১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মায়া অথবা দূরত্বের গল্প

-

ট্রেন স্টেশনের প্লাটফর্ম ছুঁয়ে দাঁড়াতেই শুরু হয়ে গেল হুড়োহুড়ি। যাত্রী নামার আগেই আরেকদল ট্রেনে ওঠার জন্য ব্যস্ত। এত ভিড় ঠেলে নামাটাই ঝক্কি। কিন্তু উপায় নেই। নামতেই হবে। শক্ত হাতে ট্রলি ব্যাগটা ধরে রেখে কোনো রকমে নেমে এলো নীরা। প্লাটফর্ম থেকে সামনের বিশাল জটলা এড়িয়ে দূরের অন্ধকারে দিকে চোখ পাতে নীরা। ডিসট্যান্ট সিগন্যালের যে বাতিটা কিছুক্ষণ আগেও গাঢ় অন্ধকারে রক্তের মতো জ্বলজ্বল করছিল তা ট্রেন আসার পরপরই পাল্টে গেছে।
রক্তবরণ আলোটা এখন সবুজ। আহা সবুজের গ্রাম, চির সবুজের বাংলাদেশ। কত দিন পর মেহেরপুর এলো নীরা? নীরা আনমনে ভাবতে থাকে। সে-ই যে স্কলারশিপ পেয়ে থাইল্যান্ড গিয়েছিল নীরা, আর দেশে আসার ফুরসত মেলেনি। মাঝে মধ্যে অবশ্য আসতে ইচ্ছা হয়েছিল তার। এবার মা-বাবার তোড়জোড়েই তার দেশে ফেরা।
নীরা ট্রেনে ওঠার পর থেকে এলোমেলো হরেকরকমের চিন্তা এসে ভিড় করে তার মাথায়। মেহেরপুরে তাদের গ্রামে আসতে হলে নদী পেরোতে হয়, তার পর কী এক হলুদ রঙের বাস আছে, তাতে চড়ে যেতে হয় গ্রামে। বাসটি কি আছে এখনো? থাকার কথা নয়। সময়ের তাগিদে সব কিছুরই তো পরিবর্তন হচ্ছে । গাড়ি, বাড়ি জীবনযাত্রা সব কিছুই পাল্টে যাচ্ছে। এ-ই যে কেমন করে পরিবর্তন হয়ে গেল আদনান। ট্রেনের ইঞ্জিনের মতো গরম ভাপের শ্বাস ছাড়ে নীরা। আচ্ছা আদনান এখন কোথায় আছে?
ঝমঝম ঝকঝক করে সুবর্ণা এক্সপ্রেস ট্রেন প্লাটফর্ম ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কলকল করে যাত্রীরা যে যার মতো বেড়িয়ে পড়ছে প্লাটফর্ম থেকে। নীরা আনমনে ট্রলি ব্যাগটি নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। সে চলে যাওয়া ট্রেনের দিকে তাকায়। ট্রেন সাইরেন বাজিয়ে চলে যাচ্ছে তার সম্মুখের যাত্রায়। আচ্ছা মানুষ যে জীবনে আসে, সে জীবন থেকে সে যখন চলে যায়, ট্রেনের মতো সাইরেন দিয়ে যায় না কেন? আদনান তো তাকে বলেনি যে তাঁর সাথে এমন হবে! বিয়ে হওয়ার ছয় মাস পর নীরা যখন থাইল্যান্ডের স্কলারশিপ পায় আদনান তো তাকে না করেনি! বরং উৎসাহ দিয়েছে। কিন্তু থাইল্যান্ড চলে যাওয়ার পরপরই আদনান যেন বিচ্ছেদের পথ খুঁজছিল। ঢাকার কোনো এক ধ্বনি বাবার মেয়েকে সে বিয়ে করে ফেলে। ডিভোর্সের কথা নীরা যখন জানতে পায় তখন সে থাইল্যান্ডের একটি সরকারি এনজিও থেকে ব্রিলিয়ান্ট সম্মাননা পেয়ে বাসায় আসে। ফোন করে মাকে এমন খুশির সংবাদ জানাতেই সে জানে আদনান তার জীবন থেকে চলে গেছে।
এসব ভাবতে ভাবতে নীরার দুই চোখ থেকে অঝোরে কান্না আসে। স্টেশনের সিগন্যালের লাল বাতিটার রক্তবর্ণ আলোতে তার চোখজোড়া লাল ডালিমের মতো চিকচিক করে ওঠে। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকায় তার পা জোড়া কেমন অবস হয়ে আসে। নীরা এবার প্লাটফর্মের গেট থেকে বেরোয়।
প্লাটফর্মের ঠিক বাইরে ছোট্ট একটা জটলা। সে জটলার ভেতর থেকে গমগমে গলার আওয়াজ ভেসে আসে একটা মেয়ে কণ্ঠ। ‘হোয়াট আ ব্লাডি প্লেস’! ইউ ইনসিসটেড টু কাম। ফাইন্ড আউট কী আছে এই মেহেরপুরে? জটলার ভিড় ঠেলে সুট পরা এক ভদ্রলোক মেয়েটাকে শান্ত করতে চাইছে। তার চোখে চশমা আর এই অন্ধকারে তার মুখ দেখার উপায় নেই। কুল হও ইরা! আমি প্রমিস করছি, আজ রাতটুকুই কেবল। কাল ঠিক ঢাকাতে ফিরে যাবো।
নীরা এবার যেন কিছুটা থমকে দাঁড়ায়। এ পুরুষ কণ্ঠটি তাঁর খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। নীরা উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে জটলার ভেতরটাতে তাকায়। জটলটা এখন কমে এসেছে খানিক। নীরা খুব ভালো করে পরখ করে দেখে ছেলে মানুষটির এক পা সম্ভবত এক্সিডেন্ট। সমানভাবে সে দাঁড়াতে পারছে না। ছেলেটা চশমার পাতলা ফ্রেম দিয়ে সামনে থেকে লক্ষ করা নীরার দিকে তাকায়। চশমটা পরিপূর্ণ খুলে যখন আবার তাকালো ছেলেটি, নীরা যেন বিহ্বল প্রায়। তার হৃৎপিণ্ড হঠাৎ কেঁপে উঠল। আদনানের সাথে ঠিক এ রকমভাবে দেখা হয়ে যাবে সে ভুলেও কল্পনা করেনি।
হন্তদন্ত পায়ে নীরা সে জায়গা থেকে আরো অনেক সামনে গিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসে। তার ভেতরটা কেমন অসীম এক দুখে কেঁদে উঠতে চাইছে। যে মানুষ হৃদয়ে আঘাত করে চলে যায় জীবন থেকে, তার জন্যও মানুষের কখনো কখনো অদ্ভুত মায়া হয়।
নীরার সে রকম মায়া হচ্ছে আদনানের জন্য। আদনানের পায়ে কী হয়েছে? নীরা আবার ট্রেনের ইঞ্জিনের মতো গরম ভাপের শ্বাস ছাড়ে। সেই নিঃশ্বাসে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল কি না নিকষ কালো অন্ধকারে কেউ দেখেনি।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement