২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দাগ রেখে যাই

-

৪.

পাকিস্তানের সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান প্রায় ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি মৌলিক গণতন্ত্র নামে রাজনীতিতে এক নতুন বিষয় চালু করলেন। এ সময়ে ইউনিয়নে মেম্বার নির্বাচন হতো। মেম্বারদের ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতো। এসব চেয়ারম্যানের ইউপি প্রেসিডেন্ট বলা হতো। আমার পিতা যদুনন্দী ইউপির প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এরপর তিনি আর গ্রাম্য নির্বাচন করেননি তবে কিং মেকার হিসাবে এলাকার রওশন মুনশি, বর্তমান চেয়ারম্যান খায়ের মুনশির বাবাকে তিনবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত করার ভূমিকা পালন করেছেন। এলাকার জয়নাল আবেদীন সাহেব বেশ কয়েকবার চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। তাকেও একবার সহায়তা করেছিলেন। আব্বা আইয়ুব খানের রাজনীতির প্রতি বীতশ্রুদ্ধ হয়ে রাজনীতি থেকে দূরে সরে আসেন। পাকিস্তানে একবার ফাতেমা জিন্নাহ ও আইয়ুব খানের সাথে সরাসরি ভোট যুদ্ধ হয়। এ সময়ে আব্বাকে ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে জোর তৎপরতা চালাতে দেখেছি। জাতীয় সংসদের বিভিন্ন নির্বাচনকালে আমাদের গ্রামের বাড়িতে জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন গুণীব্যক্তিত্ব আব্বার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া, কে এম ওবায়দুর রহমান, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, অধ্যাপক সাইয়েদ মোহাম্মদ আলী, বিষু মিয়া প্রমুখ। আমার ছোটবেলায় এদের সবাইকে আমাদের বাড়িতে অনেকবার বেড়াতে দেখেছি। ৭০-এর নির্বাচনকালে আমি ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। আমাদের কাচারি ঘরের ভেতরে আব্বার সাথে এসব নামীদামি লোকদের মিটিং হলেও কেন যেন আমার প্রবেশাধিকার হতো। আমি নিবিড়ভাবে তাদের কথা শুনতাম, বিশেষত তাদের আপ্যায়নের কালে বাড়ির খাদ্য পরিবেশনাকারীদের সাথে আমার সহজ অনুপ্রবেশ ঘটে যেত।
আব্বা তার বাবা-মা হারিয়ে যখন নিরেট এতিম হয়ে গেলেন, তখন একান্ত কাছে থেকে তাকে দেখাশোনা করেছেন খালেক চাচা। আবদুল খালেক আব্বার আপন চাচাতো ভাই ছিলেন। তিনি বয়সে আব্বার অনেক বড়। তিনি বিয়ে করেছিলেন। তার স্ত্রী আব্বাকে পুত্রের মতো আদরযতœ করতেন। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তদুপরি আব্বাকে ছোট ভাইয়ের স্নেহে লালন-পালন করতেন দীঘি মহল্লার এক মমতাময়ী বিদুষী নারী। তিনি প্রখ্যাত আলেম মাওলানা শামসুল হক সাহেবের মাতা। আব্বার ভাবী সাহেবা দয়ালু হলেও দাপটে ও দারুণ রাগী মহিলা ছিলেন। তিনি ছিলেন দুধে-আলতা রঙের দীর্ঘাঙ্গি সুন্দরী নারী। তার ডাকনাম ছিল বোচা। আামাদের এক চাচী তাকে বোচা বুজি বলতেন। আমি ভাবতাম এত সুন্দরী টিকালো নাকের মহিলা যদি বোঁচা হয় তবে সত্যিকারের নাক বোচা মেয়েরা কোথায় লুকাবে? পাড়াপড়শী নারীরা অবশ্য তাকে দোতালার দাদীজান বলে সম্বোধন করত। কারণ আমার চাচার দোতলা বড় ঘর ছিল বলেই হয়তো এমন নামবিশেষণ হয়েছিল তার। আমার আব্বা একটু বড় হলে নগরকান্দা স্কুলে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন। পরবর্তীতে ফরিদপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। একমাত্র মেধাবী ছাত্ররা এই স্কুলে পড়ালেখার সুযোগ পেত তখন। আমার বাবা স্কুলের হোস্টেলে থাকতেন। শহরের উপকণ্ঠে আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় থেকে লেখাপড়া করতে পছন্দ করতেন না। লেখাপড়ার ব্যয়ভার জমির ফসলের মাধ্যমে প্রাপ্ত টাকা পয়সা এবং মহল্লার প্রজাদের প্রদেয় খাজনার টাকায় মিটে যেত। আব্বার খালেক ভাই গ্রামের বাড়িতে থেকে এসবের ব্যবস্থা করতেন। ছাত্র জীবনে হোস্টেলে থেকেই তিনি দামি পোশাক পরতেন। আব্বার সহপাঠীরা তার দামি পোশাক আশাক ও রাজকীয় চালচলনে বিস্ময় প্রকাশ করত। অনেকে আব্বাকে বন্ধু হিসেবে পেতে আগ্রহী হতেন। ফরিদপুর শহরের এলিট শ্রেণীর ছেলে-পেলেরা সহজেই আব্বার ঘনিষ্ঠ হয়ে যেত। আব্বার সহপাঠীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেনÑ হুমায়ুন কবির ও নুরুমিয়া খোন্দকার। কবি জসিমউদ্দীন আব্বার বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন। হুমায়ুন কবির ১৯০৩ সালের কাছাকাছি সময়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় অর্থাৎ আজকের দিনের এসএসসিতে বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। আব্বা প্রথম শ্রেণীতে ডিস্টিংশন মার্ক নিয়ে বোর্ড থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। হুমায়ুন কবির বিখ্যাত কবি ছিলেন। তিনি পরবর্তী কালে কলকাতার মেয়র হয়েছিলেন। নুরুল হক খোন্দকার বা নুরু মিয়া চাচা দীর্ঘকাল ফরিদপুরের উপকণ্ঠে কৈজুরী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। ফরিদপুর জেলা শহরের প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি আব্বার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তিনি স্বনামধন্য মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খোন্দকার মোশাররফ হোসেনের বাবা। খোন্দকার মোশাররফ হোসেন সাহেবের ছোট ভাই বাবর সাহেব আহসান উল্লাহ ওরফে হালিম ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। হালিম ভাই এখন আমেরিকা প্রবাসী। তিনি সেখানে প্রায় ৩০ বছর ধরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। আব্বা মাঝে মধ্যে নানাবাড়ি ফুলসূতি চৌধুরী বাড়ি যেতেন। ফাজেল চৌধুরী আব্বার নানা। আবদুল আলেম চৌধুরী আব্বার আপন মামাতো ভাই। আমার চাচার ছয় ছেলে ও চার মেয়ে। সাহেব চৌধুরী, হানু চৌধুরী, ইউসুফ আলী চৌধুরী, পিরু চৌধুরী, জুয়েল চৌধুরী ওরফে সাইফুজ্জামান চৌধুরী, আলীমুজ্জামান চৌধুরী ওরফে জনু চৌধুরী। এর মধ্যে ইউসুফ আলী চৌধুরীর সাথে আমার পিঠের ছোট বোন হামিদাকে বিয়ে দিয়ে আমার বাবার মাতৃকুলের সাথে সম্পর্ক আরো গভীর করার প্রয়াস চালানো হয়। সাইফুজ্জামান ওরফে জুয়েল চৌধুরী আমার চাচাতো ভাই থেকে আরো নিকটে ভায়রা ভাই হয়ে যায়। আমার শ্যালিকা রোমাকে সে আগেই বিয়ে করে। রীতা অর্থাৎ আমার শ্যালিকা রুমার বড় বোন ঘটনাচক্রে আমার স্ত্রী হয়ে যায়। এ জন্য অবশ্য রানী ভাবী বা হানু ভাইয়ের স্ত্রী অর্থাৎ আমার বোন হামিদার জা-এর ভূমিকা প্রবল ছিল।
আমি কবি মানুষ প্রেম সুদূরে বুঝলেও বিবাহকে দারুণ ভয় পেতাম। যা হোক ভাগ্যের লিখন আর কে খণ্ডায়! আলেম চাচাকে যাতে না ভুলে যাই, যেন আব্বার মায়ের বাবা বাড়িকে যাতে আমরা বিস্মৃত না হই, যে দাদুবুজি আমার বাবার জন্য নিজের জান কোরবানি করেছেন তাদেরকে পরম মমতায় তিন তরফের আত্মীয় বন্ধনে সুদৃঢ় করেছি। আমার চাচাতো ভাই জুয়েল শুধু ভাই-ই নয় বরং বিয়াই উপরন্তু ভায়রা ভাই। সে খুব যোগ্য, করিৎকর্মা এবং আমাদের এলাকার এক্স সাংসদ। আওয়ামী লীগের একজন ভালো নেতা। আলেম চৌধুরী চাচার আপন ভাই কালা চৌধুরী। তার এক পুত্র রবু চৌধুরী। আমার এই চাচার স্ত্রী অর্থাৎ রবুর আম্মা আব্বার সম্পর্কে ভাগনী হতেন। এই চাচীর মাতৃকুল আমার আব্বার আত্মীয়। রবুর আম্মা আমার চাচিআম্মা আমার বাবার চাচাতো বোনের মেয়ে। আমার এই চাচিআম্মা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। আব্বা হয়তো তার মামাতো ভাইদের পরামর্শে কলকাতা চলে যান উচ্চশিক্ষার জন্য। কলকাতা শহরে আব্বার আরেক ধনাঢ্য মামাতো ভাই ছিলেন। তিনি ফুলসূতি থেকে সেখানে গিয়েছিলেন। আব্বার এই মামাতো ভাইয়ের সাতটি সুরম্য দালান বাড়ি ছিল কলকাতা শহরে। আমাদের এই চাচা কলকাতার সাতটি নৌবন্দরের ঠিকাদারি ব্যবসা করতেন। আব্বা প্রথমে তার এই ভাইয়ের বাড়িতে থেকে ইসলামিয়া কলেজে পড়াশোনা শুরু করেন। আব্বা ছিলেন স্বাধীনচেতা উন্নত মেজাজের মানুষ। আস্তে আস্তে আব্বা তার মামাতো ভাইবোনের হাল্কা আচরণ বুঝতে পারেন তাই কলকাতা ছেড়ে ঢাকা চলে আসেন। এরপর তিনি ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। [চলবে]

 

 


আরো সংবাদ



premium cement