১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তারুণ্যের কবিতা চিন্তা

-

কবিতা হৃদয়ে গ্রথিত অথবা প্রোথিত একটি অলৌকিক স্বপ্ন যা জাগ্রতাবস্থা বা নিদ্রিতাবস্থায় প্রত্যক্ষবৎ অনুভূত বিষয়। কল্পনাপ্রসূত এই অনুভূত বিষয় বেশির ভাগ সময় অধরা থেকে যায়। যখন তাকে ধরা যায় অথবা সে নিজ থেকে ধরা দেয় তখন একজন কবি সার্থক। কবিতাকে ধরতে হলে কবিকে কখনো ডুবুরি হতে হয়, কখনো নভোচারী হতে হয়, কখনো প্রকৃতিপ্রেমী অথবা উন্মাদ প্রেমিক হতে হয়। আমি মনে করি, অস্তিত্বের মহাসমুদ্রে ডুব দিয়ে হাজার হাজার ঝিনুক তুলে কোনো একটি ঝিনুক থেকে ০.০০১ আউন্স মুক্তা বের করার নামই কবিতা। সুতরাং এত পরিশ্রমের ফসল সহজেই যে কেউ অনুধাবন করতে পারবে বা মূল্যায়ন করতে পারবে সেটা ভাবা ঠিক নয়। ০.০০১ আউন্স মুক্তার ওজন দাঁড়াবে একটি পৃথিবীর সমান। শুধু একটি পৃথিবী নয়, হতে পারে এই ওজন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমান। এতটা ভার সইবার ক্ষমতা অনেকের থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। আমি আরো মনে করি, সমগ্র আকাশের প্রতিটি নক্ষত্র পরিভ্রমণ শেষে সেখান থেকে একবিন্দু আলো হাতের মুঠোয় ধরার নামই কবিতা। আমি এটাও মনে করি, গাছপালা-তরুলতা থেকে শুরু করে নদী-নালা পশু-পাখি সবকিছুকে অন্তর্দৃষ্টিতে অবলোকন শেষে এক টুকরো প্রেম অন্তরে ধারণ করার নামই কবিতা। ফলেই একজন কবিকে উন্মাদ প্রেমিক হতে হয়।
নিবন্ত হৃদয়ে জীবন্ত আগুন জ্বালানোর নাম কবিতা। হৃদযন্ত্র সম্পূর্ণ বিকল করে শিকল টেনে নতুন শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকার নাম কবিতা। ¯œায়বিক পদ্ধতিতে প্রেমের এক্স-রে করে প্রেম-পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার নাম কবিতা। ব্যর্থতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জীবন জীবন করে জীবন ধারণের নাম কবিতা। আমি তাই কবিতার রসায়নে ডুবে দেখি অ্যানোডেও আছি, ক্যাথোডেও আছিÑ নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে নিউট্রন অথবা ইলেকট্রন। কখনো আমাকে পরিপূর্ণ পেলাম না। সুতরাং কবিতার উপলব্ধি মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। এ কারণে এ পর্যন্ত প্রকাশিত আমার ১০টি কাব্যগ্রন্থের সবগুলোই নিজেকে উৎসর্গ করেছি। আমার কবিতাকে আমি যেভাবে ভাঙচুর করব, যেভাবে মূল্যায়িত করব অন্যরা সেভাবে পারবে না বলেই বিশ্বাস। কেননা, কবিতা এমনই একটি উপলব্ধির বিষয় যা নিজত্বের সীমানায় আরো আনন্দিত হতে পারে।
কবিতা একটি বিষণœ হলুদ পাতার ঝরে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত, তখনো সে মূদু বাতাসে মৃদু মৃদু কাঁপতে থাকে। এরকমভাবে অনন্তকাল একটি কম্পমান পাতার বেঁচে থাকার নাম কবিতা। কবিতা একটি নদীর পাড়ে ফেটে যাওয়া মাটির চাঁই, যেন আর একটি ঢেউ এলেই নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। কিন্তু কখনো সেই ঢেউটি আসে না এবং কোনো দিন আসবে না। কবিতা বেঁচে থাকে চিরকালের হয়ে।
আমার লেখালেখির শুরুতে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং জসীমউদ্দীন ছিলেন মূল আশ্রয়। একটা সময় টেড হিউজের কবিতায় আসক্ত ছিলাম। কিন্তু সব হিসাব শেষে জীবনানন্দ দাশ আর আল মাহমুদ আমার কবিতার কেন্দ্রবিন্দুতে উপস্থিত থাকেন, যদিও তাঁদের কাউকে অনুসরণ করে কবিতা লিখি না। আমি লিখি আমার নিজস্ব সৃষ্টিশীল ধারায়, নিজস্ব চিন্তা-চেতনা থেকে। কখনো মহাসমুদ্রে ডুব দিতে গিয়ে হাবুডুবু খাই, কখনো মহাকাশের নক্ষত্রমণ্ডলে গিয়ে নিজেই নক্ষত্র হয়ে যাই, কখনো প্রকৃতির সাথে জড়াজড়ি করতে গিয়ে লতাপাতা বা বেতসকাঁটায় জড়িয়ে যাই, আবার কখনো মানবপ্রেমে উৎসাহী হতে গিয়ে অসংখ্য ঈশ্বরীর হাতে বন্দী হয়ে পড়ি। এভাবেই কবিতার সন্ধানে নিরন্তর ছুটে চলা।
কবিতার পথ আর জীবনের পথ সবচেয়ে বেশি পিচ্ছিল, সর্পিল ও বন্ধুর। যদিও দু’টি পথের যাত্রা ভিন্ন, গন্তব্য ভিন্ন, কিন্তু পরস্পরসদৃশ এই ভয়ঙ্কর পথ পাড়ি দিতে অনেক চড়াই-উতরাই অতিক্রম করতে হয়। অস্থির কুয়াশা ঠেলে ঠেলে একা অন্ধ হাঁটার নাম কবিতা।
জীবনের অতল জলে ডোবা আর ভাসার নাম কবিতা। হৃদয়ের প্রখর রোদে পুড়ে পুড়ে পাথর হওয়ার নাম কবিতা। কবিতা লেখা তাই কষ্টের কাজ। কবিতা লিখব না ভাবলেও বারবার ছড়ের তারের মতো বেজে ওঠে আত্মার তার। এই তার বাজার ঝঙ্কার সব দুঃখকে ভুলিয়ে দেয়। ঝঙ্কৃত সুরে থাকে স্বপ্ন, সত্য, কাক্সক্ষা, আনন্দ, ভালোবাসা, হাসি, উন্মাদনাÑ সব, সব কিছু। আত্মার তার বাজে, কবিতা আমাকে ডাকে। ফলে আমি কবিতার কাছে পরাজিত। একদিন অন্ধকারের দুয়ার খুলে কোনো এক আলোর সন্ধানে চলে যাবো কবিতার হাত ধরে। ডেকেও আমাকে পাবে না এই ফুল, এই প্রজাপতি, এই পাখি, এই ঘাস, এই মাটি। খুঁজেও আমাকে পাবে না অন্তরিক্ষÑ না চাঁদ, না সূর্য, না নক্ষত্রপুঞ্জ। আমার কবিতা আমি অথবা কবিতার প্রেম আমি নাকি আমি প্রেমের কবিতাÑ কেউ কোনো দিন জানতে পারবে না।
পরিশেষে একটি কথাÑ আমি যেন কবিতায় বাঁচি, কবিতায় মরি আর কবিতা যেন আমার প্রাণ হয়, আমি যেন কবিতার প্রাণ।


আরো সংবাদ



premium cement