২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কালের বিবর্তনে পুঁথিসাহিত্য

-

‘হারিকেনের টিমটিমে আলোর সাথে আসমানে উঁকি দিত আধফালি চাঁদ। বাঁশঝাড়ের পাতার ফাঁকে দিয়ে এক চিলতে আলোর ঝলকানি পুঁথিপাঠের আসরকে আরো মোহনীয় করে তুলত’।
সংস্কৃত শব্দ ‘পুস্তিকা’ থেকে পুঁথি শব্দটির উৎপত্তি। এর নাসিক্য উচ্চারণ পুঁথি। হাতে লেখা বইকে আগে ‘পুস্তিকা’ বলা হতো। যেহেতু আগের দিনে ছাপাখানা ছিল না, তাই তখন হাতে পুঁথি লেখা হতো। প্রাচীন বা মধ্যযুগের প্রায় সব সাহিত্য হাতে লিখতে হয়েছিল এবং এদের একাধিক সংস্করণও তৈরি হয়েছিল হাতে লিখে। তাই প্রাচীন ও মধ্যযুগের সব সাহিত্যকেই পুঁথিসাহিত্য বলা হয়।
পুঁথি সাহিত্য আরবি, উর্দু, ফারসি ও হিন্দি ভাষার মিশ্রণে রচিত এক বিশেষ শ্রেণীর বাংলা সাহিত্য। আঠারো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত এর ব্যাপ্তিকাল। এ সাহিত্যের রচয়িতা ও পাঠক উভয়ই ছিল মুসলমান সম্প্রদায়।
পুঁথি একসময় মুখে মুখে রচিত হতো। লোককাহিনীর মতোই পুঁথির জন্ম। পরবর্তীতে লিখে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা হয়। পুঁথি সাধারণত কোনো একটি কাহিনীকে কেন্দ্র করে রচিত। বাংলাদেশেও পুঁথিসাহিত্যের বেশ সুনাম রয়েছে। পুঁথিসাহিত্য পরবর্তীতে গ্রাম-বাংলায় পাঠ করত গ্রামের কিছু পাঠকরা। তারা সুর করে পাঠ করত পুঁথি। একটি পুঁথিপাঠ করে শেষ করতে লেগে যেত অনেক দিন। কখনো কখনো মাসও পার হয়ে যেত। বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি আর হাস্য রসাত্মক কথার মধ্য দিয়ে পুঁথিপাঠ করত। সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তি যিনি পুঁথিপাঠ জানতেন এবং এর কাহিনী সম্পর্কে অবগত তিনিই পাঠ করতেন। পুঁথিপাঠে পাঠকের সুর একটি মুখ্য বিষয় ছিল। পুঁথির সুরটি অন্যান্য সুর থেকে একটু আলাদা। পুঁথির কিছু অংশ পাঠ করে এর সারসংক্ষেপ পাঠক, উপস্থিত দর্শকদের বুঝিয়ে দিতেন কথার মাধ্যমে।
পুঁথি পাঠ সাধারণত রাতের বেলা অনুষ্ঠিত হতো। সবাই খাওয়া-দাওয়া শেষ করে অবসর সময়ে কোনো এক আঙিনায় জড়ো হতো। তার পর সেখানে উপস্থিত হতো পুঁথিপাঠক। অনেক পুঁথিসাহিত্য বাংলায় নামকরা ছিল। গুলেব কাওলি, বাহরাম বাদশা, লাইলি মজনু, ইউসুফ জোলেখাসহ বহু পুঁথিসাহিত্য ছিল; যা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। আগে থেকেই তারা ঠিক করে নিত কোনো পুঁথিটি পাঠ করবে। আগেই বলেছি একেকটি পুঁথি শেষ করতে মাসখানেক বা তার বেশি সময়ও লেগে যেত। বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা থেকে শুরু করে, মুরুব্বিরা এবং মহিলারাও পুঁথি শুনতে আসত। যে বাড়িতে পুঁথিপাঠ করা হতো শুধু সে বাড়ির নয়, এ শ্রোতা থাকত আশপাশের অনেক বাড়ির মানুষজন। সবাই নির্ধারিত সময়ে পুঁথিপাঠের আসরে চলে আসত। হারিকেনের টিমটিমে আলোয়, জলচৌকিতে পুঁথি রেখে পাঠক আসন করে বসত। চার দিকে সবাই নীরব। তার পর সুর করে পাঠ চলতে থাকত। কয়েক লাইন পড়ে পাঠক থামতেন এবং এর মর্মার্থ উপস্থিত পাঠকবৃন্দকে বুঝিয়ে দিতেন। পুঁথিপাঠের কথা শুনে কখনো হেসে কুটি কুটি হয়েছেন দর্শক, কখনোবা চোখের কোণে জমেছে অশ্রু। পুঁথিপাঠের মাঝখানে থাকত বিরতি। পাঠককে চা করে এনে দিত। সাথে উপস্থিত দর্শকরাও চা পান করত। সাথে একটু পান বা তামাকের ব্যবস্থা করা হতো। বিরতির পর আবারো শুরু হতো পুঁথিপাঠ। রস-রসাত্মক, হাসি-ব্যঞ্জনায় ভরে থাকত পুঁথি পাঠের পুরো সময়। রাত যত গভীর হতে থাকত পুঁথিপাঠ ততই জমে উঠত। ছোট শিশুরা ঘুমিয়ে পড়ত মায়ের কোলে। বসার তেমন ব্যবস্থা না থাকলেও চাটাই বিছানো থাকত, কখনো আরেকটু আরামপ্রিয় করার জন্য খড় বিছিয়ে নেয়া হতো। পাঠক নানান কথা দিয়ে বর্ণনা করে পুঁথিপাঠের পুরো সময়টিকে মাতিয়ে রাখতেন। গ্রাম-বাংলার প্রতিদিনের অঘোষিত একটি সময় থাকত এই পুঁথিপাঠের জন্য। সে সময়ে সবাই পুঁথিপাঠের আসরে চলে আসত। এটি প্রতিবেশীদের সাথে একটি সম্পর্কের সেতুবন্ধনও বলা যেতে পারে। এ বাড়ির ও বাড়ির মানুষের খোঁজখবর নেয়ারও একটা মাধ্যম ছিল পুঁথিপাঠের আসর। কে এলো, কে এলো না, কেন আসেনি, কেউ অসুস্থ কি না এমন খোঁজখবরের মাধ্যমে সামাজিক সম্প্রীতি আরো সুদৃঢ় হতো। এখানে কত অজানা কাহিনী উন্মোচিত হতো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা তখন এ পুঁথিপাঠ শুনতে আসত। পুরোপুরি মর্মার্থ না বুঝতে পারলেও আনন্দ পেত এবং এ সময়টা তারা অন্য কোনো কাজে অপব্যয় না করে বিনোদনের মধ্য দিয়ে কাটাত। পুঁথিপাঠ তখনকার দিনের একটি বিনোদনেরও মাধ্যম ছিল। বাড়িতে কোনো মেহমান এলে বা বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান থাকলে সে দিনের আসরটা আরো বেশি জমজমাট হতো। বিভিন্ন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে পুঁথিপাঠের অনুষ্ঠানে মজাদার খাবারেরও আয়োজন থাকত। হারিকেনের টিমটিমে আলোর সাথে আসমানে উঁকি দিত আধফালি চাঁদ। বাঁশঝাড়ের পাতার ফাঁকে দিয়ে এক চিলতে আলোর ঝলকানি পুঁথিপাঠের আসরকে আরো মোহনীয় করে তুলত। এমনি কত হাসি কান্নার ভেতর দিয়ে যে একটি পুঁথি শেষ হতো তা বলা কঠিন। এই পুঁথিপাঠের আসরে এসে একেকটি পরিবারের সাথে গড়ে উঠত দৃঢ় সম্পর্ক।
সময়ের বিবর্তনে আজ অনেক গ্রামীণ ঐতিহ্যই আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান প্রজন্মের অনেকে জানেই না পুঁথি কী জিনিস, তা কিভাবে পাঠ করা হতো। বর্তমান সময় প্রযুক্তির যুগ। প্রযুক্তির ভালো ও খারাপ দুটো দিকই আছে। তখনকার সময়ের ছেলেমেয়েরা পুঁথিপাঠ বা গ্রামীণ কিচ্ছা গান দেখে বিনোদন পেত। আর বর্তমানে অনলাইনভিত্তিক বহু বিনোদন মাধ্যম রয়েছে। তবে সেকালের পুঁথিপাঠ আর বর্তমানের প্রযুক্তির বিনোদনে রয়েছে বিস্তর তফাত। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে পুঁথিপাঠ সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। তা না হলে একসময় তারা জানবেই না বাংলা পুঁথিসাহিত্যেরও একটা স্বর্ণযুগ ছিল। যারা সাহিত্যপ্রেমী, লোক সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেন, গবেষণাধর্মী কাজ করেন, পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সব সংগঠন ও ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে পুঁথিসাহিত্যকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে নতুন প্রজন্মের জন্য।

 


আরো সংবাদ



premium cement