২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কথাসাহিত্য লোকজ উপাদান ও লালসালু

-


সাধারণত; ‘লোক’ বলতে নিরক্ষর অমার্জিত এবং পিছিয়ে পড়া মানুষদের উল্লেখ করা হয়ে থাকে। এক সময় গ্রামের কৃষি বা চাষি সমাজকে ‘লোক’ বলে চিহ্নিত করা হতো। এদের জীবনাচরণে শহর বা নগরের মার্জিত মানুষদের সঙ্গে অনেক পার্থক্য ছিল। বোধকরি এখান থেকে ‘লোক এবং ভদ্রলোক’ শব্দ দুটি কখনো কোনো কালে সমাজজীবনে চলে এসেছে। অবশ্য বর্তমানে ‘লোক’ শব্দটির আরো ব্যাপক প্রয়োগ দেখা দিচ্ছে। গ্রামে কিংবা শহর নগরে একশ্রেণীর মানুষ যাদের একই ভাবনা-চেতনা এবং নিজেদের মধ্যেই কেবল ব্যবহারের জন্য এক ধরনের ভাষা এবং চাল-চলন রপ্ত করেছে তাদেরও ‘লোক’ নামে অভিহিত করা হয়।
যা হোক, আমাদের চিরাচরিত সমাজে এতদিন যারা ‘লোক’ বলে পরিচিত হয়ে এসেছে, তারা যে কেবল গ্রামেই বসবাস করে তা নয়, শহর-নগরেও তাদের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এরা কখনো বস্তিতে বা অব্যবহৃত খালি মাঠ ইত্যাদিতে বসবাস করে। এসব ভাসমান শ্রেণীর মধ্যে ‘বেদে’ বলেও একটি শ্রেণী আছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এরা ছিটিয়ে ছড়িয়ে আছে। তবে এরা সাধারণত নদ-নদী, খালে-বিলে নৌকাতে বসবাস করে। বর্তমানে ‘আদিবাসী’দের জীবনাচরণও ‘লোকজ’ ভাবনার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। অনেক কথাসাহিত্যিক, বেদে, আদিবাসীদের তাদের গল্পে, উপন্যাসে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এদের ভাষাও লোকভাষা হিসেবে গণ্য।
আমাদের কথাসাহিত্যিকরা নানাভাবে এসব উপাদান চমৎকারভাবে ব্যবহার করে আমাদের গল্প-উপন্যাসকে সমৃদ্ধ করেছেন। বাংলা ছোটগল্প-উপন্যাসে দু’বাংলা সাহিত্যকরা এ সবের ব্যবহার করেছেন। চমৎকার নৈপুণ্যে লোকজ ভাবনা ও ভাষা পশ্চিম বাংলায় তারাশঙ্করের গল্প-উপন্যাসে আদিবাসী জীবনের লোকজীবন অপূর্ব মাধুর্যে প্রকাশ পেয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে চাই, ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ গ্রামের মুখে মুখে ঘুরে ফেরা গল্প-কাহিনী আমাদের প্রথম লোকজ ভাবনা সংবলিত কথাসাহিত্য।
আমার এই আলোচনায় সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ বিরচিত উপন্যাসসমূহের বিষয়বস্তু এবং লোকজ উপাদান অন্তর্ভুক্ত। ‘লালসালু’ উপন্যাস এ সবের অন্যতম। ‘সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ’র উপন্যাসের পট-চিত্র গ্রামবাংলা। গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ নিতান্ত সহজ সরল। নিরক্ষরতার কারণে ধর্মে অন্ধবিশ্বাস। গ্রামে চালাক চতুর স্বার্থান্বেষী এবং কূটবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষও বসবাস করে। এরা গ্রামের সাধারণ মানুষকে ধর্মের নানা কথা আউড়িয়ে তাদের বোকা বানিয়ে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করে দিনের পর দিন। কোনো এক সময় সুফি ফকিরদের আগমন ঘটেছিল গ্রামে কিংবা সে অঞ্চলের কোন স্থানে। সুফি ফকিরদের নানা অলৌকিক ক্রিয়াকাণ্ডে, সত্য-মিথ্যা যাই থাকুক না কেন, লোকমুখে এখান থেকে সেখানে প্রচার হয়ে বেড়ায়। সাধারণ মানুষের ধারণা এরা আল্লাহর প্রিয় পাত্র। সুতরাং তারা অনেক ক্ষমতা রাখে। এরা আদৌ এমন সুফি কি না গ্রামের মানুষ তা জানা বুঝবার অবকাশ পায় না। গ্রামবাংলায় সুফি ফকিরদের এমন অবস্থান যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে। বস্তুত, নকল ফকিরের সংখ্যাই গ্রামগঞ্জে বিস্তর। এমনি পরিমণ্ডলে সৈয়দ ওয়ারিউল্লাহর ‘লালসালু’ উপন্যাসটি রচিত।
বলেছি, ধূর্ত এবং কূটচালবাজ মানুষের অভাব নেই। এরা সংখ্যায় অল্প হলেও তাদের কর্মকাণ্ড অন্যদের সহযোগিতায় গোটা সমাজে ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। এমন একজন ধূর্ত, চালবাজ যে কেবল অপরকে ধোঁকাবাজির মাধ্যমে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করেছে তার নাম মজিদ। তার সাথে যুক্ত হয়েছে গ্রামের আরো কয়েকজন ধূর্ত মানুষ। নিরক্ষরতার কারণে গ্রামের মানুষ কুসংস্কারাচ্ছন্ন। লোকমুখে নানা কথা তারা সহজেই বিশ্বাস করে। এই সুযোগে মজিদ গ্রামের বনজঙ্গলে ঢাকা একটা পুরোন কবরকে লালসালু দিয়ে ঢেকে পীরের মাজার হিসেবে গ্রামের মানুষের মধ্যে প্রচার করে। মজিদ চারদিকে বেড়ানো ফকিরদের জীবনের সঙ্গে পরিচিত। গ্রামে এ সবের জন্য শক্তিশালী সাক্ষীর প্রয়োজন হয়। ইতোমধ্যে তার কিছু কর্মকাণ্ড অলৌকিক এমন কিছু কথা সাধারণ মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে। এই সঙ্গে যুক্ত হয় খালেক বেপারি নামে একজন জমিদার। মজিদ এ গ্রামে বহিরাগত। পীরের মাজারের ভক্তি নেয়ার জন্য নারী-পুরুষের ভিড়। মজিদ অবিবাহিত। এর মধ্যে তার চোখ পড়ে সুন্দরী এবং সহজ সরল রহিমার প্রতি। মজিদের সান্নিধ্যে আসার জন্য অনেক পরিবার উন্মুখ। যুবক মজিদের সঙ্গে রহিমার বিয়ে হয়। মজিদ এক নারীতে সন্তুষ্ট নয়। সুতরাং নানা ছলচাতুরী করে জমিলা নামে একটি কম বয়সীকে সে বিয়ে করে রহিমা বন্ধ্যা বলে।
মজিদের ধূর্তামি গ্রামের শিক্ষিত যুবকের মনে সন্দেহ আনে। মজিদ তা বুঝে গ্রামের স্কুল নির্মাণে আক্কাস আলীর উদ্যোগকে নস্যাৎ করে। খালেক ব্যাপারীর সহযোগিতা থাকায় তার এই ধর্মব্যবসা জমে ওঠে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ একজন শক্তিশালী গল্প লেখক। লালসালু উপন্যাসের পাশাপাশি ‘চাঁদের অমাবশ্যা’ এবং ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ নামে আরো উপন্যাস রয়েছে। ওয়ালীউল্লাহ শিক্ষিত এবং পাশ্চাত্য সাহিত্য পড়–য়া মানুষ। তার উপন্যাসে গ্রামের জীবন শরৎচন্দ্রের মতো ফুটে ওঠেনি। শরৎচন্দ্রের কোনো নায়কের মতো মজিদ’কেও তিনি তৈরি করেননি। গল্পের জন্য গল্প বলা তাঁর উদ্দেশ্য নয়। অবশ্য তিনি তাঁর এই ভাবনাকে চরিত্র চিত্রণের মাধ্যমে তা সহজে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর উপন্যাসে লোকজীবন প্রাধান্য পেয়েছে। লোকভাষা ইত্যাদিও ব্যবহৃত হয়েছে কৌশলে। তিনি পেশায় এক সময় সাংবাদিক ছিলেন। দেশের বাইরে তাঁর জীবন কেটেছে। কিন্তু তাঁর স্মৃতিতে গ্রামীণ জীবন এবং গ্রামে বসবাসকারী সাধারণ সহজ সরল মানুষ কিভাবে এক শ্রেণীর ধর্ম ব্যবসায়ীদের হাতে প্রতিনিয়ত নিষ্পেষিত হচ্ছে, এটাকে তুলে ধরার একটা প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। গ্রামের মূল্যবোধের বিপর্যয়, মানসিক স্খলন-পতন এবং সর্বোপরি মজিদ এবং খালেক ব্যাপারীর মতো মানুষেরা নির্বিবাদে অসহায় মানুষের সারল্য এবং কুসংস্কারকে সম্বল করে জীবননির্বাহ করেছে তার একটি চমৎকার চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন। গ্রন্থে তাঁর বাক্য নির্মাণ এবং প্রয়োগে তাঁর সাংবাদিকতার প্রভাবও লক্ষ করা যায়।
উপন্যাসে ওয়ালীউল্লাহ কুমিল্লা-নোয়াখালীর ভাষা ব্যবহার করেছেন। এতদঞ্চলে মুসলমান সম্প্রদায় বাল্যকাল থেকে না বুঝে কোরআন শেখে আরবি ভাষায়। নবী আরবে জন্মগ্রহণ করেছেন; তাই না বুঝে শুনে এরা আরবি ভাষায় অভ্যস্ত। এরা গ্রামেই থেকেছে। গ্রামই তাদের জীবন এবং ধর্মের সঙ্গে যুক্ত। মজিদ এই গ্রামের মানুষকে ব্যবহার করেছে তার স্বার্থের জন্য। গ্রামের নারী তার স্বামীকে বিশাল মর্যাদার অধিকারী বলে জানে। তার সামনে জোরে কথা বলাও অনেকটা নিষিদ্ধ বলে মনে করে। এক সময়ে গ্রামের নারীদের আরবি শিক্ষা ব্যতিরেকে অন্য শিক্ষা এক প্রকার নিষিদ্ধ ছিল। পুরুষের কোনো কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করাকেও তারা পাপ বলে গণ্য করত।
ওয়ালীউল্লাহ এমন ভাবনা থেকে মজিদ চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। মজিদ পীর-ফকির। তার সামনে ঘোমটা পরে চলাটাই রেওয়াজ। সুতরাং চলাচলে ধীরগতি খুব স্বাভাবিক। এ প্রসঙ্গে মজিদ তাঁর ধর্ম ব্যবসাকেও চতুরতার সঙ্গে নিজের স্ত্রীর মধ্যেও ছড়িয়ে দেয়। মজিদ তাঁর স্ত্রীকে বলে :
‘এমন কইরা হাঁটতে নাই বিবি, মাটি গোস্বা করে। এই মাটিতেই একদিন ফিরি যাইবা।’
মজিদ গ্রামের মানুষের কাছে নিজেকে মায়ের মতো পবিত্র বলে তুলে ধরে। মাটি, মা খাকী। সুতরাং তাঁর কাছে মাটি তাই পবিত্র।
ওয়ালীউল্লাহ গ্রামবাংলা তথা গোটা ভারতের মানুষের ধর্মবিশ্বাসে ‘বসুমাতা’র প্রভাব সম্পর্কে জানেন। দুর্গা, কালী এই বসুমাতার প্রতীক। এ দেশের নি¤œ শ্রেণীর মানুষ দীর্ঘকাল বর্ণবাদের শিকার হয়ে অনেকটা অচ্ছুত জীবনযাপন করে আসছে। সুফি ফকিরদের মাধ্যমে তারা ধর্মান্তরিত হলেও পুরান ধর্মবিশ্বাসকে পরিত্যাগ করতে পারেনি। ফলে মাটি বসুমাতা, মা খাকী, হিসেবে তার কাছে শ্রদ্ধাও ভক্তির পাত্র হয়েছে। মজিদের মাধ্যমে ওয়ালীউল্লাহ এই অসাধারণ নৈপুণ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। হ


আরো সংবাদ



premium cement