২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

উন্নত জীবনের রূপকার ডা: লুৎফর রহমান

-

‘মানব-চিত্তের তৃপ্তি অর্থ, প্রাধান্য, ক্ষমতা এবং রাজ্য লাভ নয়। আলেকজান্ডার সমস্ত জগৎ জয় করেও শান্তি লাভ করেননি। মানুষ অর্থের পেছনে ছুটছেÑ অপরিশিষ্ট অর্থ দাও তাকে, সে আরো চাবে। তার মনে হয় আরো পেলে সুখী হবে। সমস্ত জগৎ তাকে দাও তবুও সে সুখী হবে না। জাগতিকভাবে যারা অন্ধ, তারাই জীবনের সুখ এভাবে খোঁজে। দরিদ্র যে, সে আমার জীবন ও সুখ স্বাচ্ছন্দ্যকে ঈর্ষা করছে, সে আমার অবস্থার দিকে কত উৎসুক নেত্রে তাকিয়ে থাকেÑ কিন্তু আমি নিজে কত অসুখী। পরম সত্যের সন্ধান যারা পায়নি, মানব হৃদয়ের ধর্ম কী, তা যারা বুঝতে পারেনিÑ তারাই এভাবে জ্বলে পুড়ে মরে, এমনকি এই শ্রেণীর লোক যতই মৃত্যুর পথে অগ্রসর হতে থাকে, ততই তাদের জীবনের জ্বালা বাড়ে। প্রতিহিংসা-বৃত্তি, বিবাদ, অর্থ-লোভ আরো তীব্রভাবে তাদেরকে মত্ত ও মুগ্ধ করে। তখনো তারা যথার্থ কল্যাণের পথ কী, তা অনুভব করতে পারে না। জীবনভরে যেমন করে সুখের সন্ধানে এরা ছুটছে, মৃত্যুর পরও তেমনি তারা সুখের সন্ধান করেÑ পায় না, এরই পথে মানুষ সুখ পাবে না। ক্রোধে তারা চিৎকার করে মানুষকে তারা দংশন করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের দুঃখী, আহত-ব্যথিত মন নিজের দেহ এবং পরের অন্তরকে বিষাক্ত করে। বলতে কী, মানুষ জাগতিক কোনো সাধনার সুখ, আনন্দ এবং তৃপ্তি পাবে না। এই পথ থেকে মানুষকে ফিরতে বলি; সব মহাপুরুষই এই কথা বলেছেন। মানুষ তার জীবনকে অনুভব করতে পারেনি; শয়তান মানুষ চিত্রতে ধর্মের নামে ভ্রমান্ধ করেছে।’
ডা: লুৎফর রহমানের লেখা মানব জীবন গ্রন্থের ‘মানব-চিত্তের তৃপ্তি শীর্ষক শিরোনামের কিছু অংশ উপরে উল্লেখ করেছি। ১৮৮৯ সালে ডা: লুৎফর রহমানের জন্ম মাগুরা জেলার পরণান্দুয়ালী গ্রামে। অতি অল্প বয়সে মাত্র ৪৭ বয়সে তিনি ১৯৩৬ সালের ৩১ মার্চ এই দুনিয়া থেকে পরকালে চলে যান।
১৯১৫ সালে ডা: লুৎফর রহমানের প্রথম এবং শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘প্রকাশ’ নামে ৪০টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের বেশির ভাগ কবিতা তিনি ১৯০৮ থেকে ১৯১৫ সালের মধ্যে লিখেছেন। এই কাব্যগ্রন্থের ‘বাল্য ছবি’ কবিতাটিÑ
মনে হয় সেই দেশে ফিরে আমি যাই, / আবার যে সখাগণে ডাকিয়া শুধাই। / সে কথার ব্যথা হত তরঙ্গ সঞ্চালন, / সে কথার কথা-ভরা বন উপবন, / হাসি-গান মুখরিত সাঁঝের আঁধার, / যাতার সে স্নেহময় শাসন-চিৎকার, / মৌন বনে ভাষাময় মশক সঙ্গীত / বাল্য প্রাণ করে দিত কেমন মথিত! / সুখদ সে মধু দৃশ্য অতীত সুন্দার / লয়ে আসে শত ব্যথা প্রীতি মনোহর। / দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ আগাছায় জোড়া মনে হয় ছিল তাতে কত সুধা পোরা।
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক জীবনে বড়ই দুর্দিন ছিল। সেই দুর্দিনে মুসলিম সমাজ ধর্মের গোড়ামি কুসংস্কার কুশিক্ষা সব কিছুর বেড়াজালে জড়িয়ে শিক্ষা দীক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়ে। ঠিক সেই সময় ১৮৮৯ সালে ১২ ডিসেম্বর বাংলা সাহিত্যে মুসলমানের ত্রাণকর্তা হিসেবে জন্ম নিয়ে ধরায় আসেন ডা: লুৎফর রহমান। তার বাবার নাম সরদার মইনউদ্দিন আহমদ, মা শামসুননাহার। তিনি ছিলেন একজন সু-সাহিত্যিক সম্পাদক ও সমাজকর্মী। কিন্তু ডাক্তার লুৎফর রহমান হিসেবে তার পরিচিতি ছিল সমধিক। তার বাবা একজন স্টেশন মাস্টার ছিলেন। চার ভাই ও এক বোন ছিল। তার বাবা এফএ পাস ছিলেন। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তার বাবার অনুরাগ ছিল। এ কারণেই লুৎফর রহমানের মনে বাবার অনুরাগ প্রতিভাস হয়েছিল।
শৈশবকাল থেকে তিনি ছিলেন একজন ভাবুক প্রকৃতির। বাড়ির কাছে কুমার নদী, ঋতুতে ঋতুতে তার বিচিত্র রূপ দেখে তিনি মোহিত হতেন। চৈত্র-বৈশাখ মাসে নদীতে চর জাগে, ধুধু করে বালচুর। বর্ষায় নদীর ভয়ঙ্কর রূপ তিনি নিজ চোখে দেখেছেন। দেখেছেন নদীর দু’কূল ঘেঁষে সজল-সবুজ ধানক্ষেত, প্রথম শীতে মাঠের সোনালি ফসল। প্রকৃতির এই অপরূপ শোভা বালক লুৎফর রহমানকে সাহিত্যপিয়াসী করে তোলে।
লেখক হওয়ার তীব্র বাসনা তার কিশোর মনকে জীবনের শুরুতে অধিকার করেছিল। তাই সাহিত্য জগতে তার প্রথম আগমন ঘটে ‘বৃহৎ ডন কুইকজোটের অনুবাদ’ গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তা ১৯১৫ সালের আগে।
১৯১৮ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘সরলা’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৯ সালে তার দুটি উপন্যাস ‘পথহারা’ ও ‘রায়হান’ প্রকাশিত হয়। ১৯২৭ সালে তার প্রকাশিত দ্বিতীয় উপন্যাস ‘প্রীতি উপহার’। নারী গৃহলক্ষ্মী পুরুষের প্রেরণার উৎস যাত্রী। পারিবারিক জীবনে নারী গড়ে তোলে সুন্দর শান্তির ভুবন। তাই আদর্শ নারীসমাজ গঠনে ‘প্রীতি উপহার’ উপন্যাস সমাজে এখন, এখনো সমাদৃত। নারীভিত্তিক ‘বাসর উপহার’ ‘প্রতিশোধ’ নামে আরো দুটি উপন্যাস এই সময়ে তিনি রচনা করেন।
শিশু-কিশোরদের নিয়ে লুৎফর রহমান চিন্তা করতেন। তিনি ভাবতেন, শিশু-কিশোর পরবর্তী প্রজন্মের জন্য খুবই জরুরি। তাই তিনি তাদের উদ্দেশে সাহিত্য রচনা করেন। উল্লেøখযোগ্য কয়েকটি মধ্যে ‘ছেলেদের মাহাত্ম্য কথা (১৯২৯), ছেলেদের কারবালা (১৯৩১) ‘রানী হেলেন (১৯৩৫) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মানুষকে উন্নত হওয়ার জন্য, জ্ঞানী হওয়ার জন্য, চরিত্রবান হওয়ার জন্য এর চেয়ে বড় কথা আর কী হতে পারে। তার প্রতিটি প্রবন্ধে এমনিভাবে তির্যক ভাষায়, মধুর মাধুরী মিশিয়ে তিনি পাঠককে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। আজকের সাহিত্যে এসব বাক্য, শব্দ ও উক্তির চর্চা খুব বেশি প্রয়োজন। মানুষ আজ নিজকে হারিয়ে ফেলেছে। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব দিন দিন লোপ পাচ্ছে। ডা: লুৎফর রহমানের সাহিত্যচর্চায় আমাদের বিবেককে জাগ্রত করবে।
লুৎফর রহমান সময়কালে আলোড়ন সৃষ্টিকারী লেখক, কবি, কথাসাহিত্যিক ছিলেন। সমাজের চোখে সমাজের বন্ধ দিকগুলো আয়নার মতো করে তার সাহিত্যের মাধ্যমে তোলে ধরেন। কবিতা, প্রবন্ধে, ছোট গল্পে, উপন্যাসে তিনি তার আদর্শের সৃষ্টির উন্মাদনায় বিভোর ছিলেন।
লুৎফর রহমানের প্রথম ও শেষ কাব্যগ্রন্থ ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধের জন্য তিনি খ্যাতিমান ছিলেন। প্রধান প্রধান প্রবন্ধগ্রন্থের নামÑ উচ্চ জীবন (১৯১৯), মহৎ জীবন (১৯২৬), উন্নত জীবন (১৯২৭), মানব জীবন (১৯২৭), সত্য জীবন (১৯৪০) ধর্ম জীবন (১৯৭১), মহাজীবন (১৯৭৫), যুবক জীবন (১৯৮৫) সালে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসÑ সরলা (১৯১৮), পথহারা (১৯১৯), রায়হান (১৯১৯), প্রতি উপহার (১৯২৭), বাসর উপহার (১৯৩৬) সালে প্রকাশিত হয়। তিনি বেশ কিছু ছোটগল্প লিখেন। তা হচ্ছেÑ পলায়ন, রানী, অহিংসা, রাজপথ, অমাবস্যা, রোমান্টিক বিয়ে, ফিরে যাও ফিরে যা। শিশুদের জন্য লিখেনÑ ছেলেদের মহত্বকথা (১৯২৮), ছেলেদের কারবালাÑ (১৯৩১), রানী হেলেন (১৯৩৪)। অনুবাদ সাহিত্যেও লুৎফর রহমান অবদান রাখেন। তিনি ‘মঙ্গল ভবিষ্যৎ’ ‘দুঃখের রাত্রি (ব্রিকেটার হুগোর লা মিনারেলের অনুবাদ) ও ‘মুসলমান’ বিখ্যাত গ্রন্থসমূহ অনুবাদ করেন।
মানব জীবনকে সুন্দর করার জন্য, নিজের চরিত্রে পরিবর্তন আনার জন্য, সমাজকে সুন্দরতম রূপে গড়ে তোলার জন্য ডা: লুৎফর রহমানের সাহিত্য পাঠ ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই।


আরো সংবাদ



premium cement