২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

সভ্যতার বিকাশে ফেরদৌসি, রুমি ও শেখ সাদির কবিতা

-

[গত সংখ্যার পর]

সভ্যতার বিকাশে রুমির কবিতা
ফারসি সাহিত্যের প্রথিতযশা কবি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (১২০৭-১২৭৩)। রুমির সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ কাব্যগ্রন্থ ‘মসনবি’। ছয় খণ্ডের মসনবিতে সর্বমোট পঙ্ক্তি সংখ্যা ২৫ হাজার ৬৩২টি। অপর এক বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ানে শামসে তাবরিজি’র পঙ্ক্তি সংখ্যা ৪০ হাজার ০৩৬টি। রুমির কবিতা সৃষ্টিজগতের রহস্যোন্মোচন, মানবসৃষ্টি রহস্য, জীবনদর্শন, প্রেম ইত্যাদি নানা বিষয়ে পূর্ণ। সভ্যতার বিকাশের মূলমন্ত্র গ্রথিত তার কাব্যে। সব সৃষ্টির মূলে ভালোবাসা। মানবসৃষ্টিও। প্রেমের দার্শনিক বিশ্লেষণ বিচিত্র। প্রেম শুধু নর-নারীতেই নয়; এটি জাগরূক মানবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যেও। যে আকর্ষণে মানবাত্মা তার উৎসের প্রতি ধাবিত হয় সেই আকর্ষণই ঐশী প্রেম। ‘মানুষকে ভালো না বাসলে স্র্রষ্টাকেও ভালোবাসা যায় না’Ñ এ চেতনা থেকেই জন্ম নিয়েছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবীয় প্রেম বা অখণ্ড মানবপ্রীতি। পার্থিব প্রেম ঐশী প্রেমেরই সোপান। মানবসভ্যতার বিকাশে প্রেম এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ।
স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক যত নিবিড়, জীবন ও জগতের অজানা রহস্যও তত বেশি উন্মুক্ত। বিশ্বময় বিরাজিত প্রেমের মূল সংযোগ পেতে হলে সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ততার কোনো বিকল্প নেই। অধ্যাত্মপ্রেমের আবহ মানবহৃদয়কে জীবিত ও গতিশীল করে তোলে। এরই প্রতিধ্বনি অনুরণিত হয় তাঁর কাব্যেÑ
মৃত ছিলাম, জীবিত হলাম, ক্রন্দনরত ছিলাম, সহাস্য হলাম
প্রেমের গভীর রহস্যের সন্ধান পেলাম, স্থায়ী রতেœ পরিণত হলাম
পরিভ্রমণের দূরদৃষ্টিতে প্রাণ আমার সাহসী হয়ে উঠল
দুধের উজ্জ্বলতায় আমি আলোকচ্ছটায় পরিণত হলাম।
বৈষয়িক স্বার্থ, লোভ-লালসা জীবনকে কলুষিত করে। নৈতিকতায় উজ্জীবিত মানুষ অপরের সেবায় নিয়োজিত থাকে। মানবকল্যাণ ও জবাবদিহিতার অনুভূতি তার হৃদয়ে শানিত হয়ে ওঠে। রুমির কবিতা মানুষকে এই বৈষয়িক স্বার্থান্বেষী মানসিকতা পরিহারে উদ্বুদ্ধ করেÑ
বৈষয়িক বন্ধন ছিন্ন করো, স্বাধীন হয়ে যাও, হে বৎস!
আর কতকাল থাকবে স্বর্ণ-রৌপ্যের শৃঙ্খলে আবদ্ধ?
সমুদ্রকে যদি পূর্ণ কর একটি কুয়ায়
কতটুকুই বা পান করতে পারবে একদিন?
রুমির দর্শনের মূল সুর পরমাত্মার সান্নিধ্যে পৌঁছার তীব্র আকুতি। যেখানে দেহই একমাত্র মানবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনের অন্তরায়। নফসের চাহিদা পার্থিব জগতে সব অনিষ্টের হাতিয়ার। আর রুহের অবিরাম বাসনা স্রষ্টার সাথে মিলনের; সে প্রকৃত সত্যানুসন্ধানের নেশায় তাড়িত। মানবাত্মা রূহের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর থেকে প্রতিনিয়ত বিরহ-বেদনায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। কবি প্রেমকে বিশ্বের আত্মা হিসেবে আখ্যা দেন। সঞ্চরমান জীবনের মূলে প্রেম। প্রেমই জীবনের রহস্য। প্রেমের তরেই বাঁশির সুরে বেজে ওঠে সঙ্গীত। প্রকৃত উৎসে পৌঁছার জন্যই প্রেম বিচ্ছেদের হাহাকারে ক্রন্দনরত। কবি বলেনÑ
এই বাঁশরির কাছে শোনো, কারণ সে অভিযোগ করে
বিরহ-ব্যথার করুণ কাহিনী বর্ণনা করে
যেদিন আমাকে বঁাঁশবন থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে
আমার আর্তনাদে নারী-পুরুষ সবাই কেঁদেছে
এমন হৃদয় চাই যা বিচ্ছেদে ক্ষতবিক্ষত
যেন প্রেমের বেদনা মনের মতো করে বলতে পারি।
সুফি কবি রুমি একদিকে যেমন পরমাত্মার সাথে মানবাত্মার মিলনপ্রত্যাশী, তেমনি ক্ষণস্থায়ী দৈহিক বিষয়ের ওপর প্রাধান্য দেন আত্মিক উন্নতি ও সমৃদ্ধিকে। রূহ বা আত্মার সামর্থ্য বৃদ্ধি পেলে বৈষয়িক লোভ-লালসা তার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। রুমির ভাষায়Ñ
অন্তরদৃষ্টি প্রসারিত করো, হয়ে যাবে দৃঢ় যৌবনদীপ্ত
সত্যের আলোকচ্ছটা তোমার চেহারাকে করবে পুষ্পসম।
সৃষ্টিজগতের রূপায়ণে এক বিশেষ রহস্য নিহিত। স্র্রষ্টা হিসেবে মহান আল্লাহ সবকিছুর নিয়ন্তা। তাঁরই হাতে সর্বময় ক্ষমতা। সৃষ্টি, নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলায় কেউ তাঁর অংশীদার নয়। সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত সবই তাঁর নির্দেশে তৈরি। বিশ^জগতের ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণরূপে তাঁর নিয়মে পরিচালিত। রুমির ভাষায়Ñ
মহান আল্লাহ বিনা প্রয়োজনে
দেন না কাউকে কোনো কিছুই
যদি না থাকত ধরণীবাসীদের প্রয়োজন
কিছুই সৃষ্টি করতেন না বিশ^জাহানের প্রভু।
রুমির কবিতা নান্দনিক ও মূল্যবোধের চেতনাসমৃদ্ধ। সুদীর্ঘ প্রেমময় কাহিনীর অবতারণা তার শৈল্পিক স্বাতন্ত্র্য। মসনবিতে বাদশাহ ও বাঁদীর প্রেমকাহিনীতে বৈষয়িক বস্তুনিচয়ের প্রতি ভালোবাসার স্বরূপ উন্মোচিত হয়। বাঁদীর বাহ্যিক সৌন্দর্যে মোহিত হন বাদশাহ। কিন্তু পরে বাদশাহর মোহ কেটে যায়। মানুষের পার্থিব জীবনকে কবি সাময়িক লোভ-লালসা, প্রবৃত্তির বাসনা চরিতার্থের স্থান হিসেবে চিত্রিত করেন। কুরআনের পরকালমুখী জীবনের শিক্ষাও তার কবিতায় ফুটে ওঠে নিবিড়ভাবে।

সভ্যতার বিকাশে শেখ সাদির কবিতা
কবিরা জীবনবোধের নিপুণ শিল্পী। এ ধারায় ফারসি সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবিপ্রতিভা শেখ সাদি (১২০৯-১২৯১)। তিনি এমন একজন কবি যিনি রাজা-বাদশাহ থেকে সর্বস্তরের মানুষের জীবনকে সুন্দরের দিক অনুপ্রাণিত করেন। রাষ্ট্র, সমাজ ও মূল্যবোধসহ নান্দনিকতার অপূর্ব সম্মিলন তার কবিতায়। বুস্তান বা সাদিনামা কাব্যগ্রন্থটি ১০টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। রাষ্ট্রপরিচালনা পদ্ধতি ও ন্যায়বিচার, দয়া-অনুগ্রহ, প্রেম-ভালোবাসা, বিনয়-নম্রতা, সম্মতি, সন্তোষ বা তৃপ্তি, প্রশিক্ষণ, সুস্থতায় কৃতজ্ঞতা, অনুতাপ ও সঠিক পথ এবং আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা। শেখ সাদির গদ্য ও পদ্যে রচিত গুলিস্তান-এর আটটি অধ্যায় : রাজচরিত্র, সন্তোষের মূল্য, নীরবতার উপকার, প্রেম ও যৌবন, দুর্বলতা ও বার্ধক্য, শিক্ষার গুণ ও কথাবার্তার শিষ্টাচার। মানুষের যাপিত জীবনের চিত্রায়ণ, সামাজিক ত্রুটি-বিচ্যুতি নিরূপণ এবং রাজা-প্রজার মৌল শিক্ষণীয় দিকগুলোর স্বরূপ উন্মোচিত তার কবিতায়। বুস্তানে সাদির সূচনা হয় মহান আল্লাহর প্রশংসাবাণীর মধ্য দিয়েÑ
প্রাণের স্র্রষ্টা আল্লাহর নামে শুরু
তিনি মহাজ্ঞানী, মুখে ভাষা সৃষ্টিকারী
আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল ও সাহায্যকারী
দয়ালু ও অপরাধীর গুনাহ মার্জনাকারী।
রাসূল সা:-এর প্রশস্তিগাথা রচনা ইরানি কবিদের অনন্য বৈশিষ্ট্য। শেখ সাদিও এর ব্যতিক্রম নন। রাসূলের জীবনাদর্শের শ্রেষ্ঠতম নমুনার পরিচয় মেলে তার কবিতায়। রাসূলের শানে তার রচিত নাত যুগ যুগ ধরে ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সমাদৃত হয়ে এসেছেÑ
পূর্ণতায় সমুন্নততম ধামে উপনীত তিনি
তাঁর চারিত্রিক সৌন্দর্যের দ্যুতিতে বিদূরিত হলো অন্ধকার
তাঁর গুণাবলি শ্রেষ্ঠত্বের সর্বোচ্চ শিখরে
দরুদ পড় তাঁর প্রতি ও তাঁর বংশধরদের প্রতি।
মানবিক মূল্যবোধের নির্যাসে পূর্ণ শেখ সাদির কবিতা। শাসকরা যেন মানুষের কল্যাণ করেন, অন্যায়ের প্রতিরোধ করেন; তাতেই নিহিত ধরণীর অধিবাসীদের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি। তার কবিতা শাসকশ্রেণীকে দায়িত্বানুগ হওয়ার প্রেরণা জোগায়। বিশে^ মানবিকতার ঔৎকর্ষ সাধন শেখ সাদির কবিতার লক্ষ্যÑ
যদি সরল সঠিক পথ নিশ্চিত করতে চাও
পরহেজগারগণের পথেই রয়েছে প্রত্যাশা ও ভয়
জ্ঞানীদের জন্য এটাই স্বাভাবিক
কল্যাণের প্রত্যাশা ও মন্দের ভয়
এ দুটি গুণ যদি বাদশাহর মাঝে পাও
তার দেশে-ভূখণ্ডে আশ্রয় নাও
কেননা, আশাবাদীর জন্য রয়েছে তাঁর ক্ষমা
মহান স্রষ্টার ক্ষমার প্রত্যাশী হওয়ার তরে।
সব মানুষের সৃষ্টির মূল উপাদান একই। আবার প্রত্যাবর্তনস্থলও এক। গর্ব ও অহঙ্কার প্রদর্শনের মৌলিক কোনো ভিত্তি তার নেই। তাই শেখ সাদি জীবনে পরিশীলিত ও বিনয়ী হতে উদ্বুদ্ধ করেনÑ
মাটি থেকে মহান আল্লাহ তোমাকে তৈরি করেন
তাই হে বান্দাহ, বিনয়ী হও এ মাটির মতোই
লোভী, বিধ্বংসী ও অত্যাচারী হয়ো না
যেন ভয়াবহ আগুন মাথা গুটিয়ে নেয়।
মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য নেই। রাজা-প্রজার স্থায়ী বাসস্থান একই মাটির নিচে। ক্ষণস্থায়ী ইহলোকে অহঙ্কার করার কিছু নেই। প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানী সে-ই যে নিজেকে স্রষ্টার সাথে সম্পৃক্ত করে। এ পার্থিব জীবনযাত্রা সম্পর্কে শেখ সাদি বলেনÑ
পৃথিবী কারো চিরস্থায়ী আবাস নয়, হে ভাই
স্র্রষ্টার সাথে হৃদয়কে আবদ্ধ করো তাই, মোটেই
দুনিয়ার রাজত্বের ওপরে ভরসা করো না
তোমার মতো অনেককেই লালন ও ধ্বংস করেছে সে
যখন পবিত্র প্রাণপাখি চলে যাবার সুর তোলে
সিংহাসনে অথবা মাটির ধূলিতে মৃত্যুতে কিই বা যায় আসে!
মানুষের দৈনন্দিন কার্যক্রমে তাদের সৌজন্য-শিষ্টাচার, পরিশীলিত মনসিকতার পরিচয় প্রকাশ পায়। সংস্কৃতিবান মানুষের কথা-বার্তা, আচার-আচরণ সবই উন্নত হয়। সমাজের বহুমাত্রিক দিকগুলো উন্নত হয়। পারস্পরিক সৌজন্যপূর্ণ ব্যবহারের বিভিন্ন দিকও ফুটে ওঠে শেখ সাদির কবিতায়Ñ
বক্তব্য রহস্যময় হে জ্ঞানী, প্রাজ্ঞ
অপরের কথার মাঝে বলো না কোনো কথা
সভ্য, সংস্কৃতিবান ও জ্ঞানবান ব্যক্তি
নীরবতা না দেখলে কথা বলে না কখনো।
মানবতার মূলমন্ত্র সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এক আদমসন্তান। বিশে^র যেকোনো প্রান্তে একজন মানুুষ ব্যথিত হলে তার দুঃখে সবার পীড়িত হওয়া উচিত। এতেই নিহিত মানবতার মহান পরিচয়। যদি অন্যের ব্যথায় হৃদয় ব্যথিত না হয় তাহলে মনুষ্যত্বের মর্যাদাহানি হয়। কবি সাম্য, শান্তি ও সুখের পৃথিবী গড়ার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেনÑ
আদম সন্তান একে অপরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ
কারণ, সৃষ্টি হয়েছে একই মূল উৎস থেকে
যদি একটি অঙ্গ ব্যথিত হয় কোনোদিন
অপর অঙ্গের থাকে না কোনো স্বস্তি
তুমি যে অপরের দুঃখ-কষ্টে নির্বিকার
মানায় না তোমাকে মানুষ নামে ডাকা।
জীবনকে উন্নত ধ্যান-ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি, সত্য-সুন্দর চেতনায় সমৃদ্ধায়নে সাহিত্য নিয়ামকস্বরূপ। ফারসি কবি ফেরদৌসি, রুমি ও শেখ সাদি মানুষের মননকে পরিশীলিত করেন। মানবিক মূল্যবোধের শেকড় প্রোথিত করেন। তাদের কবিতা কালিক ও ভৌগোলিক সীমা পেরিয়ে মানুষের জীবনকে সভ্য, উন্নত করে তোলে; জীবনবোধ, দর্শন, মূল্যবোধ ও নান্দনিকতার অপূর্ব সম্মিলনে জীবনের অগ্রযাত্রা সুনিশ্চিত করে। এভাবেই সভ্যতার বিকাশে তাদের কবিতার বাহ্যিক ও অন্তর্লোকের প্রেরণা সুদূরপ্রসারী। চিরায়ত ফারসি কবিতার ভাব, বিষয়বস্তু ও শৈল্পিক নান্দনিকতা সভ্যতার উপজীব্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে যুগ যুগ ধরে। ফেরদৌসি, রুমি, শেখ সাদিও মানবসভ্যতার নির্মাতা হিসেবে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন চিরদিন। হ


আরো সংবাদ



premium cement