২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মৌলিক লেখক : নিজস্ব রচনাশৈলী

-

মৌলিক লেখক মাত্রেরই নিজস্ব রচনাশৈলী বা স্টাইল থাকে। লেখার কাঠামো, প্রকাশভঙ্গি, বিষয়-নির্বাচন, ভাষা-ব্যবহার-রীতি, জীবনবোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আনার নামই রচনাশৈলী। আসলে রচনাশৈলী হলো রুচি গঠনেরই চূড়ান্ত রূপ। রচনাশৈলী গঠনের সাধনাই লেখকের সাধনা। এই সাধনায় একাগ্রতা বা নিষ্ঠা না থাকলে সারা জীবনেও অগ্রজ লেখকের প্রভাবমুক্ত হওয়া যায় না।
প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিকের অনুসৃত উপায়, পদ্ধতি ও শৈলীর সাথে পরিচিত হওয়ার অর্থ আদর্শের সন্ধান পাওয়া। তাই বলে কেবল মহৎ লেখকদের গ্রন্থ পাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলে না, জীবনকেও দেখতে শিখতে হয়। কারণ সাহিত্য একদিকে যেমন জীবনের প্রতিকৃতি, অন্যদিকে আবার সমালোচনাও। অগ্রজ লেখকদের সাথে তাই লেখককে নিজের দৃষ্টির মিল-অমিল খুঁজতে হয়, খুঁজতে খুঁজতে নেমে আসতে হয় বাস্তবের পলিতে। গভীর হৃদয়বৃত্তি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হয় বাস্তবকে, চারপাশের প্রকৃতিকে। কেননা, কেবল বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে সাহিত্য হয় না। বুদ্ধির সাথে চাই কল্পনা ও অনুভূতির সমন্বয়। প্রখর কল্পনাশক্তি ও গভীর জীবনানুভূতি লেখকের অন্যতম প্রধান গুণ।
ঘটনার পেছনের ঘটনা জানার কৌতূহল লেখকের থাকতে হয়। তাঁকে হতে হয় নৈর্ব্যক্তিক। এ জন্য জগৎ সম্পর্কে তাঁর থাকা চাই একটা নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। দৃষ্টিভঙ্গি যদি নৈতিক না হয়, তা হলে রচনা কখনো সুসংবদ্ধ হয় না, এতে যুক্তিরও কোনো জোর থাকে না। অপরাধ ও অপকর্মের সাথে জড়িত থেকে আর যা-ই কিছু লেখা থাক না কেন, সামাজিক ন্যায়নীতি ও মূল্যবোধের কথা কেউ লিখতে পারে না। অথচ বড় লেখক হওয়ার গোপন রহস্য হলো মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। তাই সাহিত্যিক রুচি গঠনের সাথে সাথে আমাকে আমার ব্যক্তিরুচিরও পরিশুদ্ধ ঘটাতে হবে।
লেখকের রুচি বিষয়টা আসলে অত্যন্ত গভীর। সমাজ, সময়, জীবন, জগতের সবকিছুই লেখকের রুচি গঠনে ভূমিকা রাখে। তাই এসব কিছুই লেখকের পঠনসূচির আওতাধীন। খ্যাতনামা লেখকদের রচনা পাঠ করতে হবে। তবে কেবল সাহিত্য পাঠ করব তা নয়; আমাকে ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান সব ধরনের রচনাই পাঠ করতে হবে। তা না হলে আমার দৃষ্টিভঙ্গি সংস্কারমুক্ত ও বৈজ্ঞানিক হবে কী কবে? লেখক হওয়ার পক্ষে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি যে অত্যন্ত জরুরি। পর্যালোচকের দৃষ্টিতে পাঠ করলেই আমি ধরতে পারব শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সৃষ্টির কৌশল। লেখকের ভাষা ব্যবহার, প্রকাশভঙ্গি বিষয়ের বিস্তার, চরিত্র-চিত্রণ সব কিছুতেই গভীর দৃষ্টিতে আমাকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। গ্রন্থটা যদি কবিতার হয়ে থাকে, তবে আমাকে লক্ষ করতে হবে শব্দচয়ন, উপমা-চিত্রকল্পের ব্যবহার, ছন্দ, অন্ত্যমিল ইত্যাদির বিশেষত্ব।
রস সঞ্চারের মধ্য দিয়েই লেখক তাঁর হৃদয়ের সাথে সংযোগ ঘটান পাঠক হৃদয়ের। এই সংযোগের নামই সাহিত্য। আর যে ক্রিয়াকৌশল অবলম্বন করে সংযোগ স্থাপন করা হয় সেই ক্রিয়াকৌশল হলো শিল্প। এই শিল্পের প্রধান বাহন ভাষা। ভাষার মাধ্যমে লেখক নিজের ভাব বা অনুভূতিকেই সাহিত্যে রূপদান করেন। সুতরাং সাহিত্য হলো ভাব সঞ্চারের শিল্প। কোনো দৃশ্য বা ঘটনার রসানুভব যে ভাব সৃষ্টি করে তাকে ভাষার সাহায্যে পাঠকের বা শ্রোতার হৃদয়ে সঞ্চারিত করাই লেখকের কাজ।
শিল্প-সাহিত্যের কলাকৌশল অনেকটা অশরীরী ব্যাপার। যা টের পাওয়া যায়, দেখা যায় না। সে কারণে আমাদের পুরো বিষয়টাকে খতিয়ে দেখতে হবে অন্যভাবে। আমরা যে বইটা তরতর করে পড়ি, পড়ে মুগ্ধ হই, চমৎকৃত হই, আন্দোলিত হই, পুলকিত হই, ক্ষুব্ধ হই, বিস্ময়াভিভূত হই, আবেগাপ্লুত হই, স্বপ্নাবিষ্ট হই, ভূতাবিষ্ট হই সে বইটা কিন্তু লেখক মুহূর্তের ভাবনায় হঠাৎ বসে তরতর করে লেখেননি। বইটা লেখার জন্য লেখককে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘদিন, তার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়েছে নানাভাবে। এই প্রস্তুতি পর্বে লেখক কখনো কাজ করেছেন শিল্পীর মতো, কখনো মিস্ত্রির মতো। বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে তিনি দিয়েছেন কল্পনার মিশেল, ভাবকে সাজিয়ে তুলেছেন ছন্দ, সুর ও আবেগের কারুকাজে, ভাষার ওপর করেছেন মনোহারী চুনকাম।
শব্দ প্রয়োগের সাথে সাথে বাক্য গঠন সম্পর্কেও সজাগ হওয়া দরকার। লেখক অনেক কারণে তরল হতে পারে। কারণগুলোর মধ্যে ভাবের অসঙ্গতি, প্রকাশভঙ্গির দুর্বলতা, ভাষাগত ত্রুটি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ভাষাগত ত্রুটি সংঘটিত হয় প্রধানত শব্দ প্রয়োগ ও বাক্যগঠনে। ক্রিয়াপদের যথার্থ ব্যবহার ভাষাকে অর্থপূর্ণ সুষম গতিশীল করে; আবার ক্রিয়াপদের অসতর্ক ব্যবহার ভাষাকে করে তুলতে পারে নীরস ও ক্লান্তিকর। ভাষার ক্রিয়াপদের কিন্তু বিভিন্ন কালরূপ আছে। যেমনÑ সাধারণ অতীত, নিত্যবৃত্ত বর্তমান, পুরাঘটিত অতীত, নিত্যবৃত্ত অতীত ইত্যাদি।
গল্প-উপন্যাস লেখার সময় লেখককে আগেই ক্রিয়াপদের কালরূপ ঠিক করে নিতে হয়। ক্রিয়াপদের একটা কালরূপ অবলম্বন করে যেমন একটা কাহিনী বর্ণনা করা যায়, তেমনি অনেক কালরূপের মিশ্রণ ঘটিয়েও করা যায়। বাংলা ভাষার সাধারণ অতীত কালরূপটি বহুল ব্যবহৃত হলেও নিত্যবৃত্ত বর্তমান কালরূপটি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, নিত্যবৃত্ত বর্তমান কালরূপটি চিন্তার জটিলতা অধিকমাত্রায় ধারণ করতে সক্ষম। আসলে কালরূপ নির্ভর করে লেখকের বক্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। বক্তব্যের সুর, ভঙ্গি ও দর্শনের সাথে সঙ্গতি রেখে কালরূপ নির্ধারণ করে নিতে হয়। কালরূপ লাগসই না হলে কথার ধার অনেকখানিই ক্ষয়ে যায়।
বাক্যের আকার নিয়েও লেখককে ভাবতে হবে। মানুষের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা বা মানস প্রবণতার ওপরই বাক্যের আকার নির্ভর করে। সে কারণে কোনো লেখকের বাক্য হয় বড় আবার কোনো লেখকের ছোট। বড়-ছোট উভয় ধরনের বাক্যের কিন্তু মন্দ দিক আছে। বড় বাক্যে অনেক সময় বক্তার চিন্তাকে অস্পষ্ট করে তোলে; মর্মোদ্ধার করতে শ্রোতা বা পাঠকের বেশ বেগ পেতে হয়। অপর দিকে ছোট বাক্যে ভাবের ঋজুতা ব্যাহত হয়। ভাববস্তু চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় বলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ছোট বাক্যের লেখাকে কথার কচকচি বলে মনে হয়। এ জন্য শুধু বড় বাক্য বা শুধু ছোট বাক্যের সমন্বয়ে লেখা একটু ঝুঁকিপূর্ণ বৈকি। ছোট-বড় উভয় ধরনের বাক্যের মিশ্রণে লেখাই শ্রেয়। ছোট-বড় বাক্যের মিশ্রণ বক্তব্যকে হৃদয়গ্রাহী করে। তবে বড় বাক্যগুলো যাতে অতিমাত্রায় বড় না হয় সেদিকে অবশ্যই দৃষ্টি রাখতে হবে। হ


আরো সংবাদ



premium cement
জিআই স্বীকৃতির সাথে গুণগত মানের দিকেও নজর দিতে হবে : শিল্পমন্ত্রী অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ চুয়েট, শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ সখীপুরে সাবেক ও বর্তমান এমপির সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ তীব্র গরমের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার অন্যতম দায়ী : মির্জা আব্বাস সৈয়দপুরে জামায়াতের উদ্যোগে সালাতুল ইসতিসকার নামাজ আদায় জিম্বাবুয়ে সিরিজের শুরুতে না থাকার কারণ জানালেন সাকিব ঝালকাঠিতে গ্রাম আদালত কার্যক্রম পরিদর্শনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল চুয়াডাঙ্গায় বাতাসে আগুনের হল্কা : গলে যাচ্ছে সড়কের পিচ বৃষ্টির নামাজ আদায়ের নিয়ম আজও স্বর্ণের দাম ভরিতে ৬৩০ টাকা কমেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২৮ এপ্রিল খুলে দেয়ার প্রস্তুতি, ক্লাস চলবে শনিবারও

সকল