২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সভ্যতার বিকাশে ফেরদৌসি, রুমি ও শেখ সাদির কবিতা

-

ভূতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় পরিবেশ এবং শিল্পকলার উৎকর্ষে জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিত্রকর্ম, স্থাপত্য, শিল্পসাহিত্য, জীবন, সংস্কৃতি ইত্যাদি অনুষঙ্গে বিকশিত হয় মানবসভ্যতা। সভ্যতার বিকাশে শিল্পসাহিত্য বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ। কবিতা, গান, গল্প, নাটক মানুষের জীবনধারার স্বরূপ উদ্ঘাটনের সাথে সাথে চিন্তালোকে নব নব ভাবনার উন্মেষ ঘটায়, সৃষ্টিশীল চেতনাকে শাণিত করে। জীবনরীতি, মানবিকতা, ঐতিহ্যানুরাগ, সত্যানুসন্ধান, যশ-খ্যাতির তীব্র বাসনা সভ্যতার আধেয়। কবিদের কালজয়ী সৃষ্টি মানবহৃদয়কে নব নব ভাব-সাগরে অবগাহনে অনুপ্রাণিত করে। ফারসি কবিদের অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কাব্যধারা সভ্যতার বিকাশে যে অবদান রেখেছে তা সূর্যের মতো ভাস্বর। বিশেষত কবি আবুল কাসেম ফেরদৌসি, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি, শেখ সাদির ভূমিকা অবিস্মরণীয়। তাদের কবিতা দেশ, কাল, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বিশ^সভ্যতার শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম।

সভ্যতার বিকাশে ফেরদৌসির শাহনামা
মানবসভ্যতার বিকাশে যেসব ইরানি কবি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকায় অবতীর্ণ ফেরদৌসি তাদের শীর্ষে। প্রাচীন ইরানের ভাষা-সাহিত্যের ঔৎকর্ষে তার ‘শাহনামা’ শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম। ইরানের ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরা যখন মানবেতিহাসের পাতা থেকে ম্র্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছিল, ফেরদৌসি তখন মহাকাব্য শাহনামার মাধ্যমে তার উন্মেষ সাধন করেন। বাদশাহদের ঐতিহাসিক জীবনধারা, শাসনপ্রণালি, সভ্যতা বিনির্মাণের নানা উপাখ্যান প্রতিফলিত হয় শাহনামায়। জ্ঞান-প্রজ্ঞা, বিশ^সৃষ্টি রহস্য, মানুষ সৃষ্টির মূলতত্ত্ব, দর্শনসহ জীবনধারার মৌলিক অনুষঙ্গ কবিতার মুখ্য বিষয়। শাহনামা বিষয়বস্তু ও অনন্য বৈশিষ্ট্যের বিচারে বিশ^সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম।
শাহনামার সূচনা হয় মহান আল্লাহর প্রশংসার মধ্য দিয়ে। কবির ভাষায়Ñ
প্রাণ ও প্রজ্ঞার প্রভুর নামে শুরু করি
কল্পনা অতিক্রম করতে পারে না তাঁর নামের সীমা
প্রভু তিনি নামের, প্রভু তিনি স্থানের
তিনিই আহার্যদাতা, তিনিই পথপ্রদর্শক।
মানবসভ্যতা বিকাশের অন্যতম মৌলিক উপাদান জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। জ্ঞানের শৌর্যবীর্যে বিজিত হয় পৃথিবীর নানা ভূখণ্ড, নির্মিত হয় নব নব সভ্যতা। জীবনের মূল পুঁজি হলো জ্ঞান। জ্ঞান-প্রজ্ঞায় যে শক্তিমান, নেতৃত্বের চাবিকাঠি তারই হাতে। বিশ^সভ্যতার অনিবার্য উপাদান জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রসঙ্গ শাহনামার প্রধান প্রতিপাদ্য। ফেরদৌসি মানুষের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলেন এভাবেÑ
জ্ঞান যে আহরণ করে সেই সামর্থ্যবান
জ্ঞান দ্বারা জরাগ্রস্ত প্রাণ ফিরে পায় যৌবন
জেনে রাখ, জ্ঞান জীবন্ত ও চিরঞ্জীব
জেনে রাখ, জ্ঞান জীবনের পুঁজি
জ্ঞান সম্রাটদের সম্রাট
জ্ঞান খ্যাতিমানদের অলঙ্কার
ওহে, জ্ঞান হতে যা পাও, তা অর্জন করে নাও
কেননা, শ্রবণ তার সঙ্গে মিলনের জন্য অস্থির।
শাহনামা পৌরাণিক কল্পকথা, ঐতিহাসিক ঘটনাপরম্পরা ও বীরত্বপূর্ণ কাহিনীতে পরিপূর্ণ। পৌরাণিক বা রূপকথামালা ইরানের প্রথম সম্রাট কিউমারস থেকে সূচিত হয়। হোশাঙ্গ, তাহমুরস, জামশিদ এবং জোহাকের বর্ণনার পর ফারিদুনের সিংহাসন আরোহণের মধ্য দিয়ে এ যুগের পরিসমাপ্তি। মানুষের খাদ্য-বস্ত্র অনুসন্ধান, অগ্নি উদ্ভাবন ও কৃষিকাজসহ অন্যান্য পেশা উদ্ঘাটনের সাফল্যও এতে গ্রথিত। শাহনামায় ইরানের প্রাচীন সম্রাটদের কীর্তি, আচার-ব্যবহার, সমাজ-সভ্যতা, সমরকৌশল, শাসনপ্রণালি, বিদ্যা-বদান্যতা এবং তৎকালীন লোক-চরিত্র, খেলাধুলা, শিল্প-বিজ্ঞান ইত্যাদি বহু বিষয়ের সমাহার ঘটেছে। এ ছাড়াও তাওহিদ, দর্শন, মানবসভ্যতার ইতিহাস, সামাজিক বিবর্তন ও নৈতিকতার সাথে সম্পৃক্ত বিষয়াবলিরও প্রাধান্য রয়েছে।
অ. ঔ. অৎনবৎৎু বলেন : "ঋরৎফধঁংর'ং ঝযধযহধসধয, পড়হংরফবৎবফ নড়ঃয য়ঁধহঃরঃধঃরাবষু ধহফ য়ঁধষরঃধঃরাবষু, রং ঃযব মৎবধঃবংঃ ড়িৎশ রহ চবৎংরধহ ষরঃবৎধঃঁৎব ধহফ ঢ়ড়বঃৎু; রহফববফ, ড়হব পধহ ংধু ঃযধঃ রঃ'ং ড়হব ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ'ং ষরঃবৎধৎু সধংঃবৎঢ়রবপবং."র
ফেরদৌসি বহুমুখী চরিত্র নির্মাণে দক্ষ শিল্পী। পৃথিবীর যেকোনো মহাকবির সৃষ্ট চরিত্রের চেয়ে তা সংখ্যায় কম নয়; মানবিক গুণে হীন নয়, শৌর্য-বীর্যে খাটো নয় এবং প্রেমে ও সহানুভূতিতে অনুজ্জ্বল নয়। ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের পতন এই মূল্যবোধের ভিত্তিতে এসব চরিত্রের গতিপ্রকৃতি অনুবর্তিত। কোনো চরিত্রের প্রতিই কবির কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই; স্রষ্টার মমত্ববোধ ও সহানুভূতিতে তা অগ্রসরমান। এই অমর শিল্পকর্মই ফেরদৌসিকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবিদের মর্যাদায় আসীন করে। ন্যায়ানুগ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা প্রশংসার্হ হিসেবে ধরা দিয়েছে তার কাব্যে। বাদশাহ নওশেরওয়ানের শাসনামলে মানুষ ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নীচু ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এক অনাবিল শান্তির নীড়ে বসবাস করতে থাকে। কবির ভাষায় তা ফুটে ওঠে এভাবেÑ
এভাবে সারা বিশ^কে পূর্ণ করল ন্যায়ের শাসনে
সকল অনাবাদি ভূমিকে করল আবাদি
উঁঁচু-নীচু সবাই নির্ভয়ে প্রান্তরে নিশ্চিন্তে নিদ্রা যেত
একই ঘাটে মেষ ও নেকড়ে নির্ভয়ে পান করত পানি।
ফেরদৌসির কবিতা বহুমুখী বিচিত্রসৌষ্ঠবে মহিমান্বিত। বীরত্বপূর্ণ কাহিনী প্রধান উপজীব্য হলেও এর মর্মে মর্মে ঝঙ্কৃত ন্যায়ের বার্তা। বৈষয়িক অসারতা, সদাচরণের জয়গান, মানুষের কল্যাণের প্রতি উদার মমত্ববোধ তার কাব্যের হৃদয়াবেগকে সর্বজনীন করে তোলে।
নাম ছাড়া তার কিছু টিকে থাকে না পৃথিবীতে
দুঃখ-কষ্ট জীবনের সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে যায় অবসান
পৃথিবীতে সুনাম ব্যতীত আর কিছুই ছেড়ে যাবে না
যার প্রত্যাশা থাকে পরিণামে মঙ্গল কিছু
প্রতিটি অকল্যাণ থেকে প্রার্থনা করো আশ্রয় তাঁর কাছে
কেননা, তিনি সজ্জনদের প্রতি দয়ালু ও অসত্যের ওপর প্রভাবশালী।
শাহনামার দৃশ্যপট খুবই হৃদয়গ্রাহী। রণক্ষেত্রগুলো বিপুল প্রসারিত। বড় ভয়ঙ্কর সেই রণক্ষেত্র। তীক্ষè তরবারির বিদ্যুৎ ঝলকে রক্তের স্র্রোত বয়ে যায়। সৈন্যদের পদধুলায় আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়। অস্ত্রের ঝঙ্কারে ভীতিকর পরিবেশের অবতারণা ঘটে। অন্যদিকে শাহনামার প্রাকৃতিক দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। উপত্যকায় ও উপবনে চক্ষুশীতলকারী হরিণদলের বিচরণ মন প্রফুল্লø করে। কোথাও কোথাও প্রবাহিত স্রোতস্বিনী হৃদয়মনকে উচ্ছ্বাসে নাচিয়ে তোলে। সর্বোপরি শাহনামা দীর্ঘকালের সাধনালব্ধ অবিস্মরণীয় কাব্যপ্রতিভার স্ফুরণ; যা ফেরদৌসিকে অমর করে রেখেছে। কবির ভাষায়Ñ
দীর্ঘ ত্রিশ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে
এ ফারসি গ্রন্থ দ্বারা ইরানকে পুনরুজ্জীবিত করে গেলাম।
[বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়]


আরো সংবাদ



premium cement
এফডিসিতে সাংবাদিকদের ওপর হামলা গাজার বালিতে আটকে পড়েছে ইসরাইলি বাহিনী : হামাস মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদন : যা বলছে আওয়ামী লীগ মান্দায় বিদ্যুতের আগুনে পুড়ল ৮ বসতবাড়ি রিজওয়ানকে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ব্র্যাডম্যান বললেন আফ্রিদি গোবিন্দগঞ্জে ট্রাক্টরচাপায় নারী নিহত অভিযোগ করার পর ইনসুলিন ইঞ্জেকশন কেজরিওয়ালকে! হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশনা তালায় আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ১৩টি পরিবারের মাঝে জামায়াতের সহায়তা প্রদান শেরপুরের মহাসড়ক যেন মরণ ফাঁদ বেনজীরের সম্পদ নিয়ে দুদকের অনুসন্ধানের অগ্রগতি প্রতিবেদন চাইলেন হাইকোর্ট

সকল