২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ওমর আলীর কবিতা জেগে আছে ইতিহাস

-

আমাদের দেশে আধুনিক ইতিহাসচর্চা পাশ্চাত্য বা ইউরোপ থেকে এসেছে। আঠারো শতকের শেষে বা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিপ্লবের আগে ইতিহাস দৈনন্দিন জীবনের অংশ ছিল। ঐতিহ্য রীতিনীতি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল ইতিহাস অনুমোদিত; যা কিছু অতীত তাই যেন জীবনের মূলমন্ত্র ছিলÑ তখন এমন বিশ্বাস ছিল যে, তারা যেন পিতা-পিতামহের অনুরূপ জীবনযাপন করে। আঠারো শতকের পরে অর্থাৎ উনিশ শতকের বৈপ্লবিক অভিঘাত অনেক প্রচলিত ধারণার পরিবর্তন আনে। ‘কালজীর্ণ প্রাচীনকে সরিয়ে স্থান করে নেয় নব্য নাগরিকদের বিপ্লব স্পৃষ্ট জীবন, শ্রমবিভাজন আমলাতান্ত্রিকতার বিকাশ এবং আরো নানা পরিবর্তন। বস্তুতপক্ষে স্থায়িত্বের বদলে পরিবর্তনই কালের বাণীবহ হলো। অতীত তাই আর জীবন্ত ঐতিহ্য নয়, বরং গণ্য হলো উত্তীর্ণ কালের অংশ হিসেবে।’
ইতিহাস পরিবর্তনের ক্ষমতা মানুষের হাতে। তাই ইতিহাস অতীতের কথা বলে ভবিষ্যতের পথ দেখায়। নিজের জীবনে না হলে উত্তর পুরুষদের জীবনে তা পরিবর্তন আনবে। ফলে ইতিহাস ভবিষ্যৎ নির্মাণের প্রেরণা হয়ে ওঠে। প্রগতি, সভ্যতা স্বাধীনতা, জাতীয় ঐক্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ইত্যাদি উঠে আসে ইতিহাসের আকর থেকে। ফলে ইতিহাস মানব জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, বিজ্ঞানী, শিল্পী, কবি-সাহিত্যিক সবাই তাই ইতিহাস দ্বারস্থ হলেন এবং নিজেদের প্রয়োজনেই তারা ইতিহাসকে ব্যবহার করতে লাগলেন। শুধু নিজ প্রয়োজনেই নয়, কিছু কবি দেশ ও জাতির দায়বদ্ধতাকে কাঁধে নিয়ে ইতিহাসকে আশ্রয় করে কলম ধরেছেন। এর মধ্যে কবি ওমর আলী অন্যতম।
সিন্ধু সভ্যতার কাল থেকে ভারত উপমহাদেশে প্রাচীন যুগ শুরু হয়। এই প্রাগৈতিহাসিক যুগকে বলা হয় প্রস্তর যুগ। পৃথিবীতে তারও বহু আগে মানব সভ্যতার বিকাশ সাধিত হয়েছে। এ উপমহাদেশে প্রস্তর যুগের সূচনা হয়েছিল প্রায় ২০ লাখ বছর আগে। এ সময় মানুষ পাথরের তৈরি হাতিয়ারের ব্যবহার শিখেছিল। তারা ফল-মূল কুড়িয়ে, মাছধরে কিংবা পশু-পাখি শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত। ক্রমে তারা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বসবাস করে চাষাবাদ, হাট বাজার ইত্যাদির সূচনা করে। ধীরে ধীরে তাদের সভ্যতার বিকাশ সাধিত হতে থাকে। কাটতে থাকে যুগ থেকে যুগান্তর।
ওমর আলীর কবিতায় প্রসঙ্গক্রমে প্রস্তর যুগ, নিওলিথিক যুগ, হামুরাব্বি, সিন্ধুরাজা, মোগল সম্রাট প্রভৃতির কথা এসেছে। এসব প্রসঙ্গ এসেছে কখনো উপমা হিসেবে, কখনো খণ্ডাংশ ভাবে, কখনো পরিপূর্ণ কাহিনী হিসেবে। যেমন আধুনিক যুগ চেতনায় ‘ভালোবাসার দিকে’ কাব্যগ্রন্থের ‘এ তো ছিল না’ কবিতায় এসেছে উপমা হিসেবেÑ
তবুও কি যেন থেকে যায় নিওলিথিক যুগের আভাস আলোড়িত
হতে দেখি রক্তে আজো, নেপেনথি আমাদের সমস্ত বিষাদ ভুলাতে পারে না...
প্রস্তর যুগেও কেউ জানত না নিওলিথিক যুগের মাথার খুলি
ভরে কিংবা মদ খাওয়া এত হয়নি নারীকে এত অপমান আর অবহেলা...
আধুনিক সভ্যতার নগ্ন সংস্কৃতি, মানব-মানবীর আধুনিকতা কবিছে ররেছে বেদনাহত। নিচের পঙক্তিগুলোতে পাওয়া যায় এমনই চিত্রÑ
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রস্তর যুগের কিছু আগের
সমাজের গভীরতম ইতিহাসের থিথিসগুলো অসমাপ্ত রেখে
একদল দুঃসাহসিক যুবক যুবতী
ধর্মালয়ের রাস্তা থেকে
শুঁড়িখানার রাস্তায়
স্টাট ন্যাকেড প্রকাশ্যে হেঁটে যায়।...
প্রস্তর যুগের আগেকার পুরনো মানুষ পুরনো পৃথিবীকে
পশু প্রবৃত্তির অরণ্য, নীরসতার পাহাড়, স্বভাবের নদী
দিগন্তের নিরুত্তর কুয়াশার দিকে।
(শৈশবে ফেরা : স্থায়ী দুর্ভিক্ষ সম্ভাব্য প্লাবন)
কবির যুগ চেতনার পরিক্রমায়, ‘শাদাফুল শাদা আগুন’ কবিতায় এসেছে প্রাচীন রাজা হামুরাব্বি ও অন্যান্যদের প্রসঙ্গÑ
দু-একটা শাদাফুল পৃথিবীতে ছিটকে পড়ে
উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে শাদা চুন
সেনাচেরির, হামুরাব্বি, তুতান খামেন কিংবা তারও আগে থেকে
পিরামিডগুলো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে।
সম্রাট জাহাঙ্গীর ওরফে শাহজাদা সেলিম ও আনারকলির ঐতিহাসিক প্রেমের চিত্র ফুটে উঠেছে ‘একটি গোলাপ’ কাব্যগ্রন্থের ‘আনারকলি’ শিরোনামের নাট্যগুণসমৃদ্ধ কবিতাটিতে। সেলিমের মুখে আনারকলির সৌন্দর্যের স্তবÑ
আনারকলি সে ঠিকই ডালিমফুলের রক্তকলি
বসরাই গোলাপ তার কাছে তুচ্ছ, শতদীপাবলী
জ্বালালে উজ্জ্বল আলো যেমন সুন্দর হতে পারে
বেহেশতি হুরের মতো অমন রূপসী যেন তারে
মনে হয়। ক্ষীণকটি তন্বী এই নব্য মেয়েটিরে
কিশোরী নুরজাহান বেশি চেয়ে সুন্দর শরীরে
আমার নয়নে যেন দেখি, তাই চোখে চোখে ভাসে
সে যেন আমার কক্ষে একটি পরীর মতো আসে।
‘১৭ জানুয়ারি ১৯৯১’ শিরোনামের কবিতাটিতে উপসাগরীয় (ইরাক) যুদ্ধ প্রসঙ্গে এসেছে মধ্যযুগের বাগদাদ ধ্বংসকারী কুখ্যাত হালাকু খানের কথাÑ
তাকরিতের সাহসী বেদুইন তরবারি ছুড়ে মারছে
আকাশের দিকে ছুড়ে মারছে দাঁত
বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়


আরো সংবাদ



premium cement