২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পায়ের চিহ্ন

-

দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে ট্রেনটা। বহু বছর আগের দেখা পথ। আজ তিরিশ বছর পরে অনেকটাই অচেনা মনে হচ্ছে অনিলা জামানের কাছে। এখন ঊনচল্লিশ ছুঁয়েছে বয়স। অফিসের কাজে রাজশাহীতে যেতে হচ্ছে,একাই যাচ্ছেন।
ট্রেনটা একটা স্টেশন পার হয়ে এলো। চৈত্রের শেষ, ঝলমলে প্রসন্ন আকাশ। একে একে পার হয়ে যাচ্ছে আঁকাবাঁকা মেঠোপথ, হেঁটে যাওয়া নিঃসঙ্গ পথিক, কত শত বৃক্ষ; অর্জুন-শিরীষ-পলাশ-শাল-তমালের দোলানো সবুঝ ছায়া পথ। রোদে ঝিকমিক করা কলমির গন্ধভরা দীঘি। সবুজ দ্বীপের মতো স্বপ্ন মাখা ধানক্ষেত।
ট্রেন সেই চেনা শব্দে এগিয়ে চলেছে। আকাশে উড়ন্ত পাখি খুঁজল অনিলা। নেই। মন পথচলার সেই চেনা গন্ধটা পেতে চাইছে।
মনে হয় এই তো সে দিন মায়ের চাকরির সুবাদে রাজশাহীতে থাকা। সাথে বড় বোন আর ছোট ভাই।
ট্রেনটা গন্তব্যের কাছাকাছি। আকাশে হালকা মেঘদের অলস গতি, নিরুদ্দেশ যাত্রা। একটি-দু’টি অশোক আর পলাশ, রঙের বাচালতা নিয়ে পার হয়ে গেলো।
স্টেশনে নামতেই বুকটা কেমন মুচড়ে উঠল অনিলার। স্টেশনের এই বিশাল স্থাপনা তিরিশ বছর আগের স্মৃতিকে মুছে দিয়েছে। ওই যে সেই গেটটা যেটা ঘুরয়ে ঘুরিয়ে তবে পার হতে হতো।আহারে জীবনকে বুঝি খুব দ্রুতই পার হতে হয়।
অফিসের কাজ শেষ করে পরের দিন সকালে রিকশা নিলো অনিলা। শহরে এত চাঞ্চল্য! যানবাহনের ফাঁক দিয়ে যেন উঁকি দিয়ে রাজপথ দেখতে হয়। এত দোকানপাট, এত বহুতল ভবন, এত মানুষ! ঘোড়ামারার কাছাকাছি আসতেই দেখল সেই শত বছরের পুরনো ধর্মশালা! মন্দিরা বাজছে; হয়তো বিকেলে আগের মতোই কীর্তনের আসর বসবে। পাশেই পিএন গার্লস স্কুল। সেই গাঢ় নীল পোশাকে মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে।
রিকশা এলো ঘোড়ামারায়। কিন্তু কিছুই চিনতে পারছে না অনিলা। রাস্তর ধারে নেই সেই লাল ভবনটি যেখানে ওরা কাটিয়েছে প্রায় সারে চার বছর। রাস্তা থেকে প্রায় পঁচিশ কদম এগিয়ে গেলে হাতের বাঁয়ে সেই বারোয়ারি পুকুরটা? যার দু’ধারে হিজল গাছের সারি। গোলাপি-বেগুনি, হলুদ ফুলেদের উপুর হয়ে কান্না! এই পুকুরটাতেই কতবার সাঁতার শিখতে চেয়েও পারেনি! সেই প্রথম দেখেছিল ডুবসাঁতার, চিৎসাঁতার, অনেকক্ষণ দমবন্ধ করে পানিতে ডুবে থাকা। দেখেছিল নীরার বড়ভাই মন্টুর কাছে। খুব ভালো সাইকেলও চালাতো মন্টু। কয়েকবার ওর সাইকেলে করে অনিলাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। হাত ধরে ক্যারাম খেলা শিখিয়েছিল মন্টুভাই। ডান হাতের বুড়ো আঙুলের পাশে ছোট্ট একটি বাড়তি আঙুল ছিল ওর। হাতটা এমন করে নাড়তো যেন ওই আঙুলটাই ওর বাহাদুরি!
এভাবেই কেটে গেছে তিন চার বছর। নীরা অন্তপ্রাণ অনিলা। বিকেলে দেখা না হলে ভীষণ মন খারাপ হয়ে যেত । কিন্তু মন্টু ভাই কেনো বিকেলটায় বাইরে না গিয়ে ঘরেই বসে থাকতো? অনিলা কি কিছু বুঝেছিল? এগারো পেরিয়ে বারো বছরে পড়েছে তখন, কিছু বুঝে, কিছু না বুঝেই ওই ছয় আঙুলে ছেলেটার জন্য মন কেমন করে জীবনটা মাঝপথ অব্দি চলে এলো।
ঘোড়ামারা বটে, কিন্তু জায়গাটা ঠিক ঠাওর করা যাচ্ছে না। কতজনকে যে জিজ্ঞেস করল। কেউ ‘মিনারুল ভবন’টা ঠিক চিনতে পারল না। সোজা উত্তরÑ
Ñ এখন সব বাড়িতেই হোল্ডিং নম্বর বাইরে লেখা , নম্বর বলুন বের করে দিচ্ছি।
হায়রে অনিলা সেই তিরিশ বছর আগের চোখেই খুঁজছিস!
এবার রিকশা ছেড়ে দিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটছে অনিলা।একজন বৃদ্ধলোক ঠিকানাটা দেখিয়ে দিলেন। দ’ুবার এপথ দিয়ে গেছে চিনতে পারেনি। গেটটা বেশ বড়, রঙকরা, নামের সেই পুরনো ফলকটা এখন বাড়ির ভেতরের পিলারে লাগানো। দাদির নাম এখন আর প্রয়োজন নেই।
কলিং বেলটা টিপতেই একটি আঠারো বিশ বছরের ছেলে দরজা খুলে দিলো।
Ñ কাকে চাই?
Ñ আমি ঢাকা থেকে এসেছি। এটা তো নীরাদের বাড়ি না?
ছেলেটি বাবাকে ডাকল। একজন পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। বাদামি রঙের একটি পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরা। কাঁচা-পাকা গোঁফ।
Ñ আপনি কাকে খুঁজছেন?
Ñ আমি নীরার বন্ধু। প্রায় তিরিশ বছর আগে আমরা রাজশাহীতে এই ঘোড়ামারাতেই থাকতাম। রাস্তার পাশে লাল রঙের একটা বিল্ডিং ছিল...
Ñ আপনি কি অনিলা?
ভদ্রলোক গেটে হাত রাখলেন। অনিলা দেখল তার ডান হাতে ছয়টা আঙুল। অনিলা জবাব দিলোÑ
Ñ জি। আপনি নিশ্চয়ই মন্টু ভাই?
Ñ এসো এসো। নীরার তো বিয়ে হয়েছে ইন্টার মিডিয়েট পাস করার পরই। ও সাতক্ষীরায় থাকে । দুই ছেলে, বড় ছেলের বিয়ে হয়েছে, একটি নাতনী আছে নীরার। অনিলাকে ঘরে নিয়ে যেতে যেতে আবার বললেনÑ
Ñ তুমি হঠাৎ রাজশাহীতে?
Ñ অফিসের কাজে এসেছিলাম, আজই চলে যেতে হবে। একটু সময় পেয়ে শহরটা ঘুরে দেখলাম। সব কিছুই বদলে গেছে!
Ñ এই বেলাটা আমাদের বাসায় থাকো না!
মন্টু ভাইয়ের বলার ভঙ্গিটা ঠিক আগের মতোই। চশমার আড়ালে সেই আগের কৌতূহলী চোখদুটো খুঁজতে চেষ্টা করল অনিলা। লক্ষ করল একটু স্থূলকায় একজন মহিলা লেবুর সরবত আর নাশতা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন। মন্টু পরিচয় করিয়ে দিল আমার ছেলেমেয়েদের মা। সালাম জানিয়ে পরিচিত হলো অনিলা। বেশ হাসি খুশি মহিলা।
Ñ মন্টু ভাই কেমন আছেন আপনারা?
Ñ ভালোই আছি। তোমরা চলে যাওয়ার পরে পুরো ঘোড়ামারাটাই তো ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল!
কথাটাকে হালকাভাবে নিতে অনিলা, তার পর মন্টু উচ্চস্বরে হেসে উঠল।
তুমি কেমন আছো অনিলা? এখনো গান করো? পরিবারে কে কে আছেন তোমার?
অনেকগুলো প্রশ্ন। একে একে উত্তর দিলো অনিলাÑ
Ñ ভালোই তো আছি। আমার একটি মেয়ে একটি ছেলে । মেয়ে এবার বিবিএ শেষ করল, ছেলে লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। ওদের বাবা ব্যবসায়ী মানুষ। মন্টু ভাই গান তো সেভাবে গাইতে পারি না, তবে পারিবারিক আয়োজনে মাঝে মধ্যে গাইতে হয় আরকি!
Ñ এবার উঠতে হবে মন্ট ুভাই।
Ñ এখুনি যাবে। সন্ধ্যেবেলায় তোমার গাড়ি আরেকটু বসো না!
Ñনা আজ থাক। কোনো একদিন যদি আসা হয় তখন অনেক সময় নিয়ে আসবো । আপনারা ঢাকায় যাবেন।
মন্টুর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে অনিলা। মন্টু কিছু বলল না, শুধু মাথা ঝোকালো।
অনিলা ওর অফিসের কার্ডটা বের করে বললÑ
Ñ এখানে আমার ফোন নম্বর আছে, নীরাকে বলবেন ইচ্ছে হলে আমাকে ফোন করতে!
অনিলার সাথে সাথে মন্টু গেটের কাছে এলো।
Ñ ভালো থেকো অনি।
চমকে উঠল অনিলা সেই পুরনো নামে ডাকলেন মন্টু ভাই! ছয় আঙুলের হাতটা বাড়িয়ে গেটটা খুলে দিলেন।
অনিলা আর পেছনে তাকালো না। দ্রুত বের হয়ে এলো। ওর পড়নের লাল পেড়ে নীল শাড়িটার আঁচল গেটের কোনায় লেগে বেশ খনিকটা ছিঁড়ে গেল।
আজ হঠাৎ কেনো যে অনিলার কিশোর মনটা সামনে এসে দাঁড়াল! কেঁদে কেঁদে সেই পুকুরটাকে খুঁজল নীরা আর অনিলার গানের সাথে মন্টুর বাজানো তবলার মিষ্টি সুর যেনো কানের কাছে বেজে উঠল। চোখ মুছলো অনিলা।
রিকশা ধর্মশালার পাশ দিয়ে যাচ্ছে কীর্তনের আওয়াজ শুনছে অনিলা এই একটি বিষয়ের কোনো পরিবর্তন হয়নি! অনিলা বুঝল সময়ের সাথে সাথে বয়সের একটি ধূসরিমা শরীরকে জড়িয়ে ধরে, মনকে নয়। এই ব্যথাভরা বিবর্ণতায় হাহাকার করা যায়; কিন্তু বর্ণ বিরল সময়টাকে বদলে দিয়ে রঙিন করা যায় না। আর মনের রঙ? কেউ তো তা ভেবে দেখে না! আজ রাজশাহীতে না এলে হয়তো এই বাস্তবতাকে বুঝতে আরো অনেকটা সময় লাগত; তা অনিতার মতো অনেকেই হয় তো বুঝতে পারে না।

 


আরো সংবাদ



premium cement
গফরগাঁওয়ে গৃহবধূর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার তীব্র মাত্রায় হিংস্র হয়ে উঠেছে সরকার : মির্জা ফখরুল মিরসরাইয়ে মৃত্যুর ১৫ দিন পর ব্যাংক কর্মকর্তার কবর থেকে লাশ উত্তোলন দেশে দেড় হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং, দুর্ভোগে মানুষ রংপুরে মহানবী সা:-কে নিয়ে কটূক্তি করায় ছাত্রলীগ কর্মী গ্রেফতার বাড়ছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি, অনলাইনে ক্লাস চালুর চিন্তা বিশ্বের অন্যতম স্মার্ট হজ ব্যবস্থাপনা হবে বাংলাদেশে : ধর্মমন্ত্রী সিলেটে ৪৪ লাখ টাকার ভারতীয় চিনিসহ গ্রেফতার ৪ অবৈধ সম্পদ : এস কে সিনহার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন ২৬ জুন টি-টোয়েন্টি র‌্যাংকিংয়ে চাপম্যান-আফ্রিদির উন্নতি থানচিতে ট্রাকে দুর্বৃত্তদের গুলি

সকল