২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

শিল্প-সাহিত্যে মানবিক সম্পর্কই গুরুত্বপূর্ণ

-

‘শিল্পের জন্য শিল্প’ এই ধারণা ‘সম্পদের জন্য সম্পদ, বিজ্ঞানের জন্য বিজ্ঞান প্রতারণার জন্য ক্ষমতার মতো; যা সত্যের বিপ্রতীপ। মানুষের সব কর্ম; ন্যায়-নিয়ম, সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান, রাজনীতি, ধর্মসভা, দর্শন, আইন সবই মানুষের প্রয়োজনে। ’শিল্পীমানুষ সরাসরি রাজনীতির মানুষ না ও হতে পারেন কিন্তু তাতে লক্ষ্যের হেরফের হয় না। সমাজের জ্ঞান মাত্রার ওপর শিল্প গুরুত্ব পায়। শিল্পী-কবি-সাহিত্যিকের কাজ সমাজের মানুষের জ্ঞানের পরিধিকে বাড়িয়ে পাঠক তৈরি করা। সাহিত্যের উদ্দেশ্য মানবজীবনের সত্য প্রকাশ, জ্ঞানে কর্মে ভাবে বিকশিত হওয়া। ‘আধুনিকতার দোহাই দিয়ে পাশ্চাত্য যে বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণার বিস্তার ঘটেছিল তার প্রতিও কবিদের মনে প্রচ্ছন্ন অসমর্থন ছিল। অভিজাত পরিবারের সন্তান পুশকিন, গোগোল, তুর্গেনেভ তলস্তয় বা রবীন্দ্রনাথ তাদের সাহিত্যে সামগ্রিক স্বার্থ ঘোষিত হয়েছে বৃহতের দিকে। শিল্পী সাহিত্যিককে বসবাস করতে হয় চলমান সমাজব্যবস্থার খবরদারির মধ্যে তাই তারা অনেক সময় শ্রেণিশত্রুদের তোয়াজ তোষণে নিবদ্ধ করে নিজদের মেধা। অতীতকালে যেটুকু শিল্পচর্চা হয়েছে তাতে জনগণের উপস্থিতি থাকতো প্রভুর গুণকীর্তন, রাজা, সম্রাট, অভিজাতরাই তার চর্চা করাতেন। ব্রিটেনে এখনো রাজকবির প্রচলন আছে। একালেও দরবারি হওয়ার জন্য কতক কবি-সাহিত্যিক শিল্পীর নিরন্তর চেষ্টাও দৃশ্যমান। কাব্য-শিল্প-সাহিত্য মানুষের চেতনার চিরাচরিত বিদ্রোহের চেতন রূপ, সম্পূর্ণ সামাজিক বস্তু বিষয়ের ইমিটেশন যা মনোসংশ্লেষণের অভিজ্ঞতা। স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে নয়, বরং সমাজের একজন হিসেবে কবি শিল্পী সাহিত্যকরা নিরন্তর সংস্কৃতির লড়াইটা অব্যাহত রাখেন।
সব রাজনীতি, সমাজনীতি, জীবননীতি সুস্থ সাবলীল বিকাশ উন্মুখ করে সংস্কৃতি, যা চৈতন্যের অস্তিত্ব স্থিতির সমৃদ্ধি ঘটায় । পারঙ্গমতাও পুরোপুরি নির্ভর করে হ্যাঁ বোধকতার দিকে এবং স্পষ্ট হয়ে ওঠে কিভাবে একজন শিল্পী অবলোকন করেন বস্তুর বাহ্যিকতা তার রূপ এবং ঘটনাপরম্পরা। সমাজ ও তার বিকাশ সংশ্লিষ্টতা। রাজনৈতিক প্রভাব, বিশ্ব পরিস্থিতি, অর্থনীতির সঞ্চালন, শ্রম-শোষণের চিত্রটি একজন পাঠকের আবদ্ধ বোধে আলোক ফেলে। সচেতন হয়েই দেখতে হয় ঘটনার পরম্পরা কারণ বিশে^ কোনো ঘটনাই সাধারণের চোখে যথাযথ দৃশ্যমান হয় না। যা হয় তা হলো একটি ঘটনার পেছনে আর একটি ঘটনাকে ছুড়ে দিয়ে মানুষকে টেম [অবদমিত বা আবিষ্ট] করে রাখা এবং অর্ধসত্যের পেছনে জনশক্তিকে ব্যবহার করা, যাতে মূল ঘটনা আড়ালে থাকে। সত্য অন্য কোথাও, সত্য বিকাশমান এবং প্রচারিত সত্যের পেছনে রয়েছে আরেক সত্যের মতো মিথ্যে যা প্রতারণা।
০২.
কিছু অসচেতন বা মতলববাজ কবি লেখক নানা লোভে দমিত থেকে সমাজের মূল সংবেদনকে আত্মস্থ করতে চায় না। তারা সুবিধাকে ন্যায় জেনে ভাববাদিতার তুফানে নৃত্য করেন; যাতে প্রভু রক্তচক্ষু না দেখায় বরং বাহবা দেয়। ফলে প্রকৃত শিল্প-সাহিত্যের মৌলিক প্রয়োজনীয়তা কেবল তাদের কর্মে উপেক্ষিতই হয় না বরং শাসন শোষণের নিমিত্ত আগ্রাসী শ্রেণীর মুখপত্র হন তারা। ফলে মহৎ সৃষ্টি অনুপস্থিত থেকেই যায়। জনগণকে এবং তার চেতনাকে প্যারালাইজড [আবিষ্ট] করার কাজে প্রত্যক্ষভাবেও তারা সহযোগী। এরা তামাশার মতো সৃষ্টিতে নিপীড়িত জনগণের, শ্রমজীবী মানুষের চরিত্রগুলোর নোংরা, কাছাখোলা, স্থিতিহীন ও অসম্পূর্ণ দিকগুলোর উপস্থাপনের মাধ্যমে মজা তৈরি করেন এবং ঠেসেঠুসে সেক্স ঢুকিয়ে দিয়ে নিজ অবদমিত মনের তৃপ্তি খোঁজেন। আর সময় অতিক্রমণে প্রতিষ্ঠানিক সব সুযোগ তোয়াজ-তোষণ, দুর্নীতির মাধ্যম মেডেল বা সম্মানী লাভ করে আত্মতৃপ্ত হন। প্রকৃত আত্মচেতন মানুষ জানেন তার সৃষ্টি মানুষের চৈতন্যের রূপকাঠামো বদলাবার জন্য, ব্যক্তিগত প্রাপ্তির জন্য নয়। তাই তাদের কিছু জুটবার বা জুটাবার আক্কেল হয় না। বাস্তবে শিল্প সাহিত্যের জন্ম-ইতিহাসটাই প্রয়োজেনের, কেবল মনোরঞ্জনের প্রয়োজনেই আদিম মানবগোষ্ঠী এর উদ্ভব ঘটায়নি, বরং উৎসাহ, উদ্দীপনা, সম্মোহন, সাহস ও প্রয়োগকে জুতসই করার ক্ষেত্রে আবেগকে চিৎকার থেকে বিভাজন করে প্রতীকে, অঙ্কনে, রীতিতে নিবদ্ধ করেছিল এবং নানা কিছুর আরোপের মাধ্যমে অঙ্কন, সুরসঙ্গীত, নাচ, জাদু ও অলৌকিকতা ইত্যাদির সংযোগ ঘটে যার রেশ আজো চলছে। শিল্প-সাহিত্য-কাব্য অন্যের সাথে চলমান অভিজ্ঞতা থেকে আহরিত আবেগের অংশ। এ আবেগের একটা বিষয়গত বাহ্যিক অস্তিত্ব থাকে। বহির্জগৎ আর অন্তর জগতের এক বিস্ময়কর সংশ্লেষণ শিল্প।
০৩.
শিল্পের শাখাগুলো যেমন স্বতন্ত্র কিন্তু প্রতিটি শাখার নান্দনিক রূপটি মূলত কাব্যিক, কারণ মানুষের সব আবেগের প্রকাশ যৌথ নানা স্বরের সংশ্লেষণ একই স্বরে এবং তা ঘোরলাগায়। মানুষের আবেগ মূলত তরলপ্লাবনের মতো উচ্ছ্বল হলেও বস্তু থেকে বিষয় হয়ে সংবেদিত হয় এবং ভাষাভেলায় রূপনির্মাণে বুদ্ধির সাথে যুক্তিতে উপনীত হয়। ভীতি বা বাসনার মতো সচেতন আবেগ-উদ্দীপকগুলো মানুষের সাধারণ অভিজ্ঞতার কারণে দেখা দেয় আর এ ক্ষেত্রে মানুষ আদিমগোষ্ঠীর রীতি-রিস্তা প্রতিকার ভাবনাÑ যা সে এখনো উত্তরাধিকারিত্বে বহন করে চলছে তা সাধারণ বিষয়গুলোতে আরোপিত হয়। আর ধারণার মধ্য দিয়ে যুক্তিকে প্রতিষ্ঠা দেয়। তাই সব সৃষ্টি যৌথ। যেহেতু সমাজের মানুষের নানা কার্যকলাপ থেকেই কাব্যের জন্ম, সেই কারণে সমাজ থেকে কাব্য-শিল্প-সাহিত্যকে আলাদা করা যায় না। এরিস্টটলের মতে, ‘সঞ্চারিত আবেগ একটা সামাজিক উদ্দেশ্য সাধিত করে, বিরেচনের [ক্যাথারসিস] উদ্দেশ্যে এরিস্টটলের এই যুক্তিটি কাব্য-শিল্পে এখনো সচল, তাই কাব্যশিল্পআনন্দ প্রকাশ সব সময়ই কবি শিল্পীর অন্তরসত্তার বিদ্রোহী ভাবের প্রকাশ । এসব নানা স্বার্থ কারণে অধিকাংশ লেখক শিল্পীর মধ্যে অবদমিত থাকে বরং রঙ পায় মোসাহেবী,
দালালি, স্তবস্তুতিতে যাকে হাইডেগার পতিত সত্তা বলে চিহ্নিত করেছেন] তাই সব সময় শিল্প সমাজের পশ্চাৎপদতা, সা¤্রাজ্যবাদের নির্ভরযোগ্য সামন্তীয় শোষণ, হিতহীন উন্নয়ন, অন্যায় শাসন, স্বাধীনতা হীনতা এবং নিগ্রহের বিরুদ্ধে কথা বলে। এই প্রকাশ কখনও সরল কখন দুর্বোধ্য, দুরূহ ও জটিল হতে শিল্পীর সামাজিক বিচ্ছিন্নতার কারণে। আবার দুর্বোধ্য হয়ে ওঠার কারণ শিল্পীর নিরাপত্তাহীনতা, বলার কণ্ঠের উপর তৃতীয় শক্তির রক্তচক্ষু। তাই কখনও কখনও শিল্পী সাহিত্যিককে আড়াল ব্যবহার করতে হয়। শিল্প সে অঙ্কন বা নির্মাণ যা-ই হোক সবই এই সমাজের, আর সববিষয়গুলোরই সামাজিক পরিচয় আছে। উপাদনগুলো নিছক কোলাহল নয়, একটা শব্দভাণ্ডার থেকে নেয়া শব্দ, কেবল ধ্বনিমাত্র নয় সামাজিকভাবে স্বীকৃত স্বরগ্রাম থেকে নেয়া স্বর। সকল রং ও একটা নির্দিষ্ট অর্থকে দ্যোতিত করে; শিল্পী তা স্বীকার করুন বা না করুন। যদি তিনি সচেতন হয়ে রং-তুলির আঁচড় কাটেন তা যেমন আরও নিখুঁত যথাযথ এবং অর্থকে স্পষ্ট করবে, তেমনি তা সামাজিক দায়িত্বকেও স্পর্শ করবে। অন্তর সত্য নানা মুখের নানা ফলায় জনগণমনে বিভাষিত হয়ে নানা বিপ্রতীপ থেকে একই অর্থকে দ্যোতিত করবে।
০৪.
মহামতি এঙ্গলস উল্লেখ করেছেন ‘মানুষের দুটি হাত শুধু তার শ্রমের জন্য প্রয়োজনীয় অঙ্গমাত্র নয়, দীর্ঘদিনের শ্রমেরও ফসল। প্রকৃতি ও সমাজের রূপ বদল করেছে মানুষ এই হাত দিয়ে এবং পরিবেশের বাস্তবতা থেকে মুক্ত হয়েছে এই দুটি হাত দিয়েই’ [সংক্ষেপিত]। শিল্প-সাহিত্যের জন্মের ইতিহাস পর্যালোচনায় তাই সচেতনরা মানব বিকাশের ইতিহাস গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ করেন। ..’ মানুষ শুধু অতীত ও ভাবীকালের যোগসূত্র নয়, বর্তমান তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাল। যদিও তার কার্যাবলী অতীতের ফল, যে অতীতের সে অনিবার্য সন্তান, কিন্তু চলমানতায় সে নবীন হয়ে ওঠে তার বর্তমান কর্ম থেকে। সমাজ জীবনে অন্তরীত হওয়ার মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনধারার পরিবর্তন ঘটে এবং শুরু হয় তার ভেতরের লীলা। চৈতন্য জগতের ক্রমপরিবর্তন ও সৃজনমুখরতা তাকে প্রাণিজগৎ থেকে আলাদা করে ফেলে। ধীরে ধীরে সমাজ বিকাশের পর্যায়গুলোতে উদ্ভব ঘটে শ্রেণির। যারা শক্তিমান, অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিদীপ্ত সাহসী তারা পুরো গোষ্ঠীকে তাদের অধীন করে ফেলে এবং বহু মানুষ কিছু মানুষের অধীন হয়ে পড়ে। এভাবেই পরবর্তী সমাজগুলোতে শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। সমাজের শক্তি ক্রমশই কেন্দ্রীভূত হতে থাকে মুষ্টিমেয়ের হাতে, তাই অধিকাংশ মানুষই হারিয়ে বসে পূর্ববর্তীদের কষ্টার্জিত সম্পদের অধিকার।
০৫.
শিল্প-সাহিত্য মূলত ¯্রষ্টার স্বাধীন সত্তার প্রকাশ এবং সামাজিক চৈতন্যের একটি রূপ। বাস্তবে মানুষের সামাজিক রাজনৈতিক এবং উৎপাদন সম্পর্ক বিনিময় বণ্টন ইত্যাদির মধ্যেই মানব জীবনের অস্তিত্ব। উৎপাদন সঙ্কটেই বদলে যায় ধর্মবিশ^াস, বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্য সে সবের মধ্যে মানুষের সামাজিক সম্পর্ক ধরা পড়ে । অর্থাৎ বস্তুর উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে মানুষের অস্তিত্ব, চিন্তা,কর্ম যুক্ত থাকে। শিল্প সাহিত্যে তার প্রভাব সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই আমরা দেখি যারা ‘শিল্প শিল্পের জন্য’ এই তত্ত্ব ফেরি করেন তারা আদি থেকে আজতক সেই শ্রেণির স্বার্থকেই সমুন্নত করেন যারা সংখ্যায় মাত্র কতিপয়; বিপুল মানুষের স্বার্থকে লুট করে প্রতারিত করছেন। পাশাপাশি সেই সব কবি শিল্পী সাহিত্যিকদেরও অবস্থানও রয়েছে যারা মানবতাবাদী।
০৬.
সামাজিক চৈতন্যের ক্ষেত্র অত্যন্ত ব্যাপক। রাজনৈতিক চেতনা, ন্যায়বিচার আইন নীতিজ্ঞান বিজ্ঞান সাহিত্য দর্শন ধর্ম, সবই এর অন্তর্গত আর প্রত্যেকের সঙ্গে দ্বন্দ্বমূলক ঐক্য সম্পর্কে বিরাজমান। শিল্পের মাধ্যমে মানুষ জানে নিজেদের অস্তিত্ব, জীবন প্রণালী, পরিবেশ প্রতিবেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং সামাজিক দ্বন্দ্বের স্বরূপ। এই ভাবে প্রতিকালেই প্রকৃত চেতনা সম্পন্ন শিল্পী-কবি-সাহিত্যিকরা তাদের সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের ভেতরকার বিদ্রোহকেই প্রাধান্য দিয়েছেন, যা চেতন ও চৈতন্যের স্পষ্টতর রূপ। আর এসব থেকেই সাহিত্য শিল্প হয়ে উঠেছে প্রতিবাদী। মূলত সা¤্রাজ্যবাদী শোষণ শাসনের প্রণীত পরিকল্পনা, প্রকৃত সাহিত্য শিল্প তার প্রকাশ তার বিরুদ্ধেই সোচ্চার থেকেছে। কখনও কখনও লেখক শিল্পীরা প্রাণ দিয়েছেন ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। শুধুমাত্র প্রকৃতি দেহজ কামনা বাসনার প্রেম কড়চা, রহস্যময়তা, নষ্টামি ভণ্ডামি ইত্যদি রূপায়ণ সচেতন শিল্প-সাহিত্য নয়।’ শিল্প-সাহিত্য মানুষের সম্পদ, তার বিকাশ-বিস্তার ও নির্মাণে প্রকৃত অর্থে মানুষের দুঃখ কষ্ট লাঘবের লড়াইকেই উৎসাহ আকারে, বিস্তার আকারে, উদ্দীপনা আকারে চিত্রিত করে ন্যায়ের স্বার্থে। শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠায় মানুষের সম্পর্কগুলোকে মানবিক করে তোলাই গুরুত্বপূর্ণ।
০৭.
শিল্প-সাহিত্যের প্রেরণা কোন দৈব অনুগ্রহ নয়, বরং সামাজিক সম্পর্ক ও সংঘর্ষের সংবেদ। সামাজিক অবস্থা, অবস্থান, বস্তু ও বিকাশ থেকে লেখক কবি শিল্পীগণ অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠেন এবং নিজ আত্মার প্রশ্নকে রূপদানের মধ্য দিয়ে এক সত্য কাঠামো গড়ে তুলতে ব্রতী হন। যেখানে শিল্পীর সঙ্গে সম্পর্ক সমাজের সঙ্গে এবং সামাজিক জীবন; সে ক্ষেত্রে শিল্প-সাহিত্যে এই সম্পর্কের প্রতিফলন ঘটবে এটাই প্রত্যাশিত। বাস্তবে শিল্প সাহিত্য মিথ্যেকে রূপায়িত করলেও সেই মিথ্যে উপস্থাপনার ভঙ্গিটা থেকে যাবে সত্যকে পরিচিতি দেয়ার জন্য। শিল্পী সাধারণের মধ্যের একজন হয়ে নিজ স্বাতন্ত্র্যে স্বতন্ত্র। সলোকভের ভাষায় ‘শিল্পী কবি সাহিত্যিকের কাজ হলো পাঠকের কাছে সত্যকে প্রতিষ্ঠা দেয়া, চিনিয়ে দেয়া তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। মানুষের হৃদয়ের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আস্থা জোরদার করা এবং মানুষকে তার ভবিষ্যৎ গঠনে বিশ^াসী করে তোলা। ক্যামু শিল্পে জগতে সৃষ্টির কারণরূপে খুঁজে পেয়েছিলেন বিদ্রোহকে। তিনি বলেছেন শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে সৃষ্টি ব্যাপারটাই বিদ্রোহাত্মক। ক্যামু অতিরিক্ত রূপানুরাগ ও বাস্তবতার নন্দতত্ত্ব দুই বর্জন করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। ক্যামুর বর্ণনামতে হ্যাঁ-তে ও না-তে পৌঁছে একজন শিল্পমানুষ হয়ে ওঠেন যথার্থ বিদ্রোহী। পশ্চিমী দুনিয়ায় সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে যে ধরনের বিপ্লব ঘটেছিল তার শক্তি ও নেতৃত্ব ছিল বুর্জোয়াদের হাতে। ফলে তার প্রতিফলনও ঘটেছে শিল্পী-সাহিত্যিকের মনোজগৎ আন্দোলিত হওয়ার কারণে। মূলত তার যাত্রা ছিল ধনবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার দিকে। লক্ষণীয় :
ক- সমাজের অবস্থা অবস্থান প্রকৃত শিল্পীর শিল্প-সাহিত্যের কাঠামো শিল্পরূপে ধরা পড়ে এবং প্রভাব বিস্তার করে।
খ- সামন্তীয় সমাজের শিল্পের রূপ ঔপনিবেশিক সমাজে শিল্পের রূপ ও উত্তর উপনিবেশ সমাজের শিল্পের রূপটির পার্থক্যটা শিল্পী-লেখকে স্মরণে রাখতে হয়।
০৮.
শিল্প-সাহিত্যের এই তাত্ত্বিক রূপটি সবসময়ই বিদ্রোহাত্মক, সকল অন্যায় শোষণ ও শাসন, সামন্তবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদ এবং আধিপত্যবাদ বিরোধী। এই বিরোধিতা নান্দনিক সূত্রাবলির সঙ্গী এবং এরই প্রেরণায় হেগেলীয় নন্দনতত্ত্বকে উপেক্ষা করে প্রয়োজনীয় ও উদ্দেশ্যমূলকতায় উচ্চারিত হচ্ছে আজ। আমাদের সমাজে উপনিবেশ বিরোধিতা শিল্প-সাহিত্য বিশেষ মর্যাদায় আজও গৌরব কুড়ায় এবং মানুষকে প্রেরণা দেয়। কেবলমাত্র জাতীয় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতির বিপ্লব সংঘটিত হলে সামগ্রিক চেতনাজগতে আলোড়ন তোলে এবং একটি জাতিকে সুস্থ ধারার রাজনৈতিক পরিবেশে পুনরস্থাপিত করে। জনগণের সংস্কৃতি সর্বদাই সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ, সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী এবং এর পৃষ্ঠপোষকতা, চর্চা একটা সামগ্রিক রাজনৈতিক বিষয়। সে বিষয়টি তখনই পুরোপুরিভাবে সফল হতে পারে যখন রাষ্ট্রক্ষমতা সাধারণের প্রতিনিধিদের হাতে থাকে। মোটেও বর্তমানের মতো নয়।


আরো সংবাদ



premium cement