২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আহমদ বাসির ক্ষণজন্মা কবির বিদায়

-

পৃথিবীতে মানুষের মৃত্যু অনিবার্য। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অনন্ত জীবনে প্রবেশ ঘটে মানুষের। প্রতিদিনের কর্মচাঞ্চল্যে মানুষ ভুলে থাকে মরণের সত্য। এই বিস্মরণ আছে বলেই মানুষ কর্মমুখর থাকে; জীবনের প্রয়োজনে, তৃষ্ণায় সতত ছুটে চলে একটা পরিণতির দিকে। গড় আয়ুর অনুসারে মানুষ জীবনের একটা হিসাব করে নেয়। তাই শৈশব-কৈশোর-যৌবনকালে মানুষের মৃত্যু হলে আমরা বলি অকাল মৃত্যু। কোনো প্রতিভার মৃত্যু হলে ক্ষণজন্মা বলে অভিহিত করি। কবি আহমদ বাসিরের অকস্মাৎ মৃত্যুকে আমরা এভাবেই চিহ্নিত করছি।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আহমদ বাসির পরিচিত অঙ্গনে অত্যন্ত প্রিয়জন ছিল। আড্ডাবাজ, তুখোড় তার্কিক, স্পষ্টভাষী ও পড়ুয়ার কারণে সবার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে সময় লাগত না। আমার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক প্রায় ২৫ বছরের। বাসিরের ব্যক্তিত্ব সবাইকে আকৃষ্ট করত; একদিকে প্রচুর পড়াশোনা, চমৎকার বাচনভঙ্গি, দীর্ঘ কবিতার অনবরত মুখস্থ আবৃত্তি; অন্যদিকে বিশ্বাস ও আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা ও আপসহীনতা, সাহস ও বিনয় মুহূর্তেই সঙ্গীদের মুগ্ধ করত। প্রথম থেকেই দেখেছি কবিতা ও ছড়া লেখায় সে বেশ পারদর্শী; একটা স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর সবসময় লক্ষ করেছি। পরবর্তীকালে তার প্রতিভার বিকাশ ঘটেছে নানামুখী। আহমদ বাসিরকে মননশীল প্রাবন্ধিক, হৃদয়গ্রাহী বাচিক শিল্পী, দক্ষ সাহিত-সাংস্কৃতিক সংগঠক, নতুন চিন্তার সম্পাদক ও সাহসী সাংবাদিক হিসেবে পেয়েছি। গত পাঁচ বছরে তাকে গীতিকার, গল্পকার, ঔপন্যাসিক ও স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা রূপে দেখেছি। সবখানে তার প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটেছে।
তরুণ বয়সেই আহমদ বাসির চিন্তার পরিপক্বতা অর্জন করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নিজস্ব পথ নির্মাণ, ঐতিহ্যবাদী ধারার উত্তরাধিকার ও বিকাশ, সমকালীন সঙ্কট মোকাবেলা করে একটি গন্তব্যে পৌঁছানোর পাথেয় কী হতে পারে সে সব বিষয়ে তার চিন্তা, কর্মপরিকল্পনা ও উদ্যোগ ছিল আন্তরিক। ফলে তার কাজে ও সাহিত্যে দেশপ্রেম ও ঐতিহ্যপ্রীতি চোখের পড়ার মতো।
আহমদ বাসিরের প্রতিভার সূচনা ও বিকাশ লাভ করেছে বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্রের বিচিত্র কর্মসূচির মাধ্যমে। একদিকে কবি মতিউর রহমান মল্লিকের ¯েœহ ও ভালোবাসা; সান্নিধ্য, উৎসাহ ও দিকনির্দেশনা; ভাবাদর্শ ও চিন্তার প্রভাব তাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে; অন্যদিকে এই কেন্দ্রের বহুমুখী কর্মসূচিতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, ‘বিপরীত উচ্চারণে’র সমৃদ্ধ সাহিত্য আসরে সরব উপস্থিতি, নানা ধরনের প্রশিক্ষণে অংশ নেয়া, খ্যাতিমান সাহিত্যিক-মনীষীদের একক বক্তৃতার মুগ্ধ শ্রবণ, গণমাধ্যম গবেষণা কেন্দ্রের দায়িত্ব পালন, সারা দেশ থেকে আগত লেখক-শিল্পীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন, কবি মল্লিকের সফরসঙ্গী হয়ে বিভিন্ন জনপদ সফর তাকে সৃজনে ও মননে ঋদ্ধ ও বিকশিত করেছে। এই কেন্দ্রেই আমার সাথে তার পরিচয় ও সম্পর্ক উন্নয়ন হয়। তার জ্ঞানগর্ভ আলোচনা, বৃদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক ও স্পষ্ট উচ্চারণ আমাকে মুগ্ধ করত বরাবর।
বাচিক শিল্প নিয়ে আহমদ বাসিরের প্রবল আগ্রহ ও নিয়মিত চর্চা ছিল। এই শিল্পকে অনন্য উচ্চতায় উপস্থাপনের ক্ষেত্রে তার নিরন্তর চেষ্টা লক্ষণীয়। বাংলা কবিতার প্রচুর পঙ্ক্তি তার মুখস্থ ও ঠোঁটস্থ ছিল। বিশেষভাবে কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ, আল মাহমুদ ও মতিউর রহমান মল্লিøকের কবিতায় তার অবগাহন ও দখল ছিল ব্যাপক। ফলে এসব কবির কবিতার গভীরে প্রবেশ করে কবিতার আত্মা-আবিষ্কার-বিচ্ছুুরণ, শুদ্ধ উচ্চারণ ও বিশেষ ধ্বনিপ্রবাহ নির্মাণে বাসিরের কণ্ঠস্বর বেজে উঠত মঞ্চে, আসরে ও আড্ডায়। আবৃত্তিশিল্প নিয়ে তার নিজস্ব মত বেশ গুরুত্বপূর্ণÑ
কবিতা হচ্ছে মানবজাতির সবচেয়ে সূক্ষ্ম, জটিল, কঠিন ও রহস্যময় শিল্পকর্মÑ হোক সে মহাকাব্য কিংবা আধুনিক গীতিকবিতা। এই শিল্পকর্ম তথা কাব্যকলার নান্দনিক উপস্থাপনাই হচ্ছে আবৃত্তি কিংবা বাচিকশিল্প। অবশ্য বাচিকশিল্প আবৃত্তির ভুবনকে অনেক প্রসারিত করে। বাচিকশিল্প শুধু কবিতাকেই উপস্থাপন কিংবা পরিবেশন করে না, বিচিত্র ধরনের নান্দনিক রচনাকেই উপস্থাপন কিংবা পরিবেশন করে। যেকোনো ধরনের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা কিংবা সংবাদ পরিবেশনাও বাচিকশিল্পের মুখাপেক্ষী। তবে আবৃত্তি বলতে আমরা কবিতার নান্দনিক পরিবেশনাকেই বুঝে থাকি। [‘আবৃত্তির সীমাবদ্ধতা ও উৎকর্ষের প্রয়োজনে’/আহমদ বাসির]
এভাবে আহমদ বাসির কবিতাকে নতুন এক মাত্রায় নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। নিজে ছন্দসচেতন কবিতা ও ছড়া লেখায় সদা তৎপর থেকেছেন; অন্যদিকে আবৃত্তিচর্চায় নিজেকে সমর্পণ করেছে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে। ফলে তার কণ্ঠস্বরের আবেদন হয়েছে মর্মস্পর্শী।
কৈশোর-তারুণ্য থেকেই আহমদ বাসিরের মাঝে কবিতা বাসা বেঁধেছে। কবিতার কঠিন ও জটিল পথ ধরে অনেক দূর এগিয়েছেন প্রতিশ্রুতিশীল এই তরুণ কবি। কবিতার ভাষা, ছন্দ ও অলঙ্কার নির্মাণে একটা স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর অবলোকন করেছে ঘনিষ্ঠ পাঠক। তার মাঝে অনেক সম্ভাবনার মেঘমালা আমরা দেখেছি; আগামী দিনে সৃজন ও মননের বারিধারা পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। কিন্তু মৃত্যু তাকে এখানেই থামিয়ে দিয়েছে; আমাদেরকে শোকে ভাসিয়ে। কিন্তু এই মৃত্যু শারীরিক; তার কাজ আশা করি বেঁচে থাকবে নিরন্তরের স্মৃতিতে।
আকাশে উদিত অমর মৃত্যুহীন প্রাণ যারা
সেই মুহূর্তগুলো শুধুমাত্র তারাই উদযাপন করেছিল
যাদের বুকের গভীরে বিদ্ধ হয়েছিল তোমাদের বুলেট
যাদের মাথার খুলি উপড়ে নিয়েছিল তোমাদের বুলেট
এবং যাদের মায়াময় চক্ষুদ্বয় পর্যন্ত পরিণত হয়েছিল
তোমাদের হিংস্রতার আহারে
[‘মৃত্যু যাদের স্পর্শ করে না’]
প্রকৃত কোনো কবিকেও মৃত্যু স্পর্শ করতে পারে না। তার একমাত্র কাব্য ‘গোপন মাটির বীজতলা’তে বারবার বাধা-বিপত্তি, মৃত্যু-ভয়-ক্ষয় এবং স্বৈরাচারী কর্তৃপক্ষকে অতিক্রমের উদ্দীপনা ও দুঃসাহস স্বাক্ষরিত। কবিতার সাথে সাথে ছড়া লেখায় বাসিরের মুন্সিয়ানার পরিচয় মেলে। ‘নিব’ ছড়ার কাগজ সম্পাদনায় তার সেই দক্ষতা লক্ষণীয়। এ ছাড়া ‘উৎসঙ্গ’ সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশনাতেও সুপরিকল্পনা ও সুসম্পাদনার চিহ্ন দেখেছি। ‘মতিউর রহমান মল্লিকের সাক্ষাৎকার’ সম্পাদনায় বাসিরের মনোযোগ ও দক্ষতা প্রবলভাবে প্রকাশিত। তবে বাসিরের সাংগঠনিক দূরদর্শিতা ও পারদর্শিতা লেখক, পাঠক ও সংশ্লিষ্ট মহলকে আশ্বস্ত করত। বিশেষভাবে ‘উৎসঙ্গ সৃজন চিন্তন’ সংগঠনের কার্যক্রম ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্য জগতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। এ ছাড়া ঢাকার কালশীতে ‘সংকল্প শিশু-কিশোর সংসদে’ বস্তিবাসী ছিন্নমূল শিশু-কিশোরদের নিয়ে সঙ্গীত, আবৃত্তি, অঙ্কনসহ নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নে তার উদ্যোগ ও কাজ প্রশংসার দাবিদার।
কোনো কোনো মৃত্যু হয়তো পাতাঝরার মতো; আবার কোনো কোনো মৃত্যু বজ্রপাতের মতো আমাদের আহত করে। আহমদ বাসিরের প্রস্থান সে রকম একটি মৃত্যু। চরম দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অভাব-অনটন, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তাকে দৈহিক মরণের প্রান্তে এনেছে; কিন্তু জীবনের কাছে পরাজিত ও হতাশ হয়নি কবি। একজন মর্যাদাবান কবির জীবন উদযাপন করেছে এই ক্ষণজন্মা প্রতিভা। তার সৃষ্টি নিয়ে কাজ করার দায় এখন আমাদের। বিদায় হে কবি। হ


আরো সংবাদ



premium cement