২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মুহম্মদ মতিউর রহমান ফররুখ-গবেষক

-

ফররুখ আহমদ বাংলা সাহিত্যে অন্যতম শক্তিশালী ও মৌলিক প্রতিভার কবি। তার বহুমুখী প্রতিভা বিকশিত হয়েছে কবিতা ও গানে। ছোটগল্প এবং উপন্যাসে খুব সফলতা না এলেও অনুবাদ সাহিত্যে এবং নাটিকায় ঈর্ষান্বিত সফলতা অর্জন করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি উপেক্ষিত হন এবং তার জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে অবজ্ঞা, অবহেলা এবং অসচ্ছলতার মধ্য দিয়ে। তবুও তিনি ছিলেন অবিচল এবং বিশ্বাসী। কিন্তু তার কাব্য শুধু মুহূর্তের কাব্য ছিল না; তার মধ্যে চিরন্তন মূল্য আছে। এটা বুঝতে হলে তার কাব্যের চর্চা হওয়া উচিত। এই কাজে যারা অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে মাহফুজ উল্লাহ, শাহাবুদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, তিতাশ চৌধুরী, সদরুদ্দিন আহমদ ও মুহম্মদ মতিউর রহমানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় ‘ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশন’ (যা প্রথমে ‘ফররুখ একাডেমি’ নামে পরিচিত ছিল।) নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে প্রতি বছর কবির জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশবরেণ্য কবি-সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ফররুখ সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে একাডেমিক সেমিনার ও আলোচনা করা হয়। ফলে ফররুখ চর্চার নানা বিষয় উন্মোচিত হয়। কিন্তু ‘ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশন’-এর কর্মকাণ্ড শুধু কবির জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপনের মধ্যে সীমিত নয়। এ পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ফররুখ আহমদের বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ, ফররুখ আহমদের উল্লেখযোগ্য আটাশটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ (কবি আব্দুর রশিদ খান অনূদিত) ও ফররুখ আহমদের ওপর কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশ করা ছাড়াও তার সম্পাদনায় ‘ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশন পত্রিকা’ নামে একটি মূল্যবান পত্রিকা প্রকাশ হয়ে থাকে। কবির জন্ম ও মৃত্যু দিবস উপলক্ষে বছরে দু’বার এটি প্রকাশিত হতো তবে প্রতিকূল পরিবেশের কারণে বর্তমানে একটি করে সংখ্যা বের হয়। এ সঙ্কলনে শুধু ফররুখ সাহিত্যের নানা দিক আলোচনা, পর্যালোচনা, তুলনা যেমন স্থান পায় তেমনি বিলুপ্ত প্রায় ফররুখের গান সংগ্রহ করে পাঠকের কাছে তুলে ধরে এবং ফররুখ সাহিত্যের অনুবাদও নিয়মিত প্রকাশ করে থাকেন।
এ ধরনের একটি পত্রিকা এ দেশের অন্য কোনো কবি বা লেখককে নিয়ে প্রকাশিত হয় না। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে নিয়েও হয় না। এই কাজটা খুব সহজ নয়। কেননা লেখা জোগাড় করা বাস্তবিকই কঠিন। কারণ শুধু ফররুখ-বিশেষজ্ঞ ছাড়া অন্য কেউ তার ওপর লিখতে চান না বা পারেন না। আবার ফররুখের মতো বিশ্বাসী মানুষ ছাড়া তার সৃষ্টকর্ম নিয়ে লেখার সাহসও অনেকে দেখান না। লেখা জোগাড় করতে হলে লেখকদের বারবার তাগাদা দিতে হয়। কিন্তু মুহম্মদ মতিউর রহমান ছিলেন নাছোড়বান্দা। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া তিনি যেমন করে হোক লেখা আদায় করে ছাড়তেন।
সাহিত্য সমালোচক সদরুদ্দিন আহমদের উক্তি এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তিনি এ বিষয়ে উল্লেখ করেন, ‘আমি নিজে ফররুখের ১৪-১৫টি কবিতার বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা লিখেছি ফররুখ গবেষণা পত্রিকায়। বারবার তাগাদা না দিলে এ প্রবন্ধগুলো হয়তো কোনো দিন লেখা হতো না। এভাবে ফররুখ-চর্চায় তিনি আমাকে যেমন উদ্বুদ্ধ করেছেন, আমার বিশ্বাস অন্যদেরকেও তেমনিভাবে তিনি উদ্বুদ্ধ করে থাকেন। এর ফলে ফররুখ-চর্চার ক্ষেত্রে একটা মূল্যবান মাত্রা যোগ হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এ প্রাতিষ্ঠানিক ফররুখচর্চার ক্ষেত্রে মুহম্মদ মতিউর রহমানের অবদান অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ।’
ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশন থেকে বেশ কয়েকটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, এর মধ্যে মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহর ‘বাংলা কাব্যে ফররুখ আহমদ : তার শক্তি ও স্বাতন্ত্র্যের স্বরূপ’ এবং শাহাবুদ্দীন আহমদের ‘উপমা-শোভিত ফররুখ’, সদরুদ্দিন আহমদের ‘ফররুখ কাব্যের নিগূঢ পাঠ’, মুহম্মদ মতিউর রহমানের ‘ফররুখ প্রতিভা’ ও ‘সাত সাগরের মাঝি’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া মুহম্মদ মতিউর রহমান ফররুখ আহমদের অমর কাব্য ‘সিরাজাম মুনীরা’ কাব্যটি ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে পুনর্মুদ্রণ করেছেন। তার সম্পাদনায় ‘ফররুখ প্রতিভা ও স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য’ শীর্ষক দু’টি খণ্ড বের হয় এবং তৃতীয় খণ্ডের পাণ্ডুলিপি প্রায় প্রস্তুত করেছিলেন। তার আন্তরিক চেষ্টা ও আর্থিক সহযোগিতা না পেলে এ বইগুলো কোনোদিন প্রকাশিত হতো কি না সন্দেহ।
তিনি অন্যদের উদ্বুদ্ধ যেমন করেছেন তেমনি নিজেও নিয়মিতভাবে লিখেছিলেন। তার ফররুখ-চর্চার অত্যুজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে কবির শততম জন্মদিবস তার উদ্যোগে দেশব্যাপী নানা কর্মসূচি ও লেখালেখি । তবে নতুন আঙ্গিকে ‘ফররুখ প্রতিভা’ কলেবরের দিক থেকে যেমন এটি সমৃদ্ধ, উৎকর্ষতার বিচারেও এ গ্রন্থটির অবদান অপরিসীম। এ গ্রন্থের প্রবন্ধগুলোকে মূলত দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ১) তথ্যমূলক, ২) সমালোচনামূলক।
যেকোনো কবি সম্পর্কে তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এ সম্পর্কে টিএস এলিয়ট লিখেছেন ‘তুলনা ও বিশ্লেষণ’। এ বইয়ে ফররুখ সম্পর্কে যেসব তথ্য মুহম্মদ মতিউর রহমানের বইতে স্থান পেয়েছে সেগুলো ফররুখকে বুঝতে বা মূল্যায়ন করতে সহায়ক হতে পারে। সমালোচনার কাজ হচ্ছে শিল্পকর্মের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। মুহম্মদ মতিউর রহমান বইটির সমালোচনামূলক প্রবন্ধগুলোতে তাই করেছেন। তিনি ফররুখের প্রত্যেকটি কাব্য বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনা করেছেন। কোনো কোনো কবিতার সাথে অন্য কবির কবিতার তুলনামূলক সমালোচনা করেছেন। যেমন ফররুখের ‘বৈশাখ’ কবিতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘বৈশাখ’ কবিতার তুলনা করেছেন। তাছাড়া, তিনি ফররুখের প্রত্যেকটি কাব্যের অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলোর বিষয়বস্তু আলোচনা করেছেন এবং সেগুলোর বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করেছেন। এসব লেখায় তার গভীর অন্তর্দৃষ্টি, তীক্ষè বিশ্লেষণ ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। বস্তুত ফররুখের কাছে পৌঁছাবার একটি সেতু তিনি রচনা করেছেন এ বইটির মাধ্যমে।
ফররুখ আহমদ আমাদের অন্যতম বড় কবি। তার লেখায় আমাদের জীবনের সমগ্র রূপ প্রকাশ পেয়েছে : আমাদের আশা-আকাক্সক্ষা, আমাদের মানবতাবাদের আদর্শ, আমাদের সমাজের গ্লানি ও কদর্যতা। আর এ প্রকাশ অনবদ্য, অনন্য। এমন একজন কবির সামগ্রিক পরিচয় ও মূল্যায়নের লক্ষ্যে মুহম্মদ মতিউর রহমান নিরলসভাবে যে কাজ করেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
মুহম্মদ মতিউর রহমান ১৯৩৮ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার চর বৈলতল গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর লাভের মধ্য দিয়ে শিক্ষা জীবন শেষ করলেও পড়াশোনার প্রতি ছিল প্রগাঢ় ভালোবাসা। দেশী-বিদেশী এবং ধর্মতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা ও পড়াশোনায় ছিলেন অনন্য। সাংগঠক হিসাবেও ছিলেন অনুকরণীয়। ফররুখ আহমদ যেমন ইসলামের প্রতি ছিলেন আমৃত্যু অবিচল, মুহম্মদ মতিউর রহমানও ছিলেন তেমনি একজন। কখনো অন্যায়ের সাথে আপস করেননি। এ মহান গবেষক, সাহিত্যিক ও সংগঠক ৮ এপ্রিল ২০২১ সালে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যান পরপারে। বাংলা সাহিত্য যত দিন বেঁচে থাকবে ফররুখ কাব্য ও গান তত দিন বেঁচে থাকবে। ঠিক তেমনি মুহম্মদ মতিউর রহমানের অবদানও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement