২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
যে ক থা হ য় নি ব লা

লেখক না হলে কে আমাকে স্মরণ রাখত : অনুপম হায়াৎ

-

লেখক না হলে কী হতেন?
শৈশব থেকে আমি রক্ত, মাংসে, অস্থিমজ্জায় লেখকই হতে চেয়েছি। আমার মায়ের মৃত্যুর পর আমার ভেতর যে অনুভূতি জাগ্রত হয় তা ছিল কবিতার মতো। যদিও কবিতা হয়নি। কেননা আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। আমি লেখকদেরকে মনে করতাম আল্লাহর শ্রেষ্ঠ জীব। তারা কি করে কল্পনায় একটি শব্দ তৈরি করে! যেমনÑ ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলোরে দুনিয়ায় অথবা আমি হব সকালবেলার পাখি’। এই লাইনগুলো আমাকে স্বপ্নের দেশে নিয়ে যেত। আমিও সেটিই হতে চেয়েছিলাম।
যে প্রতিবন্ধকতা জয় করে লেখক হলেন?
সততা, স্বপ্ন, উচ্চাকাঙ্খা, অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে আমাকে লেখক হতে হয়েছে।
লেখক ও ব্যক্তি জীবনের প্রার্থক্য কি?
এক অর্থে এ কথাটির প্রভেদ আছে আবার প্রভেদ নেইও। কেননা ব্যক্তির চিন্তা-চেতনার মধ্য দিয়েই একজন মানুষ লেখক হয়ে ওঠে। লেখক সত্বা আলাদা হলে ব্যক্তির মাধ্যমেই আসে। কাজেই আমি এ দুটোকে কখনো আলাদা করে দেখিনি।
চলচ্চিত্রে নিজেকে কেমন অনুভব করেন?
চলচ্চিত্র তো একটি স্বপ্নের দেশ। মানুষ সবসময় কিন্তু স্বপ্ন দেখে। সে স্বপ্নের কল্পিত জগতকে বাস্তবে তুলে এনে পর্দায় দেখানো হয়। চলচ্চিত্র নিয়ে আমি অনুভব করেছি। গবেষণা ও লেখালেখি করেছি। এর মাঝে প্রথমবস্থায় আমি ভেবেছি নায়ক হব, পরিচালক হব। পরে যখন চলচ্চিত্র নিয়ে আমি পড়াশোনা করতে গেলাম সেখানে চলচ্চিত্র নির্মাণে ২৩১টা কৌশল দেখলাম। তাই আমি চলচ্চিত্রকে বোধ, ভাবনায়, মননে রাখলাম। প্রত্যক্ষভাবে নির্মাণের কৌশলের সাথে যুক্ত হলাম না। কেননা এতটা কৌশল একত্রিত করে নির্মাতা হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এটি অনেক ব্যয়বহুলও। তাই আমি লেখক হলাম। কারণ লেখক স্বাধীন। চলচ্চিত্র নির্মাতা স্বাধীন নয়।
সমসাময়িক বাংলা চলচ্চিত্রকে কিভাবে দেখছেন?
সমকালীন বাংলা চলচ্চিত্রের অবস্থা খুবই খারাপ। প্রযুক্তি আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাণকে যেমন সহজ করেছে আবার এর কারণে ইন্ডাস্ট্রির চরম ক্ষতি হয়েছে। বর্তমানে এটি খুবই সংকটের মধ্যে চলছে।
জীবনের ব্যর্থতার কথা বলুন?
আমি জিরো থেকে হীরো হয়েছি। তবে আমি আমার গ্রামে শিক্ষা, চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারিনি। এবং গ্রামকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করার কৌশল তথা কো-অপারেটিভ সিস্টেমে নেবোÑ এটি ক্লাস ফাইভ থেকে ভেবেছি কিন্তু এ তিনটির কোনোটিই আমি করতে পারিনি। এটিই আমার চরম ব্যর্থতা। আবার গ্রামে একটি লাইব্রেরি করেছি কিন্তু সেখানে পাঠক পেলাম না।
সমাজ বিনির্মাণে চলচ্চিত্র কী ভূমিকা রাখে?
চলচ্চিত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ জড় প্রভাবশালী মাধ্যম। এর মাধ্যমে সমাজ গঠন করা যায়। চলচ্চিত্র একটি স্বপ্নের দেশ। সে স্বপ্নের দেশকে যদি আপনি সত্য, সুন্দর, কল্যাণমূলকভাবে তুলে ধরতে পারেন তাহলে হয়তো সেটা ভালো হবে। চলচ্চিত্র দেখে মানুষ নানাভাবে নিজেকে নিয়ে ভাবে। কেউ প্রেমিক ভেবে সূচিত্রা সেনকে পেতে চায়। কেউ উত্তম কুমার হতে চায়। কেউ ভালো পথে যেতে চায়। আবার কেউ জননেতা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, দেশ প্রেমিক হতে চায়। এভাবে চলচ্চিত্র একটা সমাজ নির্মাণ করতে পারে। উদাহরণÑ খান আতার নবাব সিরাউদ্দৌলা ও জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্র বাংলাদেশের ৬০ ও ৭০ দশকের রাজনৈতিক ও গণ আন্দোলনে বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল। মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা ও জনসচেতনতা তৈরি করেছিল। এভাবে চলচ্চিত্র বিভিন্নভাবে সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখে।
কি দায় থেকে চলচ্চিত্র বিষয়ক এত বই লিখলেন?
চলচ্চিত্র একটি শিক্ষামূলক, প্রভাশালী, বিনোদন, গণমাধ্যম, প্রচার, অর্থনৈতিক, সংস্কৃতিক মাধ্যম। এটার মধ্যে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে প্রতি বছর। আবার শত শত ছবি নির্মাণ করা হচ্ছে। এই ইনভলভমেন্ট এটি মানুষকে নতুন স্বপ্ন জন্ম দেয়। আমি কবিতা, গল্প লিখতাম। সেখান থেকে সরে এসে চলচ্চিত্র নিয়ে লিখলাম এবং সত্য, সুন্দর, কল্যাণ এ তিনটি দায় থেকে আমি চলচ্চিত্র নিয়ে লিখেছি। আমার লেখা বই প্রায় ৫০টি। প্রথম বই ‘গল্পগ্রন্থ’ ১৯৮০ সালে বের হয়। চলচ্চিত্র বিষয় গ্রন্থ ২০টি। নজরুলের ওপর ১০টি। ঢাকা বিষয়ক ৫/৬টি। গণমাধ্যম বিষয় ৩/৪টি। আর আমার সংগ্রহে চলচ্চিত্র, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, টেলিভিশন, বেতার এবং সংবাদপত্রের অনেক দুর্লভ নিদর্শন গচ্ছিত আছে।
কোন জীবন বেশি উপভোগ্য লেখক নাকি জাগতিক জীবন?
অবশ্যই লেখক জীবন উপভোগ্য। আগেই বলেছি আমি রক্ত, মাংসে, অস্থি-মজ্জায় একজন লেখক। সারাক্ষণ আমি পড়ি আর লিখি। আমার পরিবার এ ব্যাপারে নানা সহায়তা করেছে। লেখক সত্বার মাধুর্যকে আমি পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করেছি। অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করে, আপনার কি প্রিয়? আমি বলি, আমি বই আর বউ নিয়ে আছি।
নিজের সম্পর্কে যে অভিযোগ মিষ্টি মনে হয়?
কেউ যদি যৌক্তিকভাবে কোনো অভিযোগ করে সেটাকে খুব এনজয় করি। অযৌক্তিভাবে করলে তখন দুঃখ পাই। এ ছাড়া কিছু করার থাকে না।
অভিযোগ আছে বাংলা চলচ্চিত্র অন্য দেশের চলচ্চিত্রকে অনুকরণ করে নির্মিত হয়! এমন কেন হয়?
যারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করে অথবা প্রযোজকদের এ প্রশ্নটা করলে ভালো হত। যেহেতু আমি কোন নির্মাতা নই। তবে আমার যেটা মনে হয়, সৃজনশীলহীনতা বা মেধাহীনতা ও দেশ প্রেমহীনতার পরিচায়ক।
বাংলা চলচ্চিত্রের এখন যে পরিস্থিতি এ থেকে উত্তরণের উপায় কি?
বাংলা চলচ্চিত্র এখন চূড়ান্ত খাদে পড়ে গেছে। প্রযুক্তিভিত্তিক উন্নয়নের কারণে। তথা ইন্টারনেটে ছবি দেখার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে যেমন- মোবাইল, ফেসবুক, ইউটিউব প্রভৃতি। এর ফলে হলে যারা পুঁজি খাটায় সেটা ফেরত আসার কোনো সম্ভাবনা নাই। কেননা মানুষ ভার্চুয়ালে এসব দেখে অভ্যস্ত। মানুষ সিনেমা হলে যায় না। এ দেশে সাড়ে চৌদ্দশ হলের মধ্যে এখন সক্রিয় আছে মাত্র সত্তর থেকে আশিটি সিনেমা হল। সেগুলোও ঠিক মতো চলে না। এ কারণে চলচ্চিত্র মহাসংকটে আছে। তারপরও আমি আশাবাদি এ কারণে যে, সরকার নানাভাবে চাচ্ছে চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরিয়ে আনার জন্য। এ জন্য সরকার অনুদানের পরিমাণ, জাতীয় চলচ্চিত্রে পুরস্কারে অর্থের পরিমাণ বাড়িয়েছে। চলচ্চিত্র সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও গবেষণার জন্য ফিল্ম আর্কাইভ এবং চলচ্চিত্র শিক্ষার জন্য সিনেমা ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছেন।
লেখালেখির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কেমন অবদান রেখেছেন বলে মনে করেন?
চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখালেখির মাধ্যমে আমি চেয়েছি আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে তুলে ধরার জন্য এবং সত্য, সুন্দর, কল্যাণকে স্পর্শ করার জন্য। এগুলির মাধ্যমে বুদ্ধিজীবী সত্তার জাগরণ ঘটাতে চেয়েছি।
চলচ্চিত্র নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা থেকে আপনার অনুভূতি জানতে চাই?
চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করে আমি মোটামুটি তৃপ্ত। তারপরও কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে। যেমন- চলচ্চিত্র পরিচলানার ওপর কোনো গ্রন্থ রচনা করতে পারিনি। আরেকটি ব্যাপার সিনেমা দেখার একটি সংস্কৃতি ছিল সিনেমা হল। সারা বাংলাদেশে জেলা ভিত্তিক পর্যায়ে এটা একটি সংস্কৃতি ছিল। দল বেঁধে ছবি দেখা, বিয়ের সময় ছবি দেখা, ঈদের সময় ছবি দেখা। এসব নির্মল বিনোদনের ছবি দেখার ইতিহাস এবং জেলা ভিত্তিক সিনেমা হলগুলোর ইতিহাস তুলে ধরলে হয়তো ভালো হত।
আপনার দর্শন কি?
যতক্ষণ এই দেহে থাকে নিশ্বাস/ ততক্ষণ সত্য, সুন্দর, কল্যাণকে নিয়ে হবে আমার বসবাস।
এখনো অপূর্ণ যে স্বপ্ন?
আমার গ্রামে কর্মমুখী শিক্ষা, চিকিৎসা, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ না করতে পারাই আমার অপূর্ণ স্বপ্ন।
লেখক জীবনের শেষ ইচ্ছে কি?
সত্য, সুন্দর, কল্যাণের পথে আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা রেখে শেষ পর্যন্ত কলম হাতে রেখেই যেন মরতে পারি।
বারবার কোন বই পড়ার ইচ্ছা এখনো তাড়িত করে?
পথের পাঁচালি, বিষাদ সিন্ধু, অগ্নিবীণা, গীতাঞ্জলি, প্রদেশে প্রাকৃতজন, নক্সী কাঁথার মাঠ, জীবনানন্দের কবিতা সমগ্র।
পাঠকের ভালোবাসা কেমন পান?
পাঠকের ভালোবাসায় আমি অভিভূত। আমি লেখক না হয়ে যদি চাকরিজীবী হতাম তা হলে কে আমাকে স্মরণ রাখত। আজ ফেসবুক, উইকিপিডিয়ার মাধ্যমে আমি জানতে পারছি আমার রিয়েকশনটা। দেশ ছাড়াও আন্তর্জাতিক তথা পিলিফাইন, পাকিস্তান, ল্যাটিন আমেরিকাতে যারা আছে তারা যখন রিয়েকশন জানায় তখন আমার ভালো লাগে। আবার আমেরিকার অনলাইন ভিত্তিক ‘গুডরিজ’-এর জরিপে ‘আমার বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস’ গ্রন্থটি জন্য ‘ফাইভ স্টার’ সেল হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। আবার কেউ কেউ বলে ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের আপনি সোনার খনি’। এছাড়াও অস্ট্রিয়ার ফিল্ম মিউজিয়ামের সদস্য পর্যন্ত আমাকে বানিয়েছে। কলকাতায় ছায়ানটের অনারারি সদস্য বানিয়েছে আমাকে।
এখনো উজ্জীবিত রাখে যে বাণী?
আদর্শলিপির সেই বাণীÑ ‘সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা’।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : মেজবাহ মুকুল

 


আরো সংবাদ



premium cement
ফিলিপাইনে ব্রহ্মস পাঠাল ভারত, ৩৭৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি চীনের মোকাবেলায় নতুন ডিভিশন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে! আবারো চেন্নাইয়ের হার, ম্লান মোস্তাফিজ 'কেএনএফ' সন্ত্রাস : সার্বভৌম নিরাপত্তা সতর্কতা অর্থনীতিতে চুরি : ব্যাংকে ডাকাতি পাকিস্তানে আফগান তালেবান আলেম নিহত যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য না করলে এ বছরই রাশিয়ার কাছে হারতে পারে ইউক্রেন : সিআইএ প্রধান রাশিয়ার সামরিক শিল্পক্ষেত্রে প্রধান যোগানদার চীন : ব্লিংকন ইরাকে সামরিক ঘাঁটিতে 'বিকট বিস্ফোরণ' শেখ হাসিনা সব প্রতিবন্ধকতা উপড়ে ফেলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন: পররাষ্ট্রমন্ত্রী গাজায় ইসরাইলি গণহত্যা বন্ধে বিশ্ববাসীকে সোচ্চার

সকল