২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কবিতা ভাবনা

-

কবিতা? কার সৃষ্টি কে লেখেন কবিতা? কবি? কে কবি? যে বা যিনি যে নামেই ডাকুক তাঁরে। আমি বলি কবি হলেন স্রষ্টার বীণা। তিনি বাজালেই কবি বেজে ওঠেন। নচেৎ একটা অক্ষর গড়ার ক্ষমতা কবির নেই। শুধু কবিতা লিখলেই কবি হওয়া যায় না। কবি অন্য আর ১০টা পাঁচটা মানুষ থেকে হবেন স্বতন্ত্র। তার স্বভাব ফুলের মতো কোমল। আবার প্রতিবাদে তুলবেন ঝড়। মানবে স্ববান্ধব। সত্যনিষ্ঠ ন্যায়পরায়ণ মহানুভবে হবেন অদ্বিতীয়। দুঃখকে অতি যত্ন বুকের পাঁজরে লুকিয়ে রেখে মৃণালের হাসি ছড়াবেন কবি। কবি সমাজ সংস্কারক। বিবর্তনের ধারা। কবি সদা নবীন। কোনো অন্যায়ের কাছে হবে না মস্তক অবনত। কবির সাধনা শুধুই জানা। অজানাকে জানার দুর্নিবার স্পৃহা যার যত বেশি তিনিই প্রজ্ঞাবাদী। কবি হবেন ধেয়ানী। কবি একজন শ্রেষ্ঠ পাঠক।
কবি যে কবিতার জন্ম দেন সেই কবিতা কি? কবির মনের কথা? মনের কথা তো সবাই লিখতে পারেন কুমারী কাগজে। কিছু অক্ষর ছড়িয়ে দিলেই কবিতা? না। কবিতা হলো সর্বোচ্চ আর্ট। কিসের আর্ট? চিত্র? না। সমগ্র সাহিত্য শাখার উচ্চাঙ্গের আর্ট। তাই তার পাঠক হবে হাতেগোনা ১০ জন। যিনি কবিতা বোঝেন তারই উচিত কবিতার সমালোচনা বা ভাব বিশ্লেষণ করা। গদ্য যদি শরীর বা দেহ। কাব্য হলো সেই দেহের প্রাণ। যাকে স্পর্শ করতে হলে সাধনা করা দরকার। তপস্যায় কবিতার জন্ম হয়।
কবিতা শ্রবণের বিষয় নয়। পড়ার বিষয়। যিনি গায়ক তার কণ্ঠে থাকে সুর মাধুরিমা। সেই সুরের জাদুতে তিনি শ্রবণেন্দ্রীয়কে শীতল করে হৃদয়ে বইয়ে দেন প্রেমের ফল্গুধারা। কবিতাও তেমনি শ্রবণে শ্রুতিমধুর হয়ে উঠতে পারে। আমি নীলাকে ভালোবাসি। রোজ তাই ছুটে আসি, শুনতে ভালো লাগলো কিন্তু কবিতা কতটুকু হলো? আদৌ কবিতার ফর্মে গেল কি না তাও দেখার বিষয়। তাই কবিতা চোখে পড়ে দেখার বিষয়।
অমুকের কবিতা ভারি চমৎকার! কিভাবে শোনে?
তাহলে তো জাতকবি বিশুদ্ধ কবি স্বভাব কবি ভাবের কবি ভাতে মারা যাবে। সত্যিকারের কবির প্রতি সদয় হয়ে তার কবিতা পড়ুন। যার তার পড়ার দরকার নেই। যিনি কবি তিনিই যেন তা অধ্যয়ন করেন। অন্যথা ওই কবির কলম কলঙ্কিতই হবে। এ আমার মনের কথা স্বগতোক্তি। অন্যের ব্যাপার আমি জানি না। জানতে চাইও না। আমার মন যা বলে। আমার বোদ্ধাঙ্কের গড় নির্ণয়ে মেধার যাচাই-বাছাইতে আমিই তো বলবো আমার কথা।
আমার এই কাব্য কথন।
যার জন্য লিখন!
সেইতো বোঝুক
অন্যে তার কিছু না জানুক।
কাব্যে বিশুদ্ধতা অপরিহার্য। গদ্য কবিতা কেমন?
কয়েকজন কবির নাম উল্লেখ করতেই হবে। বুদ্ধদেব বসু , প্রেমেন্দ্র মিত্র, অজিত দত্ত, বিষ্ণুদে, জীবনানন্দ দাশ, অমীয় চক্রবর্তী। গদ্য কবিতার সৃজনে ব্যাপৃত। রবীন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন।
জীবনানন্দ বলেন-
নীল আকাশে খই ক্ষেতের সোনালী ফুলের মতো অজস্র তারা।
জুলি যদি বলে-
রাতের আকাশ নীরব খই পল্লীর তারার ফুলে ঢাকা।
খুব কি বেমানান?
একবার এক কবি বলেছিলেন আপনি যদি দীর্ঘ কবিতা লিখবেন তবে আপনাকে সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা পড়তে হবে। আমি নীরবে স্মিত হাসি ঢেলেছিলাম।
কারণ তার কোনো মেরুদণ্ড নেই। মেরুদণ্ডহীন প্রাণী হলো কেঁচো তুল্য।
আমার যদি হাত পা মাথা ঘাড় থাকে অন্যের ঘাড়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াতে যাবো কেন?
আমি আমারই মতো। নইতো অন্য কারো মতো।
এই মত পথ সকল কবির হওয়া চাই। জগতে মুনি ঋষিদের বাণী শুনতে পড়তে হবে। চৌর্যবৃত্তিতে পারদর্শী হওয়া ন্যায়সঙ্গত নয় মোটেই। বেশির ভাগ অনুবাদক অন্যের কবিতা নিজের নামে করে রাতারাতি কবি ও অনুবাদক হয়ে ওঠেন। বড় কবি হয়ে ওঠেন। তাদের বড় করে নির্বোধ পাঠক। যারা নিজেরাই জানে না কোনটা কবিতা কোনটা আগাছা। তারা নিজে নিজেই দশকওয়ারি হয়ে ওঠেন। যিনি প্রবন্ধ রচয়িতা তিনি প্রাবন্ধিক কবি নন। তার কি উচিত কবিতার আলোচনা সমালোচনা করা? মোটেই না। এই সব সবজান্তার কারণে ভালো কবিতা ছাইচাপা আগুনে পোড়ে। তারা মঞ্চবিলাসী মাইক বিলাসী বিধায় কিছু হয়ে থাকা কলমধারী তাদের তোয়াজ করে লেখক সমাজে মান বাড়াতে থাকে।
কালের চাকায় ঘূর্ণনে এদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
এই জন্যই পদ পদবির মান নেই বললেই চলে। লম্বা লাইন দিয়ে পদ পদবি অর্জন করলেই বোদ্ধা হওয়া যায় না। বোদ্ধা হতে হবে প্রকৃত পাঠকের চোখে। সেদিন লাইভে একজন বলে গেলেন সবপদকেই এখন ভেজাল। কোনোটাই নির্ভেজাল নয়। বহু কষ্টে হাত চেপে রাখলাম। তাহলে তারটাও নিশ্চয়! এ ভাবেই মিথ্যার মোড়ক খোলে সত্যের প্রকাশ ঘটে এবং ঘটবেই। যে সন্তানের আমি জন্মই দিলাম না। কী করে তার জনক দাবী করি? বর্তমানের কিছু নির্লজ্জ বেহায়া কলমনবীস নিজেকে এভাবে জাহির করে বেড়ায়। ঘাস কাঁটা ঘেসোয়া কিছু অজানা পাঠক বাহবা দিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠিত করে ক্রিয়াপদহীন কবিতার জনক বলে।
এমনি আরো কত অনাচার চোখ বন্ধ করে হজম করতে হয়। কারণ সত্যের নিক্তি ওজনে কম প্রায়শই। তবে সত্যের জয় অনিবার্য। তা হয় ধীরে ধীরে। ঝিনুকের মুখ আলগা হতে সময় লাগে। ততক্ষণে নকল মণিহার অনেকেই কণ্ঠে ধারণ করেন। এ তো গেলো কবিতার ভয়ানক ক্ষয়িষ্ণু দিক।
আমার দৃষ্টিকোণ থেকে কবিতার স্থান শীর্ষে। গল্প উপন্যাস , গীতিকাব্য, গান, নাটক, প্রবন্ধ ,নিবন্ধ, পুঁথি, ছবি আঁকা এসব কিছুর ঊর্ধ্বে কাব্য। তাই কবিতাকে যত্ন করেই লালন পালন করা কবির কাজ। কবিতা হলো প্রতিভা। এই প্রতিভা সব সাহিত্যকে টানে বলেই আমার বিশ্বাস। যার কবিতা ভালো গদ্যে তার দখল ফেলনা নয় নিশ্চয়। কবিতা কবিতা হয়ে উঠলে গানে দখল পুরোপুরি। উপমা পরিপ্রেক্ষিত রূপকতাই কবিতার বিষয়। এই জন্য আবেগ হলো কবিতার সর্বোত্তম প্রবক্তা। কিন্তু কবি তার ধারালো মেধা দিয়ে মনন দিয়ে সেই আবেগকে প্রশমিত করে কবিতার শরীর করেন মেদহীন হৃষ্টপুষ্ট। কবিতা হয়ে ওঠে শালীন দেহসৌষ্ঠব। শুধু তাই নয় কবিতা প্রিয় প্রিয়ার প্রেম অধরা। তাই তার জন্য সত্য সাধনা দরকার। যে সাধনায় আল্লাহর নৈকট্য মেলে। কবিতা নারীর শরীর। ভাঁজ খুলে পাটে পাটে তার স্পর্শ করলে সেখানে যে প্রেমের জন্ম হয় যা অনন্ত। এমন মোহময় অন্তঃদর্শনভাব মিলনে কবি ও কবিতা মিশে একাকার। তারপরও কবির মনে থাকবে মিলনের আকুতি যেন নিদাঘ জলের ভেতর হাবুডুবু। তাইতো জুলি বলে ওঠেন,
এমন প্রেমনদীতে মোহ প্রেমে আমি ডুবতে পারলাম না।
জলের কূলতো পেলাম না।
কাব্যে বক্রোক্তি থাকতেই হবে। কেন না বক্রোক্তিই হলো কাব্যপ্রাণ! সহজ করে বলা কথা বা বাক্য কাব্যের সমগ্রতা পায় না। এ আমার কথা। অন্যের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নাও হতে পারে। কাব্যের বাকপরিবর্তন ঘটেছে বহুবার বহু দশকওয়ারি কবিদের মাধ্যমে। আমি কোথায় কোন তরীতে পাড়ে যাবো, সে ভাবনা আমার। একান্ত নিজের ভাবনা চেতনা কর্মের স্বাধীনতা আমার।


আরো সংবাদ



premium cement