১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মীর মশাররফ হোসেন

-

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মীর মশাররফ হোসেনের অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি মুসলিম রচিত বাংলা সাহিত্যের সমন্বয়ধর্মী সমাজের অন্তর্ভুক্ত। মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিত্বহীন সময়ে বাংলা সাহিত্যে তার আবির্ভাব ও প্রতিষ্ঠা একটি বিস্ময়কর ঘটনা। এ সময়ে মুসলমান লেখকরা ছিলেন স্বেচ্ছানির্বাসিত। তারা পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতিকে বর্জন করছিলেন। ফলে তারা মধ্যযুগের একঘেয়ে সাহিত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে দোভাষী পুঁথি রচনা করেই ছিলেন তৃপ্ত। তাদের মধ্যে নবজাগরণের বিশ্বপ্রতিম মানবিক বোধবুদ্ধি ও জিজ্ঞাসা ছিল না। এই সর্বপ্লাবী সাহিত্যশিল্পের জয়যাত্রার জোয়ারের মুখে মীর মশাররফ হোসেন বাংলা সাহিত্যে পদার্পণ করেন ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তিনি অবনমিত মুসলিম সমাজকে আত্মপ্রত্যয়ী ও সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগী করে তোলেন।
মীর মশাররফ হোসেন কুষ্টিয়া শহর থেকে তিন মাইল পূর্বে গড়াই ব্রিজের নিকটস্থ লাহিনীপাড়া গ্রামে ভূসম্পত্তির অধিকারী এক ধনাঢ্য পরিবারে ১৩ নভেম্বর ১৮৪৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল মীর মোয়াজ্জেম হোসেন এবং মায়ের নাম দৌলতন্নেসা। তার পূর্বপুরুষ সৈয়দ সা’দুল্লাহ বাগদাদ থেকে প্রথমে দিল্লিতে এসে মোগল সেনাবাহিনীতে চাকরি গ্রহণ করেন। পরে তিনি ফরিদপুর জেলার স্যাকরা গ্রামে আগমন করে এক ব্রাহ্মণ কন্যার পাণি গ্রহণ করে পদমদী গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করেন। মীর মশাররফ হোসেনের পিতা মীর মোয়াজ্জেম হোসেন কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়া গ্রামের ভূস্বামী ছিলেন।
মীর মশাররফ হোসেন বাল্যকালে প্রথম গৃহে, পরে গ্রামের জগমোহন নন্দীর পাঠশালায় লেখাপড়া আরম্ভ করেন। এরপর কুমারখালী এম এন স্কুল, কুষ্টিয়া হাইস্কুল ও পদমদী স্কুলে অল্প দিন করে পড়েছিলেন। পরে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। সম্ভবত অষ্টম শ্রেণীতে উঠে তিনি কলকাতায় পিতৃবন্ধু নাদির হোসেনের বাসায় থেকে কিছুকাল পড়াশোনা করেন। নাদির হোসেনের বাসায় অবস্থানকালে তার প্রথমা সুন্দরী কন্যা লতিফনের সাথে প্রথমে প্রণয় এবং পরে বিবাহের ব্যবস্থা হয়। কিন্তু বিবাহের সময় নাদির হোসেন প্রথম কন্যার পরিবর্তে দ্বিতীয় কুরূপা ও বুদ্ধিহীনা কন্যা আজিজন্নেসার সাথে তার বিবাহ দেন (১৯ মে ১৮৬৫)। এই ঘটনার পরিণামে লতিফন্নেসা আত্মহত্যা করলে মীর ভীষণ আঘাত পান। মীরের প্রথম বিবাহ সুখের না হওয়ায় বিবাহের আট বছর পর সাঁওতা গ্রামের এক বিধবার কন্যা কালী ওরফে কুলসুম বিবিকে বিবাহ করেন। এ ঘটনায় আজিজন্নেসার সাথে তার মনোমালিন্য আরো তীব্র হয়। অতঃপর মীর মশাররফ হোসেন লাহিনীপাড়ায় বসবাস করতে না পেরে টাঙ্গাইল জেলার গজনবী এস্টেটের এক তরফে ম্যানেজার হয়ে টাঙ্গাইলের ‘শান্তিকুঞ্জে’ বিবি কুলসুমকে নিয়ে বসবাস করতে থাকেন। আজিজন্নেসা কয়েক বছর অনাদর অবহেলায় নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করে লাহিনীপাড়ায় মারা যান। তার গর্ভে কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করেনি। মীর মশাররফ হোসেনের পাঁচটি ছেলে ও ছয়টি মেয়ে সবাই বিবি কুলসুমের গর্ভজাত।
মীর মশাররফ হোসেনের অসাধারণ কৃতিত্ব এই যে, তিনি দোভাষী পুঁথির মিশ্র ভাষারীতি থেকে বেরিয়ে এসে এক ধরনের বিশেষ শালীন সাধুগদ্যের চর্চা শুরু করেন। মাইকেল যেমন কবিতায় রামায়ণের কাহিনী নিয়ে এক অপরূপ ট্র্যাজেডি ‘মেঘনাদ বধ’ রচনার মধ্য দিয়ে পুরাণের পুনর্জন্ম ঘটিয়েছিলেন তেমনি মীর মশাররফ গদ্যে কারবালার ঐতিহাসিক বিয়োগান্ত ঘটনা নিয়ে ‘বিষাদ সিন্ধু’ ট্র্যাজেডি রচনার মাধ্যমে ইতিহাসের নবজন্ম দান করলেন।
পাশ্চাত্য ভাবধারাপুষ্ট সমসাময়িক সাহিত্যিকগণ যে সময়ে রস-সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে চলেছেন, সে সময়ে মীর মশাররফ হোসেন ব্যতীত অন্য কোনো মুসলিম গদ্য লেখককে সাহিত্য পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দেখা যায়নি। প্রকৃতপক্ষে তাঁর রচনার অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুসলিম ঐতিহ্য-ইতিহাস এবং পুঁথি সাহিত্যকে প্রাধান্য দান করলেও তার সৃষ্ট সাহিত্যে প্রচারধর্মিতার কোনো ছাপ নেই। ইসলামী ভাবধারার উজ্জীবন অপেক্ষা সমাজের দোষত্রুটি উদঘাটন এবং জীবন চিত্রাঙ্কনের প্রতি তার দৃষ্টি বেশি নিবন্ধ ছিল। এ কারণে তার সাহিত্য মুসলমান-হিন্দু সবার কাছে ছিল জনপ্রিয়। তার মতো একজন হৃদয়বান এবং মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন সাহিত্যিকের আবির্ভাব নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর।
তিনি প্রথম জীবনে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিত’ (১৮৬৩) ও কবি ঈশ্বরগুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ (১৮৩১) পত্রিকায় সংবাদ প্রেরণ করতেন। এই সুবাদে কাঙাল হরিনাথের সাথে তার হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল যা আমৃত্যু বহাল থাকে। মীর মশাররফ হোসেন বিবাহের পর লাহিনীপাড়া থেকে প্রথম স্ত্রীর নামে ‘আজিজন নেহার’ নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন ১৮৭৪ সালে। সামান্য কয়েক মাস পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৯০ সালে তিনি পুনরায় লাহিনীপাড়া থেকে ‘হিতকরী’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এ পত্রিকার কোথাও সম্পাদকের নাম ছিল না। ‘হিতকরীর’ কয়েকটি সংখ্যা টাঙ্গাইল থেকেও প্রকাশিত হয়েছিল। এ পত্রিকাটির সহকারী সম্পাদক ছিলেন কুষ্টিয়ার বিখ্যাত উকিল রাইচরণ দাস। মীর একটি (রবেনা সুদিন কুদিন কয়দিন গেলে) বাউল গান লিখে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ‘ফিকিরচাঁদ ফকিরের’ বাউল দলের সদস্য হন। ‘মশা বাউল’ ভণিতায় তিনি কয়েকটি উৎকৃষ্ট বাউল সঙ্গীত রচনা করেছিলেন। সঙ্গীত সম্বন্ধে তার বেশ ভালো জ্ঞান ছিল। তার ‘সঙ্গীত লহরীতে’ বিভিন্ন তালের অনেকগুলো উৎকৃষ্ট সঙ্গীত আছে।
গদ্যে, পদ্যে, নাটক, নভেলে মীর মশাররফ হোসেন প্রায় ৩৭টি গ্রন্থ রচনা করেন। তার গদ্যরীতি ছিল বিশুদ্ধ বাংলা। তবে তার পদ্যনীতি প্রায় সবই অনুকৃতি ও কষ্টকল্প রচনা বলে কোনো সমাদর পায়নি। তিনি ‘জমিদার দর্পণ’ নাটক লিখে তদানীন্তনকালে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের মর্যাদা লাভ করেন। কৃষক বিদ্রোহে উসকানি দেয়ার ভয়ে বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় নাটকটির প্রকাশ ও অভিনয় বন্ধের সুপারিশ করেছিলেন। মীর মশাররফ হোসেন বিশুদ্ধ বাংলায় অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করে আরবি-ফার্সি মিশ্রিত পরিত্যাগ করেছিলেন। মীর মশাররফ হোসেনের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘বিষাদ সিন্ধু’ বাংলার মুসলমান সমাজে ধর্মগ্রন্থের মত শ্রদ্ধার সাথে আজও পঠিত হয়। কারবালার করুণ ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে রচিত এই উপন্যাসখানি বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। মীর মশাররফ হোসেনের অপর গ্রন্থগুলো বাদ দিলেও মাত্র এই একখানি গ্রন্থ রচনার জন্য তাকে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখক আখ্যায়িত করা যায়। তার সাহিত্যের প্রায় অর্ধেকই কাব্য হলেও তিনি কবিখ্যাতি লাভ করতে পারেননি। তবু তিনিই প্রথম মুসলমানদের জন্য সার্থক সাহিত্য রচনা করেছিলেন এ কথা অস্বীকার করা যায় না। বাংলা সাহিত্যে মুসলিম কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেনের নাম শীর্ষদেশে অম্লান হয়ে আছে এ কথা যেমন সত্য তেমনি সমগ্র বাংলা সাহিত্যেও তিনি একজন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ছিলেন এ কথাও অনস্বীকার্য।
মীর মশাররফ হোসেন লিখিত গ্রন্থ যথা :
১. রতœবতীÑ উপন্যাস ১৮৭৩; ২. বসন্ত কুমারীÑ নাটক ১৮৭৩; ৩. জমিদার দর্পণÑ নাটক ১৮৬৯; ৪. গড়াই ব্রিজ বা গৌড়ী সেতুÑ কবিতা গ্রন্থ ১৮৭৩; ৫. এর উপায় কিÑ প্রহসন ১৮৭৬; ৬. বিষাদ-সিন্ধুÑ ঐতিহাসিক উপন্যাস ১৮৮৫-৯১) ৭. সঙ্গীত লহরীÑ ১৮৮৭; ৮. গো-জীবনÑ প্রবন্ধ ১৮৮৯; ৯. বেহুলা গীতাভিনয়Ñ গীতিনাট্য ১৮৮৯; ১০. উদাসীন পথিকের মনের কথাÑ জীবনী ১৮৯৯; ১১. গাজী মিয়ার বস্তানীÑ রম্যরচনা ১৮৯৯; ১২. মৌলুদ শরীফÑ গদ্যে-পদ্যে লিখিত ধর্মীয় গ্রন্থ ১৯০০; ১৩. মুসলমানের বাঙ্গালা শিক্ষাÑ ছাত্র পাঠ্য ১ম ভাগ ১৯০৩ এবং দ্বিতীয় ভাগ ১৯০৮; ১৪. বিবি খোদেজার বিবাহÑ কাব্য ১৯০৫; ১৫. হজরত ওমরের ধর্মজীবন লাভÑ কাব্য ১৯০৫; ১৬. হজরত বেলালের জীবনীÑ প্রবন্ধ ১৯০৫; ১৭. হজরত আমীর হামজার ধর্মজীবন লাভÑ কাব্য ১৯০৫; ১৮. মদিনার গৌরবÑ কাব্য ১৯০৬; ১৯. মোশ্লেম বীরত্বÑ কাব্য ১৯০৭; ২০. এসলামের জয়Ñ প্রবন্ধ গ্রন্থ ১৯০৮; ২১. আমার জীবনীÑ আত্মজীবনী ১৯০৮-১০; ২২. বাজিমাতÑ কাব্য ১৯০৮; ২৩. হজরত ইউসোফÑ প্রবন্ধ গ্রন্থ ১৯০৮; ২৪. খোতবা বা ঈদুল ফিতরÑ কাব্য ১৯০৮; ২৫. বিবি কুলসুমÑ জীবনী ১৯১০। হ


আরো সংবাদ



premium cement