২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

দাগ রেখে যাই

-


৩.

বাবার বুকের রেশমি পরশ
আমার বাবার নানা বাড়ি ফুলসূতি চৌধুরী বাড়ি। আমার দাদা বুড়ো বয়সে অর্থাৎ প্রায় ষাট বছর বয়সে চৌধুরী বাড়ির কুমারী কন্যা ওয়াকিদুন্নেছাকে বিবাহ করেন বেশ ধুমধাম করে। চৌধুরী বাড়ি বিয়ে করা সাধারণ লোকের পক্ষে তখন সহজ ছিল না। আমার দাদা শাহ আবদুর রহিম সম্ভ্রান্ত ও উচ্চবংশীয় বলে এই চৌধুরী বাড়ির মেয়েকে বিবাহ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। চৌধুরী বাড়ির নামজাদা জমিদার ছিলেন চৌধুরী রানী করিমুন্নেছা। তিনি ফরিদপুরের জমিদারদের মধ্যে অত্যন্ত মেধাবী ও দক্ষ ছিলেন। আমার দাদার স্ত্রী বিয়োগ হওয়ায় এবং কোনো সন্তান না থাকায় তিনি শেষ বয়সে এই বিয়েটি করেন। তার আগের নছব ছিল গির্দার সৈয়দ বাড়িতে। আমার আব্বাই ছিলেন দাদার একমাত্র সন্তান। আব্বার জবানিতে শুনেছি তিনি যখন শিশু বয়সের তখন তার পিতা মৃত্যুবরণ করেন। তার পিতাকে যখন শেষ যাত্রার গোছল দিচ্ছিল তখন তিনি বাড়ির উঠোনে খেলছিলেন। আপনজন মৃত্যুর বিশেষত বাবা হারানোর বেদনাবোধ তার তখনো জাগ্রত হয়নি। আব্বা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাবা হারানোর বেদনা বোধনের অযোগ্যতাকে কপাল লিখন বলে আফসোস
করেছেন। এরপর আব্বা পিতৃহীন জীবনের নিঃসঙ্গতা নিয়ে বেদনা বধিত জীবন কাটিয়েছেন। আব্বার আম্মুজান তাকে আঁকড়ে ধরে কোলে কাঁখে করে রেখেছেন। বুকের মানিক বুকে চেপেই বৈধবের নরক যন্ত্রণা ভুলেছেন। স্বামীর অবর্তমানে পুত্রই একদিন চন্দ্র জ্যোৎছনার আড়ং বসাবে! কিন্তু নিয়তি কি তা হতে দেবে? জ্যোৎছনার ঘরে, যে অমরাবতী কালো রাতের পর্দা ঝুলিয়ে দেবে না- তার দিব্যি কে দেবে! আব্বার মরণঘাতী কলেরা হলো! দাদুজানের জান কেঁপে উঠল। হায়! এবার বুঝি সব শেষ হয়ে যাবে। স্বামী হারিয়ে গিয়েছে আঁধারের কালো জোছনায়! পুত্রও এখন চলে যাবে। হারিয়ে যাবে অজানা অদেখার অমূর্ত ভুবনে। বুকের ধন যে আমার প্রাণ ভোমরা, নাড়িছেঁড়া অমূল্য রতন তা কি আমাকে রেখে চলে যাবে অনন্তে আদিগন্তের শেষ সীমায়! এ যে কলেরা, এ যে মহামারী, এটা হলে কেউ তো বাঁচে না। দাদুজান জায়নামাজে বসে গেলেন। আজ তিনি প্রভু, পরমস্রষ্টার কাছে কায়মনোবাক্যে মুনাজাত করবেন, পুত্রের প্রাণ ভিক্ষা চাইবেন। না মালাকুলমউতকে খালি হাতে ফেরত দেবেন না। তিনি নিজের প্রাণ বিসর্জন দেবেন। কিন্তু যে প্রাণ অদলবদলের মালিক তাকে তো রাজি করাতে হবে। নিজের জীবনের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ফিরিয়ে দেয়ার আর্জি পেশ করবেন। নজরানা দেবেন নফল নামাজ। হে মালিক তুমি আর কত ক্ষতি দিয়ে আমাকে পরীক্ষা করবে? ভার বহন করার অতিরিক্ত বোঝা আমাকে দিও না। দাদুর মুনাজাতে জায়নামাজ ভিজে যায়। আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে যায়। পৃথিবীও কান্নার জলে ভিজে যায়। আল্লাহ কবুল করছেন তার প্রার্থনা। আমার দাদীজান মুহূর্তে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হিমশীতল পরশে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েন। আব্বা ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে পেলেন। আব্বা পিতৃ-মাতৃহীন এতিম বালকে পরিণত হন। আমার আব্বা প্রায় সময়ে এ কথা আমাদের শুনিয়ে মাতৃহারা হৃদয়ে কোঁকিয়ে কোঁকিয়ে কেঁদেছেন। আমরা নীরবে নিঃশব্দে বুক চাপড়িয়ে কেঁদেছি। প্রভু হে, আমার আব্বা পিতা মাতা হারানোর শোকযন্ত্রণায় কেঁদে কেঁদে বুক ভিজিয়েছে। আমরা দাদা-দাদীর সোহাগের রেশমি চাদর থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমাদের বুকেও জমে আছে বেদনার পাথর খণ্ড।
আমার আব্বার জন্ম সাল ইংরেজি ১৯০৩। তবে কত তারিখ, কোন মাস, কী বার, তা এ মুহূর্তে মনে নেই। তবে তিনি কবি জসিমউদদীন-এর বয়ঃকনিষ্ঠ। পল্লীকবির জন্ম তারিখ ১ জানুয়ারি ১৯০৩। কবি সুফি মোতাহার হোসেনের জন্ম তারিখ ২০ আগস্ট ১৯০৭। কবি হুমায়ুন কবিরের জন্ম তারিখ ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯০৬। হুমায়ুন কবির ও নুরুল হক খোন্দকার নুরু মিয়া সাহেব আব্বার সহপাঠী। আব্বা তার মা-বাবাকে শিশুকালে হারিয়ে ছিলেন। ফলে তার লেখাপড়ার কাল শিশুকালেই বিলম্বিত হয়েছিল। একটু বেশি বয়সে তিনি লেখাপড়ার পাঠ শুরু করেছিলেন। এ জন্য তিন বছরের কনিষ্ঠ হুমায়ুন কবিরদের সতীর্থ হয়েছিলেন। কবি হুমায়ুন কবিরের বাবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খান বাহাদুর কবির উদ্দিন আহমদ। তিনি বিভিন্ন জেলায় দায়িত্ব পালন করেছেন। এর জন্য হুমায়ুন কবিরকে বাবার সাথে বিভিন্ন জেলায় থাকতে হয়েছে। তাই হয়তো তিনি নওগাঁ কে ডি স্কুল থেকে প্রবেশিকা বা এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়েছিলেন এবং ইংরেজিতে লেটারসহ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলেন। আব্বা কলকাতা চৎবপবফবহপ কলেজের ছাত্র হয়েও শেষ পর্যন্ত ঢাকা কলেজে অধ্যায়ন করেছেন। কলেজ জীবনের এই স্বর্ণময় সময়ের হাতছানি ঠেলে দিয়ে পৈতৃক সম্পত্তি দেখভাল করার জোর তাগিদ দিলেন তার পিতৃতুল্য খালেক ভাই। গ্রামের অনেক প্রজাবৃন্দ ঠিকমতো খাজনা দেয় না বাবার এই ভাইকে, বাবাকেও। তাই তিনি পৈতৃক ঐতিহ্য ধরে রাখার দৃপ্ত প্রত্যয় নিলেন। গ্রামের পূর্ব কোণে এক নতুন শাসকের আবির্ভাব ঘটেছে। তিনি অন্য গ্রাম থেকে খারদিয়ায় স্থায়ী বসবাস শুরু করেন বেশ আড়ম্ববরের সাথে। তিনি পুরনো ক্ষমতাবানদের তেমন একটা মর্যাদা দিতে চান না। বাবার ও চাচার লোকদের তিনি বিভিন্ন কৌশলে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করতেন। বিষয়টি খালেক চাচা ও বাবার তেমন শোভন মনে হয়নি। তাই আমার মেধাবী বাবা লেখাপড়ার ভার কমিয়ে গ্রাম্য রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলেন। ফরিদপুর শহরের বড় এলিটদের সাথে আব্বার বন্ধুত্ব ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। এদের মধ্যে বিষুমিয়া যিনি বোয়ালমারী মধুখালী উপজেলার এম এন এ ছিলেন, যা এখন এমপি মর্যাদার সমান। তাকে আমরা খালু বলে সম্বোধন করতাম। তিনি আমাদের আত্মীয় ছিলেন। ইউসুফ আলী চৌধুরী ওরফে মোহন মিয়া, নওশা মিয়া, সৈয়দ আবুল হোসেন ওরফে কোটন ভাই তিনি গেরদার বিখ্যাত সৈয়দ বংশের উত্তর পুরুষ। তিনি আব্বার বোনের ছেলে। নুরুল হক খোন্দকার যিনি আব্বার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আব্বা একসময় জজকোর্টের জুরি বোর্ডের সদস্য হলেন। বিচারকরা বিচারের ফয়সালার জন্য অনেক সময় এই জুরি বোর্ডের সদস্যদের পরামর্শ নিতেন। জাতীয় রাজনীতিতে আব্বা কখনো সরাসরি সম্পৃক্ত হননি, তবে অনেক সাংসদ মন্ত্রী মহোদয়দের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেছেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সাহেবের ঋণ সালিসি বোর্ডের ফরিদপুর জেলার দায়িত্ব পেয়েছিলেন আমার বাবা।

জিজীবিষা অফ সামিরা
দ্বীন মোহাম্মাদ দুখু
শনিবার বিকেল।
পৌনে চারটে।
অফিস ছুটি।
চারটে পর্যন্ত ঘুমোতে পারলে ছুটিটা যথার্থ উপভোগ করা যেত। ছুটির দিন বলে সকাল নয়টা পর্যন্ত বসে টগল সিরিজের ১৭১ নং ছড়াটি শেষ করে ঘুমিয়েছি। ঘুমটা হঠাৎ ভাঙল কেন প্রথমে ঠাওর করতে পারি নি। তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলাম ওয়াশরুমে জলের শব্দ। ভাবলাম পানি পড়ছে বন্ধ করে আসি। ওয়াশরুমে ঢুকতেই আমার চোখ কপালে উঠে গেল।
সামিরা।
সামিরাকে ঠিক এমনভাবে কখনো দেখিনি। তন্দ্রা ভাব কখন কেটে গেলো বুঝতেই পারিনি।
সামিরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। সামিরা পোষা বিড়ালের মতো নীরবে বুকের উষ্ণতায় জড়িয়ে ছিল।
কেউ দেখে নিবে। ছাড়ো। ছাড়ো না!
ও এক হাতে আমায় জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে শাওয়ারের জল ছেড়ে আমায় ভিজিয়ে দিয়ে দৌড় দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে গেল।
ভেজা শরীর তাই আমিও শাওয়ার করে নিলাম। বের হয়ে লুঙ্গিটা পড়ে কাঁধে তোয়ালের এক পাশ রেখে অন্য পাশ দিয়ে চুল মুছতে মুছতে শোবার ঘরে ঢুকতেই আমি তো হতবিম্ব। আমি আজ কী দেখছি? অন্য রকম সামিরাকে দেখছি। কখন যে ওর কাছাকাছি মিশে গেলাম বুঝতেই পারিনি। চুলের মধ্যে নাক ডুবিয়ে সুগন্ধ নিচ্ছি।
তখন সামিরা বলল, কী দেখো? বললাম, তোমাকেই।
আমি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাই, তুমি কী দেখো? কী ভাবছ? আমি জানতাম উত্তরে ও বলবে ‘তোমাকেই’। কিন্তু না। সে এমন কিছুই বলেনি। কিছুক্ষণ আমার বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে রান্না ঘরে চলে গেল।
মিনিট দশেক পর, দু’কাপ চা হাতে একটাতে চিনি বেশি অন্যটা তে কম। আমি চায়ে চিনি বেশি খাই বলে রাখা ভালো।
আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, বলত কোনটা তোমার?
কাপ দেখে কী বলা যায় কোনটায় চিনি বেশি কোনটায় কম?
আমি বলতে নারাজ।
বলাবোই না।
আমি বললাম, আচ্ছা বলতো তখন তুমি কেঁদেছো কেনো?
ও বলল যদি তুমি বলতে পারো কোনটা তোমার চা, তা হলে বলব।
আমি বললাম বাম হাতের টা। বাম আমার পছন্দ। কারণ আমি বামপন্থী।
সামিরা বলল, ইউ আর রাইট। আমি সামিরার দিকে তাকিয়ে বললাম এবার...
এবার বলাতেই ও বলতে শুরু করল। গত পরশু। অফিসে ভালো লাগেনি। ওর অফিস সেগুনবাগিচায়। মানবাধিকার সংস্থার অধীনস্থ একটি সংস্থায় কাজ করে ও। অবশ্য এর আগে ও বেশ কয়েকটি কাজ ছেড়ে দিয়েছে। করপোরেট অফিস থেকে শুরু করে মডেলিং এর কাজও সামিরা স্বেচ্ছায় ছেড়েছে।
কেন অফিস ভালো লাগেনি সেটা জিজ্ঞেস করায় ও বলল।
গত পরশু পাঁচ বছরের একটি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
খবরটি এখনো মিডিয়া পাড়ায় আসেনি।
ও বলছিল নির্যাতনকারী একই ভবনের আট তলায় থাকে।
সামিরা অনবরত মেয়েটার বলে যাচ্ছিল কিন্তু আমি তখন সামিরার কোন কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমার চোখে ভাসছিল সামিরার যখন বয়স পাঁচ ঠিক তখনকার গল্প।
তখনো সেই নিদারুণ ঘটনার কোনো বিচার হয়নি।
তাহের আলি। তিনি দিব্যি ভালোই আছেন।
আপনাদের কেউ কেউ হয়তো উনাকে ভালোভাবে চেনেন।
সামিরা সে দিন নিকৃষ্ট ঘটনার ব্যাপারে কাউকে কিছু বলবে না, শুধু বেঁচে থাকতে চায় এ শর্তে জীবন ফিরে পেয়েছিল।
তার পর পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশু সামিরা বিনা টিকিটে রেল ধরে চলে যায় ঈশ্বরদী, তার পর চাটগাঁও।
সামিরা বলো উঠল, কী হলো? তুমি শুনতে পাচ্ছো না? হ্যাঁ হু কিছুই বলছ না। আমি কার সাথে কথা বলছি?
সরি। বলো, আমি শুনছি তো বলেই ওর চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চায়ে চুমুক দিলাম এবার আমি আকাশ থেকে যেন মাটিতে পড়লাম।
এই কাপেও একই পরিমাণ চিনি দেয়া।
আমি ব্যাপারটা জানতে চাওয়ায় ও বলল, আমি তোমার সব অভ্যাস আমার করে নিতে চাই।
আমি বললাম তুমি পারবে না, ও বলল পারব।
সামিরা বলল, আমি তোমাকে কোনো কিছু লুকোয়নি আর কখনো লুকোবো-ও না।
তুমি কি ভাবছিলে আমি জানি, আমার প্রতি ঘৃণা তৈরি হয়েছে সেটাও জানি।
তুমি এতক্ষণ আমার কোনো কথাই শুনোনি।
আমি বললাম, নারে পাগলি ‘ভালোবাসি’।
সামিরা বলল, আর ভালোবাসতে হবে না। রেডি হও। আম্মার বাসায় যেতে হবে।
ওখান থেকে প্রাপ্তিকে ডাক্তার দেখিয়ে আবার সাংবাদিক ফেডারেশনে যেতে হবে।
প্রাপ্তি আমাদের মেয়ে।
পৌনে ৯টায় দিকে সাংবাদিক ফেডারেশনে ঢুকলাম
সাংবাদিক কবিরের সাথে দেখা করবে ভেবে সামিরা ভেতরে গেল। দশ সেকেন্ড পর বের হয়ে এসে বলল, চলো বাসায় যাব। আমি কোন প্রশ্ন করি নি। প্রাপ্তি সাথেই ছিল।
আমরা গাড়িতে গিয়ে বসলাম। কারওয়ান বাজারে আমার প্রকাশকের সাথে সামান্য কাজ থাকায়, গাড়িটি কারওয়ান বাজারমুখী চলছিল।
ওই যেসব কাজে নাক গলানো পাজি-জ্যাম।পান্থপথের জ্যাম।
ততক্ষণে প্রাপ্তি ঘুমিয়ে পড়েছে। সামিরাকে জিজ্ঞেস করলাম, ওখানে কী হলো?
বদমাইশ মোসলেম তালুকদার, সাংবাদিক কবিরের সাথে হয়তো দহরম-মহরম। এদের সাথে কথা বলে লাভ হবে না। তাই চলে আসলাম।
জ্যাম সরে গেলো। গাড়ি চলছে। ড্রাইভারকে বললাম একটি পত্রিকা অফিসের গলি দিয়ে ঢুকতে।
গাড়ি চলছে। সামিরা মাথা নিচু করে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। আমি তখন ভাবছি মোসলেম তালুকদার এর কথা।
বদলোক তার কোম্পানির একটা প্রজেক্টের জন্য কক্সবাজার ট্যুরের আয়োজন করে। সেই ট্যুরে সামিরাও ছিল। তখন সামিরা ওই কোম্পানিতে ছিল।
হোটেল রুমে যা ঘটেছিল।
সে দিন তার বিচার হয়নি।
এসবের বিচার হয় না।
আমি বামপন্থী। আমি বিচার চাইতে গেলে বা দুই পাতা লিখতে গেলেই লোকে বলে উঠে এনাফ ইজ এনাফ। ড্রাইভার বলল স্যার এসে গেছি।
আমি সামিরাকে বললাম তুমি গাড়িতে থাকো। আমি আসছি।
১১টায় বাসায় ফিরলাম। খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সোমবার বিকেলে। অফিস শেষে সরাসরি বাসায় ফিরলাম । তখনো সামিরা ফেরে নি। সারাবাড়ি শান্ত। আমার মামনি প্রাপ্তির কিচিরমিচির নেই।
দেখি ও ঘরের এক কোণে বসে আছে।
বললাম মামনি কি হয়েছে?
এখানে কেন? মন খারাপ?
ও কথা বলছে না। অনেকক্ষণ ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করছি। চকোলেট দিলাম। চটইএ খেললাম।তার পর দু’জনে খেতে খেতে আবার জিজ্ঞেস করবো ভাবলাম
কিন্তু জিজ্ঞেস করার আগেই ও বলল
বাবাই, আমি স্কুলে যাবো না,নাচ শিখব না। সামিরা ফেরার আগেই প্রাপ্তি ঘুমিয়ে পড়ল।
রাতে আমি সামিরাকে কথাগুলো বললাম।
সামিরা বলল, ও বেশ কিছু দিন একটানা ক্লাস করছে তো, তাই হয়তো ভালো লাগছে না।
আমার তো অফিস আছে, তা ছাড়া ওই যে বলেছিলাম পাঁচ বছরের মেয়েটার কথা। এ জন্য কোর্টে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। তুমি বরং প্রাপ্তিকে নিয়ে ঢাকার বাইরে বেশ কয়েক দিন ঘুরে এসো।
সাত দিন পর ঢাকায় ফিরলাম। খুব বুঝিয়ে প্রাপ্তিকে স্কুলে পাঠালাম।
বুধবার । সকাল ১০টা ।
প্রাপ্তি মায়ের সাথে স্কুলে গেলো। ড্রাইভার প্রাপ্তিকে স্কুলে নামিয়ে সামিরাকে অফিসে দিয়ে আসবে।
আমি অফিসের কাজে নরসিংদীর বেলাবো যাচ্ছি। আমি যখন অফিসের কাজ শেষ করে ঢাকায় ফিরছি তখন বিকেল ৫টা।
কাঁচপুর ব্রিজের কাছাকাছি আসতেই সামিরার ফোন পেলাম।
ফোনের ওপার থেকে শুনতে পেলাম প্রাপ্তিকে খুঁজে পাচ্ছি না।আমি আমার প্রাণ হাতে নিয়ে কিভাবে ঢাকায় ফিরলাম বলতে পারব না।
কোথাও পাচ্ছি না প্রাপ্তিকে।
আমার বন্ধু তানিমের ফোন বলছিল প্রাপ্তির মতো কাউকে টিভিতে দেখাচ্ছে।
আমরা ছুটে গেলাম ঢাকা মেডিক্যালে।
তখনও প্রাপ্তির নিঃশ্বাস চলছে বলে ডাক্তার জানাল।
জানতে পারলামÑ কারওয়ান বাজারের কোনো এক ময়লার ড্রামে ছিল। পরিছন্নতা কর্মীরা হসপিটালে এনেছে প্রাপ্তিকে।
ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালো, যৌন নির্যাতনের শিকার মেয়েটি। বিকেলে প্রাপ্তির ব্যাগ পেলাম। বাংলা খাতা ভর্তি লেখা ছিলÑ
মা, বাবা,
টিচাররা নাচ শেখাতে গিয়ে বুকে হাত দেয়, পিঠে হাত দেয়, পিছনে হাত দেয়।
মা, বাবা,
আমি স্কুলে যাব না।
তিন দিন ধরে প্রাপ্তি কোমায় আছে।
টিচারদের নামে থানায় অভিযোগ করায় টিচারদের পক্ষে দেখলাম অনেক লোকের আমদানি।
তাহের আলিকেও দেখলাম। মূলত তাহের আলি স্কুলটির অন্যতম কর্ণধার।
সেদিন শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাচ্ছিল তাহের আলির বাসায়। ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে। তিনি নবনির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান।
প্রাপ্তির জ্ঞান ফিরেনি এখনো, কথা বলছে না, নড়াচড়া ও করছে না। আর সামিরা হু হু করে কেঁদে উঠলো। বলল, আমি অনেকবার বাঁচতে চেয়েছি, আমি বাঁচতে চাই না আর, প্রাপ্তিকে বাঁচাও।
ওরা আমাকে ছাড়েনি, প্রাপ্তিকেও ছাড়ছে না। প্রাপ্তিকে বাঁচাও। মামলা কোর্টে উঠে গেছে।
মনগড়া ও ডিজিটাল মারপ্যাঁচে সেই রাজনৈতিক বাহুবলে তথ্য ও প্রমাণে মামলার অবস্থার পঁচাশি শতাংশ আসামিদের পক্ষে।
আগামীকালের রোববার।
বিকেলে প্রাপ্তির জ্ঞান ফেরার কথা।
ডাক্তার প্রাপ্তিকে কেবিনে আনতে নার্সদের নির্দেশ দিলো।
কেবিনে আনতেই ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ বজ্রপাতের মতো চার দিকে ছড়িয়ে পড়ল। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement