলবে। পাঠকনন্দনে ফুল ফুটাবে। সেই অমর কবিতার জন্য কবিগণ একজীবন ব্যয় করেন কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো কবির কণ্ঠে শোনা যায়নি তার শ্রেষ্ঠ কবিতা লিখে ফেলছেন। একটা অতৃপ্তি কবির থেকেই যায়। এ অতৃপ্তিবোধই কবিকে নিয়ে যায় নতুন সৃষ্টির প্রেরণায়। সৃষ্টিশীল মানুষ, সৌন্দর্যপিয়াসী শিল্পী, রূপ-সন্ধানী চোখ, গন্তব্যযাত্রী লেখক কোনো দিন সৃষ্টিতে তৃপ্ত নন। তার অমর সৃষ্টির তাড়নায় সব সময় ধ্যানস্থ থাকেন। তাই সৃষ্টির মহিমায় সমৃদ্ধ হয় সাহিত্যজগৎ। অমর সৃষ্টির জন্য কবিকে সব সময় তাড়না অনুভব করতে হবে। অতৃপ্ত থাকতে হবে। লিখে যেতে হবে আজীবন। থামলে চলবে না। গতিশীল কবির পক্ষেই সম্ভব কবিতায় অমরত্ব। প্রবহমান থাকতে হবে কবিতাচর্চায়। এভাবেই নবীন কবি কবিতার পাণ্ডিত্য অর্জন করবে।
একজন কবির জন্য আরেকজন কবি সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। নবীন কবিকে সব সময় অগ্রজদের কাছে যেতে হয়। অগ্রজ জানেন নবীনের জন্য কী প্রেসক্রিপসন দিতে হয়। নবীনের প্রচেষ্টার আলোকে অগ্রজ পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অকৃপণ অগ্রজ সব সময় চিন্তা করেন সাহিত্যের সমৃদ্ধি। নবীনতম কবিকে সহযোগিতা করে অগ্রজ সাহিত্যসেবাই করে থাকেন।
সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করা অগ্রজের দায়িত্ব। কেউ এই দায়িত্ব পালন করেন আবার কেউ করেন না। নবীনের লালিত্যই অগ্রজ নিজেকে প্রকাশ করেন। বয়স-জ্ঞান-প্রজ্ঞার বিচারে একজন আরেকজনের পরিপূরক। জানার আগ্রহ থাকা খুবই দরকারি একটা গুণ। জানতে হবে, বুঝতে হবে তার পর বলতে হবে। জানা-বোঝার জন্য প্রথমে বই পড়া জরুরি তারপর অগ্রজদের সহযোগিতা নেয়া অপরিহার্য। নিজে নিজে কখনো জ্ঞানবান হওয়া যায় না। প্রবীণ-প্রজ্ঞার দ্বারস্থ হতে হবে নবীনকে। কেবল নবীনকে কেন জ্ঞান অনুসন্ধিৎসু অনেক প্রবীণকেও দেখা যায় এ তরিকায় জ্ঞান অর্জন করতে। এটি মোটেও দোষের নয়। বরং নিজের সাহিত্যসত্তাকে জাগিয়ে তুলতে কাব্যিক সংস্পর্শ একান্ত জরুরি। এই চিন্তা থেকেই হয়তো এ কালের সাহিত্য আসরের জন্ম হয়েছে। সাহিত্য আলোচনা, পাঠ আলোচনা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হয়। কাব্যবোদ্ধা কোনো অগ্রজ উপস্থিত হয়ে কাব্য আলোচনা করেন। কবিতার বিষয়-আশয় নিয়ে আলোচনা করেন। কবিতার সমালোচনা করেন। এতে ব্যক্তিসমৃদ্ধির সাথে সাথে দেশীয় সাহিত্যের ব্যাপক প্রচার-প্রকাশ ঘটে। এক কবি আরেক কবির সাথে পরিচয় হন। বন্ধুত্ব হয়। ভাববিনিময় হয়। একে অন্যের কবিতা পাঠ করেন । নিজেদের মাঝে বোঝাপড়া হয়। একে অপরের সাথে জ্ঞানের আদান প্রদান হয়। পারস্পরিক পার্থক্য বোঝা যায়। একে অন্যের কবিতার তারতম্য করতে পারেন। একটা প্রতিযোগী মনোভাব তৈরি হয়। নিজেকে আবিষ্কার করা যায়। নিজের দুর্বলতা বোঝা যায়।
তাই কেবল ঘরে বসে নয়, বরং আড্ডামুখী হওয়াও বাঞ্ছনীয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement